শহর ঢাকা

, যুক্তিতর্ক

ড. মতিউর রহমান | 2023-09-01 05:13:01

এক রাজা অন্য রাজার বিপক্ষে যুদ্ধে পরাজিত হওয়ার পর সেনাপতিকে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন, সেনাপতি যুদ্ধে আমাদের পরাজয়ের কারণ কী। সেনাপতি উত্তরে জানালেন, মহারাজ, পরাজয়ের একশ একটি কারণ রয়েছে। রাজা বললেন, বলো শুনি কী সেসব কারণ! সেনাপতি বললেন, মহারাজ, প্রথম কারণ হলো যুদ্ধের আগের রাতে আমাদের সমস্ত গোলাবারুদ তুমুল বৃষ্টিতে ভিজে নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। শুনে রাজা বললেন, বাকি একশ কারণ বলার প্রয়োজন নেই। ঢাকা শহরের ক্ষেত্রে উক্ত গল্পটির মমার্থ প্রযোজ্য না হলেও একটি উদাহরণ হিসেবে ধরা যেতে পারে যখন বিশ্বের বিভিন্ন আর্ন্তজাতিক প্রতিষ্ঠান ও পত্রিকা র‌্যাংকিং করে বলে, ঢাকা হচ্ছে বিশ্বের সবচেয়ে বসবাসের অযোগ্য শহরগুলোর মধ্যে একটি। বসবাসের অযোগ্য বললেই আর কোনো কারণ বা বিষয় বলার অপেক্ষা রাখেনা।

একটা রাজধানী শহরের যে বিষয়গুলো শোভন বাসযোগ্যতায় ভূমিকা রাখে তার বেশিরভাগই হয়ত ঢাকায় নেই। বাস অযোগ্যতার জন্য ঢাকা শহরের হয়ত একশ একটি সমস্যায় নয়, রয়েছে হাজারো সমস্যা। গণপরিবহনের বিশৃঙ্খখলা, যানযট, ট্রাফিক জ্যাম, ভাঙ্গা ও সরু রাস্তাঘাট, চলাচলের জন্য পর্যাপ্ত ফুটপাতের অভাব, বায়ু দূষণ, শব্দ দূষণ, পরিবেশ দূষণ, গাছপালার অভাব, যত্রতত্র ময়লা আর্বজনা, বিড়ি-সিগারেটের ধোঁয়া, গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানির সমস্যা, নোংরা জলাবদ্ধতা, আগুন লাগা, দুর্ঘটনা, মাথার উপর ঝুলন্ত বিদ্যুতের তারসহ অসংখ্য তার, অস্বাভাবিক দ্রব্যমূল্য, ভেজাল খাদ্য, অরিকল্পিত নগরায়ন, বিনোদনের জন্য পর্যাপ্ত খোলা জায়গা বা পার্কের অভাব, মশার উৎপাত, পর্যাপ্ত স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তির অভাব, ভালো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অভাব, খুন, ছিনতাই, ডাকাতি, প্রতারণা, ঘুষ, দুর্নীতি, রাজনৈতিক ছল-চাতুরী, ষড়যন্ত্র, আন্ডারওয়ার্ল্ড, মাফিয়া গ্যাং, কিশোর গ্যাং, মূর্খের মাতব্বরি, চুনোপুটির ক্ষমতার দাপট, ধনীর অহংকার, মধ্য ও নিম্নবিত্তের দীর্ঘশ্বাস, গরিব ও ভিক্ষুকের কাতরানি, নাগরিক নিরাপত্তার অভাব, হাজার হাজার বস্তি, লক্ষ লক্ষ রিক্সা, মানসিক চাপ, ইত্যাদি।

