কার হাতে গাজাবাসীর রক্তের দাগ!



ড. মাহফুজ পারভেজ
কার হাতে গাজাবাসীর রক্তের দাগ!

কার হাতে গাজাবাসীর রক্তের দাগ!

  • Font increase
  • Font Decrease

একতরফা ইসরায়েলি হামলায় গত অক্টোবর (২০২৩) থেকে প্রায় ৩৭ হাজার মৃত্যু ঘটেছে গাজায়। হামলা এখনো অব্যাহত। নিহতদের বেশির ভাগই নারী, শিশু, বৃদ্ধ, সাধারণ নাগরিক। নিহত হয়েছেন, হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অসুস্থ মানুষ, ত্রাণকর্মী, আন্তর্জাতিক সংস্থার স্বেচ্ছাসেবী, চিকিৎসক, নিরীহ ও নিরপেক্ষ মানুষজন।

ফিলিস্তিনের ক্ষুদ্র জনপদ গাজায় মৃত্যুর মহোৎসবের দায় কার! কার হাতে লেপ্টে আছে সহস্র গাজাবাসীর রক্তের দাগ! কোনো ভণিতা ও কৌশলে এড়ানো সম্ভব হবে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের দায়বদ্ধতার! শাঠ্য-ষড়যন্ত্রে আড়াল করা যাবে, হত্যাকারীর রক্তলোলুপ-কুৎসিত চেহারা!

গাজায় নিজেদের হামলা, গণহত্যা ও দখলদারিত্বকে যতই হামাসবিরোধী আন্দোলন বলে দেখানো চাক ইসরায়েল, আসলে তা চাপিয়ে দেওয়া যুদ্ধ ও সাফ গণহত্যা। বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত এই বার্তা দিয়ে সম্প্রতি ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্টের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানার আবেদন জানিয়েছেন ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল কোর্ট (আইসিসি)-র চিফ প্রসিকিউটর করিম খান। আন্দোলন হচ্ছে, ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের শত শত বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে।

কিন্তু সেই দাবির বিরোধিতা করে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বলেছেন, 'গাজায় যা হচ্ছে, তা কিছুতেই গণহত্যা নয়'। যদিও বাইডেন বিরোধীদের দাবি, গাজার ব্যাপারটিতে কার্যত চোখ বুজে রয়েছেন প্রেসিডেন্ট। 'গণহত্যাকারী জো’ তকমাও জুটেছে তার। গণহত্যাকারী নেতানিয়াহুকে নির্লজ্জভাবে সমর্থন করে বাইডেন নিজের হাতে গাজাবাসীর রক্তের দাগ লাগাতেও পিছপা হননি।

গণহত্যাকারী নেতানিয়াহুকে নির্লজ্জভাবে সমর্থনকারী বাইডেনের সুরে কথা বলেছেন, ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনকও। আইসিসি-র দাবির বিরোধিতা করে তিনি বলেছেন, 'করিমের এই আবেদন মধ্য এশিয়ায় শান্তি আনতে পারবে না।' তাহলে শান্তি আনবে আরো মৃত্যু ও গণহত্যা! মনে মনে নেতানিয়াহু, বাইডেন, ঋষি সুনক আরো যুদ্ধ, আরো গণহত্যা, আরো রক্ত, আরো মৃত্যুই চাইছেন! গণতন্ত্র, আইনের শাসন ও মানবাধিকারের মুখোশের আড়ালে তারা আসলে গণহত্যাকারীর দোসর।

ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল কোর্ট (আইসিসি)-র চিফ প্রসিকিউটর করিম খানের দাবি, ২০২৩-এর ৭ অক্টোবর থেকে হামাস ও গাজার সংঘর্ষে মানবতা বিপন্ন। নির্বিচারে প্রাণ হারাচ্ছেন গাজার নারী-পুরুষ-শিশু। ত্রাণটুকুও পৌঁছচ্ছে না। তাই, প্রয়োজন আগ্রাসীর বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানার।

নেদারল্যান্ডসের দ্য হেগ শহরে ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল কোর্টে মূলত গণহত্যা, মানবতাবিরোধী ঘৃণ্য অপরাধ, যুদ্ধাপরাধের বিচার হয়। ইসরায়েলের বিরুদ্ধে সেখানে মামলা করেছিল দক্ষিণ আফ্রিকা, মামলা করেন গাজায় আক্রান্তদের আইনজীবীরাও। মামলায় গণহত্যা প্রমাণিত হয়েছে। নেতানিয়াহু অপরাধী হয়ে গ্রেফতারের মুখোমুখি।

গ্রেফতারি পরোয়ানা নিয়ে প্রতিবাদে মুখর হয়ে ওঠেন অপরাধীদ্বয়: নেতানিয়াহু ও গ্যালান্ট। তাদের পক্ষে সুর মেলান ইসরায়েলের প্রেসিডেন্ট আইজ্যাক হারজগও। ছুটে এসে আপত্তি জানিয়েছে আমেরিকা ও ব্রিটেন। তবে হঠাৎ করে সুর বদলে আইসিসিকে সমর্থন করে ফ্রান্স ও বেলজিয়াম। গাজার সরকারি সংবাদমাধ্যম দফতর ও প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশনও করিমের আবেদনকে স্বাগত জানিয়েছে।

গণহত্যা থেকে চোখ সরিয়ে দিতে নেতানিয়াহুর দাবি, আসলে করিম ফের ইহুদি-বিদ্বেষ জাগিয়ে তুলতে চাইছেন। তিনি ‘আধুনিক যুগের অন্যতম প্রধান ইহুদি-বিদ্বেষী’। তিনি বলেন, 'দ্য হেগের আইনজীবী কীভাবে গণতান্ত্রিক ইসরায়েলের সঙ্গে রক্তপিপাসু হামাসের তুলনা করছেন! ইসরায়েলি বাহিনী স্রেফ আত্মরক্ষার খাতিরে লড়াই করছে। আর হামাস নির্বিচারে অপহরণ করে খুন ও ধর্ষণ করেছে আমার ইসরায়েলি ভাই-বোনেদের।' প্রায় একই সুরে গ্যালান্টের দাবি, ইসরায়েলের হকের লড়াইকে অন্যায়ভাবে প্রভাবিত করতে চাইছেন করিম। এদেরই অভিন্ন সুর শোনা যাচ্ছে, বাইডেন ও ঋষি সুনকের কণ্ঠে।

ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল কোর্ট (আইসিসি)-র চিফ প্রসিকিউটর করিম খান যেদিন এই গ্রেফতারি পরোয়ানার দাবি জানান, সেদিনই হোয়াইট হাউসে ‘ইহুদি ঐতিহ্য মাস’ সংক্রান্ত একটি বিশেষ অনুষ্ঠানে প্রেসিডেন্ট বাইডেন বলেন, ‘আমি স্পষ্টভাবে একটা কথাই বলতে চাই। ইসরায়েল রাষ্ট্র আর হামাসের মধ্যে কোনো তুলনাই হয় না। আমরা আইসিসি-র প্রস্তাব সম্পূর্ণ খারিজ করে দিচ্ছি।’ ইসরায়েলের অর্থমন্ত্রী বেজালেল স্মোট্রিচও বলেন যে, ইহুদিদের প্রতি এই ধরনের তীব্র বিদ্বেষ দেখা গিয়েছে, একমাত্র নাৎসি জার্মানিতেই।

হামাসের পাল্টা দাবি, 'নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানার বিষয়টিতে বেশ দেরি করে ফেললো আন্তর্জাতিক আদালত। আর তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগের কোনো ভিত্তি নেই। বরং ইসরায়েলি অপরাধের তুলনায় হামাস কিছুই করেনি।'

একদা ইসরায়েলসমর্থক ফ্রান্স ও বেলজিয়াম ৩৭ হাজার গাজাবাসীর মৃত্যু পর অবশ্য এক বিবৃতি প্রকাশ করে করিমকে সমর্থন জানিয়েছে। ফ্রান্সের মতে, ইসরায়েলের ‘আত্মরক্ষা’র খাতিরে বহু নিরপরাধ মানুষের মৃত্যু হয়েছে। এর বিচার প্রয়োজন। একই সুর বেলজিয়ামের। এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছে মানবাধিকার সংস্থাগুলোও।

করিম ও তার সহযোগীদের দাবি, হামাস মৌলিক মানবাধিকারকে খর্ব করেছে। ইসরায়েলও আত্মরক্ষার নামে আন্তর্জাতিক মানবতার আইন না মেনে নির্বিচারে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে। ঠিক এই কারণেই গ্রেফতারি পরোয়ানা প্রয়োজন। গণহত্যা থামানো ও গণহত্যাকারীকে আইনের আওতায় আনা দরকার।

এত কিছুর পরেও থেমে নেই ইসরায়েলি গণহত্যা। থেমে নেই গণহত্যার দায়ে অভিযুক্ত নেতানিয়াহুর প্রতি বাইডেন ও ঋষি সুনকের উলঙ্গ সমর্থন। এমনকী, গণহত্যার তাণ্ডবে মদমত্ত ইহুদি নেতা নেতানিয়াহু গ্রেফতারি পরোয়ানা মাথায় নিয়েও দর্পিত চিৎকারে ঘোষণা করেছেন, 'তার জীবদ্দশায় আলাদা রাষ্ট্র হবে না প্যালেস্টাইন।' কিন্তু তার এই দম্ভোক্তি ব্যর্থ হওয়ার পথে।