১৬০৮ সালে বুড়িগঙ্গা নদীর উত্তর তীরে সমতল ভূমিতে প্রতিষ্ঠিত ও ১৬১০ সালে সুবাহ বাংলার রাজধানী হিসেবে স্বীকৃত ছোট একটি শহর ঢাকা আজ মেগাসিটি। চারশ বছরেরও বেশি পুরনো বর্তমানে ৩০৬.৩৮ বর্গ কিলোমিটারের এই অতি মহানগরীর জনসংখ্যা প্রায় সোয়া দুই কোটি। প্রতি বর্গ কিলোমিটারে ৪৫,০০০ হাজার এরও বেশি মানুষের বসবাস। এছাড়াও প্রতিদিন প্রায় পঞ্চাশ লক্ষ মানুষ ঢাকার বাইরে থেকে বিভিন্ন প্রয়োজনে যাওয়া আসা করে। এই চারশ বছরে রাজধানী হিসেবে ঢাকার উত্থান ও পতন হয়েছে কয়েকবার। তারপরও থামানো যায়নি ঢাকার অব্যাহত অগ্রগতি। তবে যেভাবে গড়ে ওঠার কথা ছিলো সেভাবে হয়ত হয়নি।

তারপরও ঢাকা হচ্ছে বাংলাদেশ নামক ছোট্ট এই ভূখন্ডের একমাত্র বৃহৎ শহর। ঢাকা হচ্ছে বাংলাদেশের হৃৎপিন্ড। সতের কোটি মানুষের আশা ও নিরাশার শহর। সম্পদে ও বিপদে ঢাকাকেই মানুষ আশ্রয় স্থল হিসেবে মনে করে। রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতি, জ্ঞানচর্চা, সংষ্কৃতি, গণমাধ্যম, আর্ন্তজাতিক যোগাযোগ প্রভৃতির জন্য মানুষ ঢাকার দিকেই তাকিয়ে থাকে। এখনো এদেশের অধিকাংশ মানুষ ঢাকাকে অন্য এক সম্মানের চোখে দেখে। কারণ, এই শহরেই বাঙালি তার স্বকীয়তা রক্ষায় মাতৃভাষা বাংলার জন্য জীবন বিসর্জন দিয়েছে, এখানেই সূচিত হয়েছে মহান স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রথম আন্দোলন।

ঢাকাতেই জন্মেছেন ও বেড়ে ওঠেছেন অনেক নামকরা কবি, সাহিত্যিক, নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ, খ্যাতিমান শিল্পী, সাহিত্যিক, ক্রীড়াবিদ, চলচ্চিত্রকার ও রাজনীতিবিদ। ঢাকার খ্যাতি রয়েছে মসজিদ ও অতি মসৃন মসলিনের জন্যও। অনেকেই ঢাকাকে নিয়ে লিখেছেন হৃদয়গ্রাহী কবিতা, গদ্য ও ইতিহাস। সেসবে ওঠে এসেছে ঢাকার অনেক জানা ও অজানা কাহিনী। সেগুলোর প্রতিপাদ্য বিষয় যেমন আমাদের আনন্দ দেয়, আবেগাপ্লুত করে তেমনি যন্ত্রণাবিদ্ধও করে। ঢাকা আমাদের কাছে এক মিথের শহর। ঢাকা আমাদের কাছে এক জীবন্ত ইতিহাসের শহর।

বিশ্বায়নের যুগে আমরা বিশ্বের বিভিন্ন শহরের চিত্র টেলিভিশনের পর্দায়, ভিডিও ব্লগ ও ইউটিউবের মাধ্যমে দেখতে পাই। সেখানে উন্নত ও অনন্নুত অনেক শহরই দেখা সম্ভব। গুগুল আর্থ ম্যাপের মাধ্যমেও অনেক দেশের ছবি ও স্ট্রিট ভিউ আমরা দেখতে পারি ইচ্ছে করলেই ইন্টারনেটযুক্ত মুঠোফোনে ও কম্পিউটারের পর্দায়। আমরা সেসব দেখি আর দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলি।