বরং আশার কথা হলো, কতিপয় যুদ্ধোন্মাদ ছাড়া মানবিক বিশ্বনেতৃত্ব একবিংশ শতকের নব্য-হিটলার, হন্তারক নেতানিয়াহুর বন্য-হুঙ্কারে কান দেয়নি। আয়ারল্যান্ড, নরওয়ে ও স্পেন ঘোষণা করেছে, 'আমরা ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিচ্ছি। আমরা এখন সেই সিদ্ধান্ত কার্যকর করার জন্য জাতীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করব। আমরা নিশ্চিত যে, আগামী সপ্তাহে আরো অনেক দেশ এই গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণে আমাদের সাথে যোগ দেবে।' গণহত্যার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে শান্তির আশা ব্যক্ত করেছেন দেশ তিনটির শীর্ষ নেতারা।

আজকে না হলেও ভবিষ্যতে কোনো একদিন বিশ্ব ঠিকই চিহ্নিত করবে কার হাতে ছিল গাজাবাসীর রক্তের দাগ। কারা ছিলেন গণহত্যাকারীর দোসর-সমর্থক, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধী। আর কারা ছিলেন শান্তির পক্ষে ও গাজা গণহত্যাকাণ্ডের বিপক্ষে।

ড. মাহফুজ পারভেজ: অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম, প্রফেসর, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও নির্বাহী পরিচালক, চট্টগ্রাম সেন্টার ফর রিজিওনাল স্টাডিজ, বাংলাদেশ (সিসিআরএসবিডি)।

   

ইফাতের খাসি ও প্রজাতন্ত্রের এক উচ্চকুলের কর্মচারী



কবির য়াহমদ
ছবি : সংগৃহীত

ছবি : সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

কোরবানির ঈদের আগে মুশফিকুর রহমান ইফাত নামের এক তরুণ একটি ছাগল নিয়ে ভাইরাল হয়েছিলেন। পনের লাখ টাকা দামের ছিল ছাগলটি। বলেছিলেন তিনি, এরকম একটি খাসি কেনা নাকি তার স্বপ্ন ছিল। এমন খাসি সামনাসামনি আগে কখনো দেখেননি তিনি। আল্লাহ তার নসিবে রেখেছেন বলে তার হয়েছে এই খাসি। আবেগাপ্লুত ছেলেটির কণ্ঠে এরপর ঝরল অশেষ সন্তুষ্টি; এরচেয়ে বেশি আর কী বলব!

এক ছাগলের দাম পনের লাখ—এমন ভিডিওতে সামাজিক মাধ্যমে তোলপাড় হয়েছে। মুহূর্তে ভাইরাল ছেলেটি ও তার ছাগল। ছাগলের এমন দামে পিলে চমকানোর মতো অবস্থা হলেও কোটি টাকা দামের গরুও আছে দেশে। গত এপ্রিলে রাজধানীর শেরে বাংলা নগরে অনুষ্ঠিত প্রাণিসম্পদ মেলায় একটি গরুর দাম হাঁকা হয়েছিল এক কোটি টাকা। দামের সপক্ষে তখন এর মালিক সাদিক অ্যাগ্রোর ইমরান হোসেন বলেছিলেন, গরুটির বংশমর্যাদার জন্য দাম বেশি। এই গরুটার বাবা, দাদা, দাদার বাবার পরিচয় আছে। তিনি বলেছিলেন, গরুর দাম এক কোটি চাওয়ার অনেক কারণ আছে। এক নম্বর কারণ হচ্ছে—এই গরু ১১০ বছরের পেডিগ্রি (বংশ পরম্পরা) আছে। আরেকটা বড় কারণ হচ্ছে, এই গরুর বাবা ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়ন ব্লাড লাইন।

পনের লাখ টাকা দামের ছাগল কোটি টাকা দামের গরুর মালিকের খামারের। আগের গরুটি কত টাকায় বিক্রি হয়েছিল, কে কবে কিনেছিল—সেটা জানা না গেলেও, জানা গেছে পনের লাখে কেনা ছাগলের ক্রেতার পরিচয়। মুশফিকুর রহমান ইফাত একজন সরকারি কর্মকর্তার ছেলে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট আপিলাত ট্রাইব্যুনালের সভাপতি ড. মো. মতিউর রহমান ইফাতের বাবা। তিনি রাষ্ট্রমালিকানাধীন সোনালী ব্যাংক পিএলসির পরিচালকও। এরপর আলোচনায় আসে মতিউর রহমানের স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ, ব্যাংকে গচ্ছিত অর্থের পরিমাণ, আয় ও ব্যয়ের নানা তথ্য। জানা যায়, দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) এসব তথ্য খতিয়ে দেখবে।

দৈনিক খবরের কাগজ মতিউর রহমানের সম্পদের তথ্য নিয়ে যে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে তাতে দেখা গেছে, তিনি একজন সরকারি চাকরিজীবী হয়েও এ পর্যন্ত শত কোটি টাকা সাদা করেছেন। বসুন্ধরায় দুই কোটি টাকার একটি ফ্ল্যাট এবং ধানমন্ডিতে ৪০ কোটি টাকা মূল্যমানের ৫ কাঠায় ৭ তলা বাড়ির মালিক। তিনি প্রায় ৩০০ বিঘা জমির ওপর গ্লোবাল জুতার ফ্যাক্টরি, রয়েছে ৬০ শতাংশ জমি। জেসিক্স নামে একটি যৌথ ডেভেলপার কোম্পানি রয়েছে তার। বসুন্ধরার ১৪ তলা বাণিজ্যিক ভবন আছে। গাজীপুর সদরে ৪০ কোটি টাকা মূল্যমানের ৮টি খতিয়ানে ৬০ শতাংশ জমি রয়েছে। তার প্রথম স্ত্রীর নামে সাভার থানার বিলামালিয়া মৌজায় ১৪.০৩ শতাংশ, গাজীপুর থানার খিলগাঁও মৌজায় ৬২.১৬ শতাংশ জমি রয়েছে। প্রথমপক্ষের ছেলের নামে ৯০ কোটি টাকা দামের ১৪.৫০ শতাংশ জমি আছে গাজীপুরে। তার নিজের ও পরিবারের সদস্যদের নামে আছে একাধিক দামি গাড়ি। তার নামে বেনামে বিভিন্ন ব্যাংকে ৫০ কোটি টাকার বেশি এফডিআর করা আছে। তিনি একাধিক বিয়ে করেছেন।

গণমাধ্যমে আসা সম্পদের এই তথ্য তার নিজের নামের এবং পরিবারের একটা অংশের নামে। অন্য স্ত্রী ও পরিবারের সদস্যদের নামে থাকা সম্পদের তথ্য আসেনি। যেখানে মুশফিকুর রহমান ইফাতরা রয়েছেন। ইফাতের দামি দামি গাড়ির যে তথ্য সামাজিক মাধ্যমে এসেছে, তাতে দেখা যাচ্ছে এই পক্ষ এবং যদি অন্য কোথাও অন্য কারো নামে কোন সম্পদ থাকে সেগুলো এখনো অপ্রকাশ্য। তবে প্রকাশিত তথ্যই বলছে, তিনি অন্তত হাজার কোটি টাকার মালিক।

মতিউর রহমান মুশফিকুর রহমান ইফাতের সঙ্গে তার রক্তের সম্পর্ককে অস্বীকার করেছেন। বলেছেন, ইফাত তার সন্তান নয়। যদিও ফেনির সংসদ সদস্য নিজাম উদ্দিন হাজারী বলছেন, ইফাত মতিউর রহমানের দ্বিতীয় স্ত্রীর ঘরের সন্তান। নিজাম উদ্দিন এমপি দাবি করছেন, ইফাতের মা তার আত্মীয় হন। একই কথা বলেছেন ফেনির একাধিক জনপ্রতিনিধি, যা ইতোমধ্যেই গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। অর্থাৎ মতিউর রহমান পুত্রের ছাগলকাণ্ডে ভাইরালের পর তার সম্পদের তথ্য বের হয়ে যাওয়ায় রক্তের সম্পর্ককেই অস্বীকার করে বসেছেন।

একজন সরকারি কর্মকর্তা কীভাবে এত বিপুল সম্পদের মালিক হলেন—এই প্রশ্নটাই এখন জোরদার হয়েছে? জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের উচ্চপর্যায়ে আসীন ব্যক্তি যখন দেশের রাজস্ব নিয়ে ভাবনার কথা ছিল, সেখানে আড়ালে তিনি কীভাবে নিজেদের জন্যেই ‘রাজস্ব আহরণ’ করে গেছেন এতদিন, এটা ইফাতের ছাগলকাণ্ড অনুষ্ঠিত না হলে জানা যেত না। ইফাতের খাসি এবং এর দামকে এখানে তাই যতই নেতিবাচকভাবে দেখা হোক না কেন, এই খাসি, দাম ও ইফাতের ভিডিও পথ দেখিয়েছে সেই ‘উচ্চকুলের’ সরকারি অফিসারের খোঁজ দিতে।

মতিউর রহমান নামের এই সরকারি কর্মকর্তা ইফাতের সঙ্গে তার সম্পর্ককে অস্বীকার করেছেন। তার স্বীকার-অস্বীকারে কিছু যায় আসে না। কারণ ইফাত কোন ফৌজদারি অপরাধী দোষী, এমনকি অভিযুক্তও নয়। পারিবারিকভাবে প্রাপ্ত বিপুল সম্পদ ভোগের নানা তরিকা তার বয়সের কারণেই। এই বয়সের কোন তরুণ যদি এত সম্পদ পায়, তবে নানাভাবে সে ব্যবহার করবেই। এখানে তাকে দোষী বলা যাবে না। হতে পারে, তার খরচের তরিকা অনিয়ন্ত্রিত কিংবা বেহিসাবি সে, তবে এটা যতক্ষণ না অন্যের ক্ষতির কারণ হয় ততক্ষণ সেটা অপরাধ নয়। গণমাধ্যমের খবরে জানা যাচ্ছে, সে প্রতিবছর খামারে-খামারে গিয়ে পশুর বুকিং আসলে সবগুলো নিতো না। এটা হতে পারে তার অনিয়ন্ত্রিত চলাফেরা ও বয়সের দোষ। এখানে কাউন্সেলিংয়ে সম্ভব এই দোষের সংশোধন।

পনের লাখ টাকা দাম দিয়ে খাসি কেনার ভিডিও করে ভাইরাল হয়ে মুশফিকুর রহমান ইফাত আদতে দেশের অনেক বড় উপকারই করেছেন। এরমাধ্যমে ‘উচ্চকুলের’ এক সরকারি কর্মচারীর দেখা পেয়েছে দেশ। দেশবাসী জানতে রাষ্ট্রের রাজস্ব আহরণের দায়িত্বে থাকা লোকজনের কেউ কেউ কীভাবে কোথায় নিয়ে গেছেন নিজেদের। ইফাতের খাসি তাই দুদককে বাধ্য করছে এনিয়ে উদ্যোগী হতে। সরকারকে বাধ্য করেছে এনবিআর থেকে ‘জনস্বার্থে’ মতিউর রহমানকে সরিয়ে দিতে। রোববার (২৩ জুন) অর্থ মন্ত্রণালয়ের উপসচিব মকিমা বেগম স্বাক্ষরিত এক প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট আপিলাত ট্রাইব্যুনালের প্রেসিডেন্ট মো. মতিউর রহমানকে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগে সংযুক্ত করা হয়েছে। জনস্বার্থে এই আদেশ অবিলম্বে কার্যকর হবে বলেও প্রজ্ঞাপনে উল্লেখ করা হয়েছে।

ইফাত ও ইফাতের খাসি তাই ক্ষতিকর কিছু নয়। বরং এটা দেশেরই উপকার করেছে বেশ। অনিয়ন্ত্রিত কিংবা বেহিসাবি খরচের বিষয়টা একপাশে সরিয়ে রেখে ইফাতকে তাই ধন্যবাদ দেওয়াই যায়। কারণ তার খাসি, দাম ও ভিডিও খুঁজে দিয়েছে এক সরকারি কর্মকর্তাকে, যিনি এতদিন প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী হয়ে সেই প্রজাতন্ত্রের বিরুদ্ধে কাজ করে গেছেন বিনা বাধায়, গোপনে।

;

সমাজ জীবনে আধুনিকতা ও প্রযুক্তির প্রভাব



মো. বজলুর রশিদ
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

সমাজ জীবনে আধুনিকতা এবং প্রযুক্তির প্রভাব বহুমুখী এবং গভীর। আধুনিকতা এবং প্রযুক্তির দ্রুত অগ্রগতি সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন এনেছে। এই পরিবর্তনগুলোর যেমন ইতিবাচক দিক রয়েছে, তেমনি কিছু নেতিবাচক দিকও রয়েছে।

আধুনিকতা ও প্রযুক্তির ইতিবাচক দিক
আধুনিকতা ও প্রযুক্তির প্রভাব সমাজে বহুবিধ ইতিবাচক পরিবর্তন এনেছে। এই পরিবর্তনগুলি আমাদের জীবনযাত্রাকে সহজ, কার্যকর এবং সুবিধাজনক করেছে। প্রথমত, যোগাযোগ ব্যবস্থা উল্লেখযোগ্যভাবে উন্নত হয়েছে। আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে আমরা এখন বিশ্বের যেকোনো প্রান্তে মুহূর্তের মধ্যে যোগাযোগ করতে পারি।

মোবাইল ফোন, ইমেইল, সামাজিকমাধ্যম এবং ভিডিওকলের মাধ্যমে মানুষ দূরত্বের বাধা অতিক্রম করে যোগাযোগ রক্ষা করতে পারছে। এটি ব্যক্তিগত এবং পেশাগত উভয় ক্ষেত্রেই সুবিধাজনক হয়েছে। ব্যবসা-বাণিজ্য, শিক্ষা এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজ হওয়ার ফলে কার্যক্রমের গতি বৃদ্ধি পেয়েছে।

দ্বিতীয়ত, শিক্ষাখাতে প্রযুক্তির ব্যবহার শিক্ষার মান ও পদ্ধতিতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছে। ই-লার্নিং প্ল্যাটফর্ম, অনলাইন কোর্স এবং ভার্চুয়াল ক্লাসরুমের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা সহজেই শিক্ষাগ্রহণ করতে পারছেন। গ্রামীণ এবং দূরবর্তী অঞ্চলের শিক্ষার্থীরাও উন্নত শিক্ষার সুযোগ পাচ্ছেন। এছাড়া, ইন্টারনেটের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন তথ্য ও জ্ঞান অর্জন করতে পারছেন, যা তাদের জ্ঞানভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করছে।

তৃতীয়ত, স্বাস্থ্যসেবায় প্রযুক্তির ব্যবহার মানুষের জীবনমান উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। আধুনিক চিকিৎসা প্রযুক্তি, টেলিমেডিসিন এবং অনলাইন স্বাস্থ্য পরামর্শের মাধ্যমে মানুষ ঘরে বসেই চিকিৎসা সেবা পাচ্ছেন।

রোগ নির্ণয় এবং চিকিৎসায় আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার মানুষের জীবন রক্ষা এবং রোগ প্রতিরোধে সহায়ক হচ্ছে। এছাড়া, স্বাস্থ্য সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য বিভিন্ন অনলাইন প্ল্যাটফর্ম এবং অ্যাপ ব্যবহার করা হচ্ছে, যা মানুষের স্বাস্থ্যগত জ্ঞান ও সচেতনতা বৃদ্ধি করছে।

চতুর্থত, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে প্রযুক্তির প্রভাব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ই-কমার্স এবং অনলাইন ব্যবসার মাধ্যমে ব্যবসায়ীরা তাদের পণ্য ও সেবা সহজেই গ্রাহকদের কাছে পৌঁছে দিতে পারছেন। ছোট ও মাঝারি ব্যবসাগুলি অনলাইনে কার্যক্রম পরিচালনা করে তাদের ব্যবসার পরিসর বাড়াতে পারছেন।

এছাড়া, ডিজিটাল পেমেন্ট সিস্টেম এবং মোবাইল ব্যাংকিং ব্যবহারের মাধ্যমে আর্থিক লেনদেন সহজ ও আরো নিরাপদ হয়েছে।

পঞ্চমত, কৃষিখাতে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার কৃষির উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি এবং খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সহায়ক হয়েছে। মেকানিক্যাল হাল, আধুনিক সেচ ব্যবস্থা, উচ্চ ফলনশীল বীজ এবং কৃষি তথ্য প্রযুক্তির মাধ্যমে কৃষকদের কাজ সহজ এবং কার্যকর হয়েছে। ফলশ্রুতিতে, কৃষিখাতে উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে এবং কৃষকের আয় বৃদ্ধি হয়েছে।

ষষ্ঠত, পরিবহন ও যাতায়াতে প্রযুক্তির ব্যবহার মানুষের জীবনে ব্যাপক সুবিধা নিয়ে এসেছে। আধুনিক যানবাহন, জিপিএস প্রযুক্তি এবং অনলাইন রাইড শেয়ারিং সার্ভিসের মাধ্যমে যাতায়াত সহজ ও সময় সাশ্রয়ী হয়েছে। এর ফলে, কর্মক্ষেত্রে যাওয়া আসা এবং ব্যক্তিগত যাতায়াত আরো সুবিধাজনক হয়েছে।

সপ্তমত, সামাজিকমাধ্যম এবং ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে মানুষের সৃজনশীলতা ও প্রতিভার বিকাশ ঘটেছে। মানুষ তাদের সৃজনশীল কাজ, শিল্প, সঙ্গীত, লেখালেখি ইত্যাদি সহজেই শেয়ার করতে পারছেন এবং বিশ্বব্যাপী পরিচিতি লাভ করছেন।

এছাড়া, সামাজিকমাধ্যমের মাধ্যমে মানুষ সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করতে পারছেন, যা সামাজিক বন্ধনকে আরো দৃঢ় করছে।

অষ্টমত, আধুনিক প্রযুক্তি ও গ্যাজেটের ব্যবহারে গৃহস্থালি কাজ সহজ হয়েছে। আধুনিক রান্নাঘর যন্ত্রপাতি, হোম অটোমেশন সিস্টেম, ক্লিনিং রোবট ইত্যাদি গৃহস্থালি কাজের সময় ও শ্রম সাশ্রয় করেছে। এর ফলে, মানুষ তাদের পরিবারের সঙ্গে আরো বেশি সময় কাটাতে পারছেন এবং জীবনযাত্রার মান উন্নত হচ্ছে।

নবমত, পরিবেশ সংরক্ষণ এবং টেকসই উন্নয়নে প্রযুক্তির ভূমিকা উল্লেখযোগ্য। নবায়নযোগ্য শক্তি, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা প্রযুক্তি, স্মার্ট সিটি প্রকল্প এবং পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে পরিবেশ সংরক্ষণ করা সম্ভব হচ্ছে। এতে প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ এবং পরিবেশ দূষণ কমানোর পাশাপাশি, টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা যাচ্ছে।