প্রতি বছর আমাদের দেশের অসংখ্য মেধাবী ছেলে মেয়ে বিদেশের বিশেষ করে উন্নত দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করতে যায়। অনেকে স্কলারশিপ নিয়ে মাস্টার্স বা পিএইচডি করতে যান। আবার অনেকে দেশের ভিটেমাটি বন্দক রেখে, ঋণ নিয়ে উন্নত বা উন্নয়নশীল দেশে যান কাজ করে অধিক আয়ের জন্য। কেউ কেউ দেশের মায়া ত্যাগ করে পরিবার পরিজনসহ উন্নতদেশে স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্যও যান। তাদের অনেকেই উন্নতদেশের চকচকে, ঝকঝকে চওড়া রাস্তাঘাট, ঘরবাড়ী, দালানকোঠা, শপিংমল, উন্নত যোগাযোগ ও পরিবহন ব্যবস্থা, ট্র্যাফিক ব্যবস্থা, নাগরিক নিরাপত্তা দেখে মুগ্ধ ও বিমোহিত হন এবং মনে মনে আমাদের দেশের বিশেষ করে ঢাকার অবস্থা চিন্তা করে হাহাকার করে ওঠেন। অনেকেই হয়তোবা পুলক অনুভব করেন এই যন্ত্রণাময় পরিস্থিতি থেকে মুক্ত হয়ে নিরাপদ একটি দেশে স্থায়ীভাবে বসবাসের সুযোগ লাভ করে। কিন্তু কিছুদিন বাদে তাদের মধ্যেও কী এক ধরণের হাহাকার বোধ কাজ করেনা? নাহলে কেনো তারা বার বার দেশে আশার জন্য ব্যাকুল হন? কেনো এদেশের কোনো সমস্যায় বিদেশের মাটিতে বসে উদ্বেগাকুল হয়ে ওঠেন? শুধুই কী মাটির টানে নাকি এর পেছনে অন্য কোনো মনস্তত্ত্ব আছে? বিশেষজ্ঞরা হয়ত এর ভালো ব্যাখ্যা দিতে পারবেন।

বিবিসি’র এক প্রতিবেদন অনুয়ায়ী ঢাকা শহর নিয়ে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন আর্ন্তজাতিক সংস্থা বা পত্র-পত্রিকার করা র‌্যাংকিং আমাদের দেশের অনেক বিখ্যাত নগর পরিকল্পপনাবিদ গ্রহণযোগ্য মনে করেন না। তাদের মতে, যেসব শহরের সাথে তুলনা করে এসব করা হয় সেসব শহরের জনসংখ্যা ও ঢাকার জনসংখ্যা এক নয়। ওইসব শহরে ঢাকার কোনো একটি এলাকার জনসংখ্যাও যদি ঢুকে যায় তাহলে ওই শহরের পুরো ব্যবস্থা ভেঙে পড়তে পারে। তাদের মতে, ওইসব শহর অবকাঠামোগত দিক দিয়ে হয়ত অনেক উন্নত কিন্তু মানবিকতার দিক দিয়ে কতটুকু উন্নত তা পরিমাপ করা হয় না।

তাদের অনেকের মতে, ঢাকা হচ্ছে মানবিকতার শহর। এই শহরে এখনও মানুষ তাদের সুখে-দুঃখে দেশের অন্যান্য শহর ও গ্রাম থেকে ছুটে আসে বসবাস করার উদ্দেশে, চাকুরী, ভালো চিকিৎসা, শিক্ষা, বিদেশ যাওয়া, ব্যবসা-বাণিজ্য ইত্যাদি কাজে। এই শহর আশ্রয় দেয় নদী ভাঙনে সহায়-সম্বলহীন মানুষদেরকে। এই শহরে লক্ষ লক্ষ শ্রমজীবী মানুষ, ফুটপাতের অতি ক্ষুদ্রব্যবসায়ি, গ্রাম থেকে গার্মেন্টসে কাজের জন্য আসা লাখ লাখ গরিব ছেলে মেয়েদেরকে আশ্রয় দেয়। এই শহরে এখনও কোনো ব্যক্তি রাস্তায় অসুস্থ্য হলে বা দুঘর্টনায় আহত হলে পুলিশের আগে দশজন মানুষ সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসে। এই শহরে কোনো স্থানে আগুন লাগলে সবার আগে সাধারণ জনতা তা নেভাতে ছুটে আাসে। তেমনিভাবে কারো বিপদ-আপদে সাধারণ মানুষের যে স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ তা অনেকবার প্রমাণিত হয়েছে। রানা প্লাজা ট্রাজেডির কথা এক্ষেত্রে স্মরণ করা যেতে পারে। ঐতিহাসিক সব দিবসেই এই শহরের মানুষের অংশগ্রহণ বেশি। সুতরাং, মানবিকতার দিক দিয়ে ঢাকা শহর বিশে^র অন্য কোনো শহরের চেয়ে কম নয়। তাসত্ত্বেও জনবিজ্ঞানের ‘পুশ ফ্যাক্টর’ ও ‘পুল ফ্যাক্টর’ সমভাবে কাজ করে এই শহরকে কেন্দ্র করে।

তবে, একথা সত্য যে, অবকাঠামোগতভাবে ঢাকা শহরকে পরিকল্পিতভাবে গড়ে তোলা যায়নি। এর পেছনেও রয়েছে রাজনৈতিক, আমলাতান্ত্রক ও অর্থনৈতিক কারণ। গত কয়েক বছরে ঢাকাকে বসবাসযোগ্য করার জন্য রাজউক কর্তৃক প্রণীত ড্যাপ এর আওতায় অনেক প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে। মেট্রোরেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, ফ্লাইওভার, ফুটপাত ও রাস্তাঘাট নির্মাণ, পার্ক ও বিনোদন কেন্দ্র সংষ্কার ইত্যাদি। ভবিষ্যতে হয়ত আরো অনেক বড় প্রকল্প নেয়া হবে। কারণ, সে সামর্থ্য বাংলাদেশ ইতিমধ্যে প্রমাণ করেছে পদ্মাসেতু নির্মাণ করে। ঢাকার অদূরেই হয়ত গড়ে ওঠবে পদ্মাসেতুকেন্দ্রিক নতুন আধুনিক ঢাকা। বর্তমান ঢাকার চারপাশে নতুন স্যাটেলাইট শহর নিমার্ণের পরিকল্পনাও শোনা গেছে।

শেষ করি অন্য একটি গল্প দিয়ে। এক ভিক্ষুক প্রতিদিন এক বাড়িতে ভিক্ষার জন্য যান কিন্তুু বাড়ির গৃহকর্ত্রী তাকে বার বার দূর দূর করে তাড়িয়ে দেন। তবে একদিন তা না করে ভিক্ষুকের হাতে তুলে দেন এক পাত্র ছাই। ভিক্ষুক তা দেখে হাসতে থাকেন। গৃহকর্ত্রী অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেন, তুমি হাসছ কেনো? তোমাকে তো আমি ছাই খেতে দিয়েছি। ভিক্ষুক বলেন, হাসছি এই কারণে যে এতদিন আপনি কিছুই দেননি। আজ ছাই দিয়েছেন তো তাতে কী হয়েছে? আপনার দেওয়ার অভ্যাস তৈরী হয়েছে এটাইতো আমার জন্য বড়ো পাওয়া। ভবিষ্যতে হয়ত ভিক্ষাও দেবেন। আমরাও সেই প্রত্যাশায় আছি। আমাদের নগর কর্তৃপক্ষ বা সরকার এই শহরকে বসবাসযোগ্য করার জন্য আরো উদ্যোগি ও মনোযোগী হবেন। একদিন হয়ত আমাদের প্রিয় শহর ঢাকা বসবাসযোগ্য নগরীর আর্ন্তজাতিক র‌্যাংকিং-এ এক থেকে দশের মধ্যে অবস্থান করবে।

ড. মতিউর রহমান, গবেষণা পরামর্শক, হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট রিসার্চ সেন্টার (এইচডিআরসি), ঢাকা

এ সম্পর্কিত আরও খবর