সবশেষে, সাইবার নিরাপত্তা এবং তথ্যের গোপনীয়তা রক্ষায় আধুনিক প্রযুক্তি কার্যকর ভূমিকা পালন করছে। উন্নত সাইবার নিরাপত্তা ব্যবস্থা, এনক্রিপশন প্রযুক্তি এবং তথ্য সুরক্ষা পদ্ধতি ব্যবহারের মাধ্যমে ব্যক্তিগত এবং সংবেদনশীল তথ্যের সুরক্ষা নিশ্চিত করা যাচ্ছে। এর ফলে, তথ্য চুরি, হ্যাকিং এবং সাইবার অপরাধের ঝুঁকি কমানো সম্ভব হচ্ছে।

সব মিলিয়ে, আধুনিকতা এবং প্রযুক্তির ইতিবাচক দিকগুলি সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন ও উন্নতি এনেছে। প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহার এবং এর সুবিধাগুলি গ্রহণের মাধ্যমে আমাদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন এবং সামাজিক অগ্রগতি সম্ভব হয়েছে। প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহারের মাধ্যমে সমাজের সার্বিক উন্নয়ন ও কল্যাণ নিশ্চিত করা সম্ভব, যা আমাদের ভবিষ্যতকে আরো সমৃদ্ধ ও উন্নত করতে সহায়ক হবে।

আধুনিকতা ও প্রযুক্তির নেতিবাচক দিক
তবে এটাও ঠিক যে, আধুনিকতা এবং প্রযুক্তির প্রভাবের ফলে কিছু নেতিবাচক দিকও পরিলক্ষিত হয়। আধুনিকতা এবং প্রযুক্তির প্রভাব সমাজে অনেক ইতিবাচক পরিবর্তন এনেছে, তবে এর কিছু নেতিবাচক দিকও আছে, যা আমাদের নজর এড়িয়ে যায় না। এই নেতিবাচক দিকগুলি সমাজ, সংস্কৃতি, পরিবার এবং ব্যক্তিগত জীবনে বিভিন্নভাবে প্রভাব ফেলছে।

প্রথমত, সামাজিক সম্পর্ক এবং ব্যক্তিগত যোগাযোগে প্রযুক্তির অতি ব্যবহার নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। সামাজিকমাধ্যম এবং ডিজিটাল যোগাযোগের ওপর নির্ভরতা বৃদ্ধির ফলে মানুষ মুখোমুখি যোগাযোগে কম সময় ব্যয় করছে। এর ফলে, পারিবারিক ও সামাজিক বন্ধন দুর্বল হচ্ছে। ব্যক্তিগত সম্পর্কের গভীরতা হ্রাস পাচ্ছে এবং মানুষ নিজেদের মধ্যে প্রকৃত সংযোগ হারাচ্ছে। শিশু এবং কিশোররা বেশি সময় ডিজিটাল ডিভাইসের সামনে ব্যয় করছে, যা তাদের সামাজিক এবং ব্যক্তিগত দক্ষতা হ্রাস করছে।

দ্বিতীয়ত, মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কিত সমস্যাগুলিও প্রযুক্তির অতিরিক্ত ব্যবহারের সঙ্গে সম্পর্কিত। সামাজিকমাধ্যমের অতিরিক্ত ব্যবহার উদ্বেগ, বিষণ্ণতা এবং আত্মসম্মানহীনতার কারণ হতে পারে। সামাজিকমাধ্যমে প্রদর্শিত সুখী জীবনযাত্রা এবং সাফল্যের ছবি দেখে মানুষ নিজেকে হীন মনে করতে পারেন। এছাড়া, ডিজিটাল আসক্তি এবং ইন্টারনেটের অতিরিক্ত ব্যবহারের ফলে ঘুমের সমস্যা, একাকীত্ব এবং মানসিক চাপ বাড়ছে।

তৃতীয়ত, প্রযুক্তির অতি নির্ভরতা কর্মজীবনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। অফিস বা কর্মস্থলে প্রযুক্তির ব্যবহার কর্মীদের দক্ষতা বৃদ্ধি করলেও এর মাধ্যমে কাজের চাপ এবং মানসিক চাপও বৃদ্ধি পাচ্ছে। কর্মক্ষেত্রে ইমেইল, মেসেজ এবং অনলাইন মিটিংয়ের অতিরিক্ত ব্যবহার ব্যক্তিগত জীবনের সময়কে কমিয়ে দিচ্ছে। ফলে কর্ম-জীবন ভারসাম্য বজায় রাখা কঠিন হয়ে যাচ্ছে।

চতুর্থত, গোপনীয়তা এবং নিরাপত্তা সংক্রান্ত উদ্বেগও প্রযুক্তির নেতিবাচক দিকগুলোর একটি। ডিজিটাল যুগে ব্যক্তিগত তথ্য সহজেই অনলাইনে শেয়ার হচ্ছে, যা গোপনীয়তা হানির ঝুঁকি বাড়াচ্ছে। সাইবার অপরাধ, তথ্য চুরি, হ্যাকিং এবং অনলাইন জালিয়াতির ঘটনাগুলি বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা সংক্রান্ত উদ্বেগ বৃদ্ধি করছে।

পঞ্চমত, প্রযুক্তির কারণে শারীরিক স্বাস্থ্যেরও ক্ষতি হচ্ছে। দীর্ঘ সময় কম্পিউটার বা মোবাইল ফোনের সামনে বসে থাকার ফলে চোখের সমস্যা, মাথাব্যথা, ঘাড় ও পিঠের ব্যথা, স্থূলতা এবং অন্যান্য শারীরিক সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে। বিশেষ করে শিশু এবং কিশোররা অল্প বয়সেই এই ধরনের সমস্যায় ভুগছে, যা তাদের ভবিষ্যত শারীরিক স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে।

ষষ্ঠত, প্রযুক্তির কারণে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য এবং মূল্যবোধেরও অবক্ষয় ঘটছে। প্রচলিত সংস্কৃতি, ঐতিহ্য এবং সামাজিক রীতিনীতি ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হচ্ছে এবং এর জায়গায় পশ্চিমা সংস্কৃতি এবং আধুনিক ধারার প্রবেশ ঘটছে। ফলে, স্থানীয় সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্য হারিয়ে যাওয়ার ঝুঁকি রয়েছে।

সপ্তমত, গ্রামীণ অর্থনীতির ওপরও প্রযুক্তির কিছু নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। প্রযুক্তির অগ্রগতির ফলে কৃষিতে মেশিনের ব্যবহার বৃদ্ধি পেয়েছে, যা কৃষকদের জীবিকা নির্বাহের প্রক্রিয়ায় প্রভাব ফেলছে। অনেক কৃষক তাদের পেশা পরিবর্তন করতে বাধ্য হচ্ছেন এবং তাদের আয় কমে যাচ্ছে। ফলে, গ্রামীণ অর্থনীতির স্থিতিশীলতা হ্রাস পাচ্ছে এবং বেকারত্ব বৃদ্ধি পাচ্ছে।

সবশেষে, প্রযুক্তির অতিরিক্ত ব্যবহারের ফলে শিক্ষার মান ও পদ্ধতি পরিবর্তিত হচ্ছে, যা অনেক ক্ষেত্রেই শিক্ষার্থীদের মৌলিক জ্ঞান ও দক্ষতা অর্জনে বাধা সৃষ্টি করছে। অনলাইন শিক্ষাব্যবস্থা সুবিধাজনক হলেও, শিক্ষার্থীদের সরাসরি শিক্ষকের সঙ্গে যোগাযোগ এবং শিক্ষার সামাজিক পরিবেশ থেকে বঞ্চিত করছে। এছাড়া, ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে সহজলভ্য তথ্যের প্রাচুর্য শিক্ষার্থীদের মধ্যে তথ্যের মান যাচাই করার ক্ষমতা হ্রাস করছে এবং গভীর চিন্তাশক্তির বিকাশে বাধা সৃষ্টি করছে।

আধুনিকতা এবং প্রযুক্তির নেতিবাচক দিকগুলি সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলছে। যদিও প্রযুক্তির অগ্রগতি আমাদের জীবনকে সহজ এবং সুবিধাজনক করেছে, তবে এর নেতিবাচক দিকগুলি মোকাবিলা করতে সচেতনতা এবং সঠিক ব্যবস্থাপনা প্রয়োজন।

সমাজের সার্বিক উন্নয়নের জন্য প্রযুক্তির সুবিধাগুলি গ্রহণের পাশাপাশি এর নেতিবাচক প্রভাবগুলি মোকাবিলায় আমাদের আরো সচেতন হতে হবে এবং প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, তেজগাঁও কলেজ, ঢাকা।

;

রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশের নাগরিকত্ব নেয়ার সুযোগ দেয়া যাবে না



ব্রিঃ জেঃ হাসান মোঃ শামসুদ্দীন (অবঃ)
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

মিয়ানমার সৃষ্ট চলমান রোহিঙ্গা সংকট যতই দিন যাচ্ছে ততই বাংলাদেশের জন্য একটার পর একটা সমস্যা সৃষ্টি করে চলছে। ক্যাম্পের চলমান অপরাধ কার্যক্রম, মানব পাচার, মাদক ও অস্ত্র চোরাচালান, হত্যা, ও অন্যান্য নানা ধরনের সমস্যা সৃষ্টি করে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশের সামাজিক, পরিবেশ এবং নিরাপত্তা হুমকির সৃষ্টি করছে। এর সঙ্গে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশের নাগরিকত্ব নেয়ার প্রবণতা এবং এ দেশীয় এক শ্রেণির দেশের স্বার্থ বিরোধী, অসাধু মানুষের যোগসাজসে রোহিঙ্গারা দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের ভোটার তালিকায় যুক্ত হচ্ছে। তারা বাংলাদেশের পাসপোর্ট নিয়ে বিদেশেও চলে যাচ্ছে যা আশঙ্কাজনক।

কক্সবাজারের ক্যাম্পগুলোর নিবন্ধিত রোহিঙ্গারা বিভিন্ন উপায়ে বাংলাদেশের ভোটার হচ্ছে এবং জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) পেয়ে যাচ্ছে। রোহিঙ্গারা যাতে ভোটার হতে না পারে সে জন্য নির্বাচন কমিশনের (ইসি) পক্ষ থেকে সতর্কতামুলক ব্যবস্থা নিতে বলা হলেও তা উপেক্ষা করে এই প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। বিষয়টি নিয়ে ইসি’ও এখন উদ্বিগ্ন। রোহিঙ্গারা চট্টগ্রাম অঞ্চল ছাড়াও দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে এই পরিচয়পত্র সংগ্রহ করছে। মিয়ানমারে অত্যাচারের শিকার এই রোহিঙ্গারা দীর্ঘ দিন ধরে বাংলাদেশে অবস্থান করছে এবং তাদের দেশে ফিরে যাওয়ার বিষয়ে তারা কোনো আশার আলো দেখছে না বিধায় অনেকে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব নিয়ে স্থানীয়দের সঙ্গে মিশে যাওয়ার চেষ্টা করছে। অনেকে বিদেশে যাওয়ার জন্য সুযোগ পেলেই বাংলাদেশের পাসপোর্ট নিয়ে বিদেশ চলে যাচ্ছে। এই প্রক্রিয়া বন্ধ করতে হলে স্থানীয় জনগণ এবং সমাজের সকল স্তরে দেশপ্রেম ও সচেতনতা বাড়ানো ছাড়া কোনো বিকল্প নেই।

রোহিঙ্গাদেরকে কারা, কেন, কীভাবে এই এনআইডি সরবরাহ করছে সেটা খুঁজে বের করতে তদন্ত শুরু করেছে ইসি। রোহিঙ্গাদেরকে ভোটার হতে কেউ না কেউ সহযোগিতা করছে কারণ এই প্রক্রিয়ায় সম্পন্ন করতে তারা অনলাইনে জন্মসনদ এবং চেয়ারম্যান-কাউন্সিলর থেকে নাগরিক সনদ পাচ্ছে, সে বিষয়েও তদন্ত করা জরুরি। প্রাপ্ত তথ্য থেকে জানা যায় যে, এক শ্রেণির অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং কিছু প্রভাবশালী জনপ্রতিনিধির যোগসাজশে একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেটের মাধ্যমে রোহিঙ্গারা ভোটার হচ্ছে। সিন্ডিকেটটি রোহিঙ্গাদের জন্য ভোটার হতে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র তৈরির ব্যবস্থা করে। ইসির পক্ষ থেকে চট্টগ্রামের বিশেষ ৩২ এলাকা ছাড়াও সারাদেশে রোহিঙ্গাদের ভোটার না করার ব্যাপারের কঠোর নজরদারির নির্দেশ দেয়া হয়। রোহিঙ্গারা নির্দেশনার বাইরের এলাকা থেকে বাংলাদেশি পরিচয়ে এখন ভোটার হচ্ছে, এতে তাদেরকে শনাক্ত করা কঠিন হয়ে যাচ্ছে। রোহিঙ্গাদের ভোটার করতে এক থেকে দেড় লাখ টাকার লেনদেন হচ্ছে বলে জানা যায়। এই কাজে জড়িতরা রোহিঙ্গাদের এই অবৈধ সুযোগ দিয়ে প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে যা উদ্বেগজনক।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এসব ঘটনায় জড়িত অপরাধী ব্যক্তিদেরকে গ্রেফতার করে বিচারের আওতায় নিয়ে আসছে। ইসি ভোটার তালিকা প্রথমবারে হালনাগাদের সময় সীমান্তবর্তী বিভিন্ন উপজেলার ৫০ হাজার রোহিঙ্গা ভোটার শনাক্ত হয়। উপযুক্ত তথ্যপ্রমাণের পর ৪২ হাজার রোহিঙ্গা ভোটারের নিবন্ধন বাতিল করা হয়। রোহিঙ্গারা যাতে ভোটার হতে না পারে সে বিষয়ে সতর্কতা জারি করার পাশাপাশি রোহিঙ্গা শনাক্ত করতে এখন দুটি ডাটাবেজ ব্যবহার করা হচ্ছে। যারাই নতুন ভোটার হচ্ছে তারা রোহিঙ্গা কি না তা শনাক্ত করতে ১১ লাখ ২২ হাজার নিবন্ধিত রোহিঙ্গাদের ডাটা চেক করে সেখানে রোহিঙ্গা হিসাবে নো ম্যাচিং আসার পর ইসির ডাটাবেজ চেক করে নো ম্যাচিং আসলেই নতুন ভোটার হিসাবে কেন্দ্রীয় সার্ভারে অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে।

২০২৩ সালের ২৭ আগস্ট রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে জন্মনিবন্ধন, ভোটার আইডি ও পাসপোর্ট করতে সহযোগিতা করায় একটি মামলার চার্জশিট অনুমোদন দিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। বাংলাদেশ সরকার, ‘জন্মসদন, এনআইডি ও পাসপোর্ট করতে রোহিঙ্গাদের যারা সহায়তা করছে তাদেরকে আইনের আওতায় আনার নির্দেশ দিয়েছে এবং ইতিমধ্যে যারা এগুলো সংগ্রহ করেছে তা বাতিল করারও নির্দেশ দিয়েছে। রোহিঙ্গারা যেভাবে এই দেশের নাগরিক হয়ে যাচ্ছে তাতে স্থানীয়রা আতঙ্কিত। রোহিঙ্গাদেরকে বাংলাদেশি পাসপোর্ট তৈরিতে সহায়তা করছে স্থানীয় কিছু মানুষ এবং রোহিঙ্গা দালালদের সিন্ডিকেট। এরা অর্থের বিনিময়ে রোহিঙ্গাদের প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সরবরাহ করে। ওই সিন্ডিকেটের শক্তিশালী এবং ক্ষমতাবান নেটওয়ার্ক থাকায় পুলিশি যাচাই-বাছাইকরণসহ অন্যান্য প্রক্রিয়ায় এসব অনিয়ম শনাক্ত করা কঠিন।

১৯৭৫ সালের পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ থেকে রোহিঙ্গাদের একটি অংশকে নিতে রাজি হয়েছিল সৌদি সরকার। বাংলাদেশ থেকে বেশ কিছু রোহিঙ্গা তখন বাংলাদেশের পাসপোর্ট নিয়ে সৌদি আরব যায়। বাংলাদেশের পাসপোর্টে সৌদি আরবে থাকা ৬৯ হাজার রোহিঙ্গার একটি তালিকা তৈরি করেছে দেশটি। তাদের পাসপোর্টের মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ায় সৌদি সরকার বাংলাদেশকে রোহিঙ্গাদের পাসপোর্ট নবায়ন করার জন্য জানায়। বাংলাদেশ সরকার সৌদি আরবে থাকা ওই ৬৯ হাজার রোহিঙ্গার পাসপোর্ট নবায়নের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সারা দেশে কত রোহিঙ্গাকে ভোটার করা হয়েছে তদন্ত করে তার তালিকা দাখিলের নির্দেশ দিয়েছে হাইকোর্ট। ৮ আগস্টের মধ্যে এ তালিকা দাখিলের জন্য নির্বাচন কমিশন, স্থানীয় সরকার সচিব, কক্সবাজারের ডিসিসহ সংশ্লিষ্টদের এ নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। রোহিঙ্গাদেরকে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব প্রদান প্রক্রিয়ার সঙ্গে স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের কয়েকজন জনপ্রতিনিধির সম্পৃক্ততার তথ্য পাওয়ার পর তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করা হয়।

রোহিঙ্গাদের নিবন্ধন নিশ্চিত করার পাশাপাশি নিয়মিত মনিটরিং এবং হালনাগাদ গুরুত্বপূর্ণ, এটি একটি চলমান প্রক্রিয়া এবং রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে প্রত্যাবাসনের পূর্ব পর্যন্ত এটা চালিয়ে যেতে হবে। রোহিঙ্গাদেরকে নিজ দেশে ফেরার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকতে হবে। স্থানীয় জনগোষ্ঠীর সঙ্গে রোহিঙ্গারা মিশে গেলে বড় ধরনের সমস্যা দেখা দিবে এবং তা কখনো কাম্য নয়। স্থানীয় কর্মকর্তাদের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর মতে, রোহিঙ্গাদের নিবন্ধন এবং তাদের সংখ্যা হালনাগাদ রাখা তাদের অধিকার নিশ্চিত করার জন্য গুরুত্বপূর্ণ।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষা ও প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ার সুবিধার্থে প্রশাসন বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে রোহিঙ্গাদের পরিচয় নিশ্চিত করে। এই চলমান প্রক্রিয়া রোহিঙ্গাদের অধিকার নিশ্চিত করার প্রথম পদক্ষেপ এবং এই রেজিস্ট্রেশন কার্ডের মাধ্যমে তাদের থাকা-খাওয়ার নিশ্চয়তা দেওয়া হচ্ছে। বর্তমানে রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে প্রতিদিন গড়ে ১০০ শিশু জন্মগ্রহণ করছে। ইউ এন এইচ সি আরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী বর্তমানে দুই লাখের বেশি পরিবারের ৯ লাখ ৭৯ হাজার ৩০৬ জন রোহিঙ্গা কক্সবাজারের ক্যাম্পগুলোতে বসবাস করছে। মাঠকর্মীরা নিয়মিত বাড়িতে গিয়ে রেকর্ড হালনাগাদ রাখে এবং রোহিঙ্গা পরিবারগুলোও প্রয়োজন অনুযায়ী তাদের পরিবারের সদস্য নিবন্ধন হালনাগাদ করে। বিশাল এই জনগোষ্ঠীকে সহায়তা দিতে ধারাবাহিক নিবন্ধন এবং তা হালনাগাদ করা অপরিহার্য।

রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব বিষয়ক অনিয়ম নিয়ন্ত্রণ করতে প্রশাসনের সব স্তরে এ বিষয়ে সচেতনতা ও জবাবদিহিতার ব্যবস্থা থাকলে বিষয়টি নিয়ন্ত্রণে থাকবে। রোহিঙ্গাদের ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা এবং তাদের পাসপোর্ট তৈরিতে সহায়তাকারী সিন্ডিকেট চিহ্নিত করে কঠোর আইনি পদক্ষেপ নিতে হবে। হাইকোর্টের এই উদ্যোগে এই অনিয়মের সঙ্গে জড়িতরা সতর্ক হবে। রোহিঙ্গাদের সাধারণ জনগণের সঙ্গে মিশে যাওয়ার ঝুঁকি এড়াতে একটা ডাটাবেজের মাধ্যমে হালনাগাদ নিশ্চিত করতে হবে। অনেক স্থানীয় ব্যক্তি রোহিঙ্গাদেরকে চোরাচালানের কাজে ব্যবহার করছে, একাজে যারা জড়িত তাদেরকে চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনতে হবে। বাংলাদেশ সরকার তাদেরকে আইনের আওতায় আনার উদ্যোগ নিচ্ছে। অনেক রোহিঙ্গা বাংলাদেশের ক্যাম্পগুলোতে বিলাসী জীবন যাপন করছে। তারা মিয়ানমারে ফিরে যেতে চাইবে না। রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফিরে যাবার জন্য প্রেষণা চলমান রাখতে হবে। জাতিসংঘ, সাহায্য সংস্থা ও এন জি ও গুলোকে এ ব্যাপারে উদ্যোগী হতে হবে।

বাংলাদেশ একটা জনবহুল দেশ, মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদেরকে মানবিক বিবেচনায় বাংলাদেশ আশ্রয় দিয়েছে। বাংলাদেশের পক্ষে অনির্দিষ্টকাল এই সংকট টেনে নেয়া সম্ভব না। রোহিঙ্গা সংকট দীর্ঘায়িত হওয়ার কারনে ও প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু না হওয়ায় সৃষ্ট সমস্যা যেন বাংলাদেশের জন্য বোঝা না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। রোহিঙ্গারা যাতে বাংলাদেশে জনস্রোতে মিশে যেতে না পারে সে বিষয়ে বাংলাদেশের নাগরিক, জনপ্রতিনিধি, বিভিন্ন পর্যায়ের সরকারী কর্মকর্তা ও কর্মচারীকে একজন সচেতন দেশপ্রেমিকের দায়িত্ব পালন করতে হবে। রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে প্রত্যাবাসনই এই সংকটের একমাত্র সমাধান বিধায় রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে নিয়োজিত সংশ্লিষ্ট সবাইকে আন্তরিকতার সঙ্গে দ্রুত প্রত্যাবাসনের জন্য কার্যকরী ব্যবস্থা নিতে হবে।

ব্রিঃ জেঃ হাসান মোঃ শামসুদ্দীন, এন ডি সি, এ এফ ডব্লিউ সি, পি এস সি, এম ফিল (অবঃ)
মিয়ানমার ও রোহিঙ্গা বিষয়ক গবেষক

;

আওয়ামীলীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী: কর্মীর চোখে প্রাপ্তি ও প্রত্যাশা



অধ্যাপক ড. উত্তম কুমার বড়ুয়া
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

নম্বইয়ের দশকের শুরুতে এসএসসি পাশ করে চট্রগ্রামের হাজী মুহম্মদ মহসিন কলেজে ভর্তি হই। স্কুল জীবনে ছাত্রলীগের বড় ভাইয়েরা বাংলাদেশ ছাত্রলীগের স্কুল কমিটির আহ্বায়ক বানিয়ে দিলেও ছাত্রলীগের অনেক কিছুই বুঝতাম না। কলেজে এসে ছাত্রলীগের আদর্শ, উদ্দেশ্য, করণীয়, দুই ভাগ সবই বুঝতে পারি। ১৯৭১ সালে আমাদের রাউজানের আবুরখিল গ্রাম ছিলো মুক্তিযোদ্ধাদের ঘাঁটি, আমার বাড়িতে মুক্তিযোদ্ধারা দলে দলে আসতেন এবং থাকতেন। আমার ছোটোবেলায় মুক্তিযোদ্ধা আঙ্কেলদের দেখতে খুব ভাল লাগতো, আমাকেও তাঁরা খুব স্নেহ করতেন। তাদের হাতে রাইফেল, বুলেট, গ্রেনেড, উঠানে আমার অনুরোধে ফাঁকা গুলি ছোড়া, খোসা কুড়ানো-সবই ছোটবেলায় ভালো লাগা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার এক শক্তি, সাহস, প্রশিক্ষণ, রাজনীতির শিশুমনে বীজ বপণও বটে।

কলেজে দুই ভাগ, জালাল-জাহাঙ্গীর এবং ফজলু-চুন্নু, আমাদের জালাল-জাহাঙ্গীর গ্রুপের চেয়েও ফজলু-চুন্নু গ্রুপটি বড় ছিলো, তবে নেতৃবৃন্দের মধ্যে সখ্যতা ছিলো। পরবর্তীতে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজে অধ্যয়ন করতে এসে ছাত্রলীগ আমাকে বা আমাদের খুঁজে বের করেননি, বরং আমি ও আমার গ্রুপ নিয়ে নেতাদের রুম খুঁজে বের করলাম, বাংলাদেশ ছাত্রলীগে যোগদানের কথা ব্যক্ত করলাম। এখানেও বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সদস্য সংখ্যা অনেক কম ছিলো, বরং জাতীয় ছাত্রলীগ শক্তিশালী সংগঠন ছিলো। এভাবে ময়মনসিংহ মেডিকেল ও ময়মনসিংহ জেলায় আমার ছাত্রলীগের মাধ্যমে ছাত্র রাজনীতিতে সক্রিয় অংশগ্রহণ ও নেতৃত্ব দেবার সুযোগ সৃষ্টি হয়।

তখন এরশাদ আমল, ছাত্রসংসদ নির্বাচন হয় না, ছাত্ররাজনীতি যেন নিষিদ্ধ, স্বৈরাচারের রক্তচক্ষু ছাত্রদের দিকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নেতাদের নির্বিচারে হত্যা, গাড়ি চাপা দেয়া সবই আমাদের জানা। “ছাত্র সমাজ নামক সন্ত্রাসী ছাত্রদের আমাদের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দিয়েছিল। রুমি নামক একজন স্থানীয় মেডিকেল ছাত্রকে ছাত্র সমাজের দায়িত্ব দেয়া হল। তার সাথে তৎকালীন ময়মনসিংহের সকল খুনি, ডাকাত, সন্ত্রাসীদের সখ্যতা ছিলো। তাদের দিয়ে প্রায়শঃ আমাদের ওপর নির্যাতন, মারামারি, হত্যার হুমকি দেয়া হতো।

একদিকে পুলিশের নির্যাতন ও ছাত্রসমাজের ভয়ভীতি প্রদর্শন, সংঘর্ষ এবং অন্যদিকে ছাত্রদলের সঙ্গে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ। আমাদের ক্যাম্পাসে যেন ত্রিমুখী লড়াই ছিলো, প্রতি মাসেই মারামারি হতো। ছাত্রদলের সাথে সংঘর্ষ হতো, মামলা মোকাদ্দমা হতো এবং এমনকি ছাত্রলীগের সহকারী সাধারণ সম্পাদক রাইসুল হাসান নোমানকে পরীক্ষা হলে শিক্ষকের সামনে ছাত্রদলের সন্ত্রাসীরা কুপিয়ে হত্যা করে। এরকম এক বৈরি সময়ে ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দুই মেয়াদে দায়িত্ব পালন করি। নেতৃত্ব দিই ছাত্র সংসদের ভিপি নির্বাচন ও জেলা ছাত্রলীগের, 

ছাত্রজীবন মানে অদম্য সাহস, যার পিছুটান থাকে না, ছাত্রাবাসে থাকি, পিতা-মাতা কিংবা অভিভাবক বলতে কেউ নেই। সম্পূর্ণ স্বাধীন একসত্ত্বা, দুরন্তপনা, বাংলাদেশ ছাত্রলীগের আদর্শ-উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে দাঁড়ি, কমা ও সেমিকোলন মেনে চলাই ছিলো তখনকার ছাত্র রাজনীতির নিয়ম। তখনকার আশি-নব্বই দশকের তুলনামূলক খাঁটি রাজনীতি দেখার সুযোগ হয়েছে আমার। অর্থের কোনো সংযোগ ছিলো না, এমনকি ক্ষমতার কথাও ছিল না ছাত্র রাজনীতির ভাবনায়।

১৯৭৫-এর পর এমনিতেই ঘড়ির কাটা উল্টো দিকে ঘুরছে, পাকিস্তানী লিগ্যাসি তখনকার নষ্ট রাজনীতিকে গ্রাস করেছে। স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি, সুযোগ সন্ধানী রাজনীতি, বঙ্গবন্ধুর খুনিদের ক্ষমতা দখল, ক্ষমতার হাতবদল, রাজনীতিতে অপশক্তির দাপট এবং বাংলাদেশ আওয়ামীলীগের দ্বিধাবিভক্ত নেতৃত্ব আমাদের আত্মবিশ্বাসকে আরো দুর্বল করে তুলেছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন আমাদের আদর্শের বরপুত্র। বঙ্গবন্ধুকে হারিয়ে এই জাতি, এই দেশ যেন দিশেহারা, আমরাও হলাম অভিভাবকশূন্য।

টুঙ্গীপাড়ার তরুণ শেখ মুজিব কিভাবে মুজিব ভাই হলেন, বঙ্গবন্ধু হলেন, জাতির পিতা হলেন সবই প্রাঞ্জল ভাষায় বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী ও কারাগারের রোজনামচায় সুন্দরভাবে লিপিবদ্ধ আছে। ১৯৪২ সালে এন্ট্রান্স পাশ করে তরুণ শেখ মুজিব কলকাতার ইসলামিয়া কলেজে ভর্তি হয়েই ছাত্র রাজনীতি ও পরবর্তীতে তখনকার ভারতীয় রাজনীতিতে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত হলেন। ভারতের সেই সময়ের জাতীয় নেতা মাহাত্মা গান্ধী, নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু, জওহরলাল নেহেরু, মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ, শেরে বাংলা, শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মওলানা আকরাম খাঁ, খাজা নাজিমুদ্দিন, আবুল হাশিম সহ সকল নেতাদের সংস্পর্শে এসে শেখ মুজিবের রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করার সুযোগ হয়েছিল।

এভাবেই ১৯৪২ থেকে ১৯৪৭ পর্যন্ত ছাত্রলীগের রাজনীতি ও গ্রগতিশীল ধারার মুসলিম লীগের সাথে শেখ মুজিবুর রহমান অবিভক্ত ভারতের রাজনীতিতে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর আদর্শে অনুপ্রাণিত ছিলেন এবং নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর ব্রিটিশ বিরোধী বিপ্লবী আন্দোলনকেও ধারণ করতেন।

১৯৪৭ পরবর্তী পূর্ব বাংলার রাজনীতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ঘিরেই আবর্তিত হয়েছে। ১৯৪৮ সালে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠা, ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠা, বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে “মুসলিম” শব্দ বাদ দিয়ে অসাম্প্রদায়িক চেতনার বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠা করেন। শেখ মুজিবুর রহমান আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠাতা যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, পরবর্তীতে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক ও সভাপতি হবার পর বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলনের ইতিহাস আর পিছনে তাকায় নাই। বাঙালি জাতির ওপর পাকিস্তানী শাসকদের একচোখা নীতি, শাসন-শোষণ, নির্যাতন, সংস্কৃতিতে আগ্রাসন, ভাষার ওপর আঘাত, অর্থনৈতিক বৈষম্য, বিমাতাসুলভ আচরণ, বাঙালির অধিকার ক্ষুন্ন যেন ব্রিটিশ বেনিয়াদের প্রতিচ্ছবি।

শেখ মুজিব এগিয়ে এলেন, তিনি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের শক্ত হাতে হাল ধরলেন। ১৯৪৯ থেকে আওয়ামী মুসলিম লীগ বা বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের যাত্রা শুরু হলেও বেশ কয়েকবার নেতৃত্বের মতদ্বৈততা ও দলকে ভাঙনের মুখে পড়তে হয়েছে যা আমাদের সকলের জানা আছে। ১৯৫৫ সালে দলের নামে “মুসলিম” শব্দ বাদ দেয়া নিয়ে ১৯৫৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সিয়াটো চুক্তি এবং সেন্টো সামরিক জোটের যুক্ত হওয়া নিয়ে মতদ্বৈততা, আওয়ামী লীগের কাগমারী সম্মেলনে এই প্রস্তাবে ভোটাভুটিতে ভাসানী সাহেবের হেরে যাওয়া, নতুন দল ন্যাপ গঠন করা, ১৯৬৬ সালে ছয় দফা নিয়ে বিরোধিতায় সভাপতি তর্কবাগিশ সাহেবের দল থেকে বেরিয়ে যাওয়া এসব নিয়ে আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠার পর থেকে হোঁচট খেয়েছে।

১৯৬৪ সালে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুর পর বঙ্গবন্ধুর মাথার ওপর আর কোনো হাত অবশিষ্ট রইল না। ১৯৬৬ সালে আবারো ঐতিহাসিক ইডেন গার্ডেনে কাউন্সিল অধিবেশনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সভাপতি এবং তাজউদ্দীন আহমেদ সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হলেন। মওলানা ভাসানীর নতুন দল গঠন, শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যু, আবদুর রশিদ তর্কবাগীশের দলত্যাগ, শেরে বাংলার নীরবতার রাজনীতিতে কেউ শেষ পর্যন্ত বাঙালির মুক্তি ও স্বাধিকারের প্রশ্নে অবিচল থাকতে পারেননি। বাঙালির মুক্তির একমাত্র আস্থা ও ঠিকানায় পরিণত হলো অবিচল শেখ মুজিবুর রহমান।

বায়ান্ন’র ভাষা আন্দোলন, চুয়ান্নোর যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন ও আইয়ুব শাসন বিরোধী আন্দোলন, চৌষট্টির সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় শান্তি ও সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠা, ছেষট্টির ছয় দফা, ঊনসত্তরের গণঅভ্যূত্থান, সত্তরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন, একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতৃত্বের কেন্দ্রবিন্দু ছিলেন রাজনীতির মহাকবি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তার এই দীর্ঘ সংগ্রামে ওতপ্রোতভাবে যুক্ত ছিলো স্বর্ণালী গৌরবের বাংলাদেশ ছাত্রলীগ ও বাংলার সাড়ে সাত কোটি বাঙালি।

এই ঐতিহ্যবাহী সংগঠনের নেতৃত্বে ১৯৪৯ থেকে ১৯৭৫ পর্যন্ত দীর্ঘ ২৬ বছর যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, সাধারণ সম্পাদক ও সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধু সাড়ে সাত কোটি বাঙালিকে সাথে নিয়ে, নয় মাসের মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে, ত্রিশ লক্ষ শহীদের রক্ত ও তিন লক্ষ মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে, নিজের ফাঁসির রজ্জু হাতে নিয়ে “বাংলাদেশ” নামক স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেন।

“বঙ্গবন্ধু” মানে বাংলাদেশ আর বাংলাদেশ আওয়ামীলীগ, “জয় বাংলা ও জয় বঙ্গবন্ধু” স্লোগান তার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। গৌরব ও অহংকারের সংগঠন বাংলাদেশ আওয়ামীলীগ, যে সংগঠন একটি স্বাধীন দেশ দিল, জয় বাংলা স্লোগান দিলো, একটা পতাকা দিলো, জাতীয় সংগীত দিলো, একজন জাতির পিতা বিশ্বনেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দিলো ও বিশ্ব মানবতার নেত্রী বঙ্গকন্যা শেখ হাসিনাকে দিলো, ধন্য ধন্য সেই সংগঠন।

১৯৭৫ সালের জাতির পিতা, বঙ্গমাতা ও শিশু রাসেলসহ পরিবারের সকল সদস্যদের ইতিহাসের জঘন্যতম হত্যাকাণ্ডের পর বঙ্গবন্ধুর হাতে গড়া দেশ চরম বিপর্যয়ের মুখোমুখি হলো। ক্ষমতালোভীরা ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে হত্যা করে ক্ষমতার ভাগাভাগি করে পবিত্র সংবিধানকে ও সংবিধানের মূল আদর্শিক কাঠামোকে এক এক করে ধ্বংস করা হলো। স্বাধীনতার সকল মূল্যবোধ বিসর্জন দিয়ে পাকিস্তানি ধারার সাম্প্রদায়িক রাজনীতি প্রতিষ্ঠা করলো। বাঙালির অমানিশা, ঘোর অন্ধকার, আওয়ামী লীগের ঘরের মধ্যে ঘর, দলে ভাঙ্গন, মীর জাফরদের দল থেকে পলায়নের ফলে এদেশের মানুষকে সঠিক পথ দেখানোর নেতৃত্ব আর থাকল না।

এই পর্যায়ে ১৯৭৬ সালে দলের ভারপ্রাপ্ত সভাপতির দায়িত্ব নেন মহিউদ্দীন আহমেদ এবং ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব নেন বেগম সাজেদা চৌধুরি। ১৯৭৭ সালে সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীন দলের আহবায়ক নির্বাচিত হন। ১৯৭৮ সালে দলের হাল ধরেন সভাপতি আবদুল মালেক উকিল, সাধারণ সম্পাদক হন আবদুর রাজ্জাক। ১৯৭৮ সালে মিজানুর রহমান চৌধুরীর নেতৃত্বে পাল্টা আওয়ামী লীগ গঠিত হয়। এমতাবস্থায় আওয়ামী লীগ দিশেহারা, অবশেষে ১৯৮১ সালে সেই ঐতিহাসিক ইডেন গার্ডেনে আওয়ামীলীগের কাউন্সিল অধিবেশনে শেখ হাসিনার অনুপস্থিতে সর্বসম্মতভাবে বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ কন্যা শেখ হাসিনাকে সভানেত্রী হিসেবে নির্বাচিত করে।

১৯৮১ সালের ১৭ মে ঝড়-বৃষ্টি, দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ায় দিল্লি থেকে কলকাতা হয়ে কুর্মিটোলা বিমানবন্দরে লাখো লাখো মানুষের ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে বঙ্গবন্ধুর মতো শেখ হাসিনা স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করেন। তিনি মহাকবির মতো উচ্চারণ করলেন, “বাংলার মানুষের পাশে থেকে মুক্তির সংগ্রামে অংশ নেয়ার জন্য আমি দেশে এসেছি, আমি আওয়ামী লীগের হওয়ার জন্য আসিনি। সবকিছু হারিয়ে আমি আপনাদের মাঝে এসেছি। পিতা-মাতা, ভাই রাসেলসহ সকলকে হারিয়ে আমি আপনাদের কাছে এসেছি। আমি আপনাদের মাঝেই তাদের ফিরে পেতে চাই।”

শুরু হয় দীর্ঘ সংগ্রামের পথ। ষড়যন্ত্রকারী এক জেনারেলের বদলে আরেক জেনারেল ক্ষমতায় এলেন। দল গঠনের কাজে তিনি হাত দিলেন। শুরু হলো স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন, দলের ভিতরে-বাইরে সমস্যা। ১৯৮৩ সালে আবদুর রাজ্জাকের বাকশাল গঠন ও ১৯৯১ সালে আবার আওয়ামী লীগে যোগদান, ডক্টর কামাল হোসেনের নেতৃত্বে আরেক দফা ভাঙনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ আবারো চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়। স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে জেল-জুলুম, গৃহবন্দী, ছাত্র সমাজ গঠন, হত্যা, নির্যাতন, শেখ হাসিনাকে লাল দীঘির ময়দানে গুলি বর্ষণ ও হত্যাচেষ্টা, অবশেষে স্বৈরাচারের পতন, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা, জাতীয় নির্বাচন, সূক্ষ্ম কারচুপির মাধ্যমে আওয়ামী লীগের পরাজয়, বিএনপি’র সরকার গঠন।

১৯৮১ থেকে ১৯৯০ পর্যন্ত শেখ হাসিনার দল আওয়ামী লীগের আপোষহীন নেতৃত্বের মাধ্যমে স্বৈরাচার মুক্ত বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করেন। সভানেত্রী হিসেবে শেখ হাসিনা নেতৃত্বে বিভিন্ন পর্যায়ে পর্যায়ক্রমে সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন আবদুর রাজ্জাক, বেগম সাজেদা চৌধুরী, জিল্লুর রহমান, আবদুল জলিল, সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম, বর্তমানে ওবায়দুল কাদের। তিনি কখনো স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন, কখনো ভোট ও ভাতের অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন, কখনো বিরোধীদলীয় নেতা হিসেবে দায়িত্ব পালন, কখনো মাইনাস টু ফর্মূলার গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের আন্দোলন করেন।

১৯৭১-এর পরাজিত শক্তিরা, মীর জাফররা বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে ১৯৭৫ সালের ১৫ ই আগষ্ট নির্মমভাবে হত্যা করে। ১৯৭৫-এ বেঁচে যাওয়া বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানাকেও বারবার হত্যার পরিকল্পনা করেছে সেই একই শক্তি ও শক্তির প্রেতাত্মারা। বাংলাদেশকে ধ্বংসের হাত থেকে বাংলাদেশ আওয়ামীলীগের নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা রক্ষা করেছেন।

তিনি স্বৈরাচারের পতন ঘটিয়েছেন, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছেন, এক-এগারো সরকারের পতন ঘটিয়েছেন, সাম্প্রদায়িক মৌলবাদী শক্তির দাত উপড়ে ফেলেছেন, বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার করেছেন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করেছেন, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করেছেন। তাই শেখ হাসিনাকে এ পর্যন্ত ২২ বার হত্যার প্রচেষ্টা করা হয়েছে এবং এই হত্যাচেষ্টা এখনো অব্যাহত রয়েছে। তারা মনে করে শেখ হাসিনাকে হত্যা করতে পারলে স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের শক্তিকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়া যাবে।

পাকিস্তানের ২৪ বছর, জিয়া-খালেদা-এরশাদের ৩১ বছর মিলিয়ে মোট ৫৫ বছর পূর্ব বাংলা ও বাংলাদেশে পাকিস্তাকি কায়দায় দেশ পরিচালিত হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ২৬ বছর বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ একটি স্বাধীন দেশ বাঙালিকে উপহার দিয়েছে। তারই জ্যেষ্ঠ কন্যা শেখ হাসিনা ১৯৮১ থেকে ২০২৪ পর্যন্ত টানা ৪৩ বছর নেতৃত্ব ও সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বার বার গণতন্ত্র ও রাজনীতি রক্ষা করেছেন।

তিনি আন্তর্জাতিক আদালতের মাধ্যমে এক লাখ ৩১ হাজার ৯৮ বর্গকিলোমিটার সমুদ্র বিজয়, ৫৫ বছরের ছিটমহল সমস্যার সমাধান করে ১১১ টি ছিটমহল বাংলাদেশের সীমানায় অন্তর্ভূক্ত করেছেন, শান্তিচুক্তির মাধ্যমে পার্বত্য অঞ্চলের দীর্ঘদিনের সমস্যার সমাধান, অরক্ষিত আকাশসীমায় বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট স্থাপন, মধ্যম আয়ের দেশে পদার্পণ, রোহিঙ্গাদের মানবিক আশ্রয় প্রদান, মর্যাদার পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন, পদ্মাসেতু নির্মাণ, মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্রবন্দর স্থাপন, কর্ণফুলি টানেল নির্মাণ ও ডিজিটাল বাংলাদেশ থেকে স্মার্ট বাংলাদেশের অভিযাত্রী হয়ে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা বিনির্মাণে অভাবনীয় উন্নয়নের মাধ্যমে বাংলাদেশের মানুষের জন্য অনেক সোনালী অর্জন এনে দিয়েছেন।

তিনি বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন বাস্তবায়নে নেতৃত্ব দিয়ে জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়ে পর পর চারবার সহ মোট পাঁচবার প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন। তাঁর নেতৃত্বকালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ পাঁচবার সরকার গঠন করেছে। তিনি স্বাধীনতা বিরোধী শক্তির আইনের আওতায় বিচার করেছেন, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করে যতবড়ই ক্ষমতাধর ব্যক্তি বা পার্টির নেতা হোন না কেন তাদেরকে আইনের আওতায় এনে বিচার করেছেন। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভানেত্রী হিসেবে তার দায়িত্বকালে সকল দেশী-বিদেশী ষড়যন্ত্র, ক্ষমতাধর রাষ্ট্রের ও সংস্থার চাপ মোকাবেলা করেছেন।

উপমহাদেশের প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী অসাম্প্রদায়িক চেতনার রাজনৈতিক সফল দল হিসেবে বিশ্বে আজ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। ১৯৪৯ থেকে ১৯৭৫ পর্যন্ত ২৬ বছর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও ১৯৮১ থেকে ২০২৪ পর্যন্ত টানা ৪৩ বছর বঙ্গকন্যা শেখ হাসিনা সভানেত্রীর দায়িত্বে থেকে মোট ৬৯ বছর বাংলাদেশ আওয়ামীলীগের নেতৃত্ব দিয়ে রেকর্ড সৃষ্টি করেছেন।

একটি স্বাধীন দেশ সৃষ্টি করে এবং দেশের মানুষের সত্যিকারের মঙ্গল, উন্নয়ন ও মুক্তির জন্য এই পরিবার রক্ত দিয়ে বাঙালিকে ও বাংলাদেশকে ঋণী করেছেন। এই ঋণ শোধ হবার মতো নয়, বাংলাদেশের মানুষ কখনো তা শোধ করতে পারবে না। আমরা বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গবন্ধু পরিবারের প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় আজীবন ঋণী হয়ে থাকতে চাই। এই রাজনৈতিক দল টিকে থাকলে বাংলাদেশ টিকে থাকবে। এই রাজনৈতিক দল ও দলের আদর্শ চিরদিন অটুট থাকুক সেটাই বাংলাদেশের মানুষ প্রত্যাশা করে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের যে আদর্শ নিয়ে তাঁরই হাতে গড়া সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগে একজন সৈনিক হিসেবে যোগদান করেছিলাম সেই আদর্শ বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ যেন আজীবন সমুন্নত রাখে সেটাই ৭৫-তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীতে আওয়ামী লীগের একজন কর্মী হিসেবে আমার প্রত্যাশা।
বাংলাদেশ আওয়ামীলীগ চিরজীবী হোক। জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু।

অধ্যাপক ড. উত্তম কুমার বড়ুয়া: চিকিৎসক, লেখক-গবেষক ও সংগঠক

;