প্লেনের চাকা-ছাদে চড়ে পালাতে হবে কেন?

, যুক্তিতর্ক

প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম | 2023-08-28 16:03:07

স্কুলে পড়াকালীন সময়ে প্রায় প্রতিদিন ছাপানো দৈনিক পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠায় সোভিয়েত ট্যাংকের সাথে আফগান যোদ্ধাদের গোলাগুলির ছবি দেখতাম। সেসময় শুনতাম দেশটিতে বহু মানুষ যুদ্ধাহত হয়ে চিকিৎসা পাচ্ছে না। কাবুলের হাসপাতালে রক্ত দান করার মত কোন মানুষ নেই। বৈশাখ- জ্যৈষ্ঠ মাসে কোন বাচ্চা হারিয়ে গেলে বলা হতো ছেলেধরা ওকে কাবুলে ধরে নিয়ে গেছে রক্ত চুষে নেবার জন্য। সেসময় আজগুবি সব গল্প-গুজব শুনে বড় বড় ভূট্টা ও পাটক্ষেতের পাশ দিয়ে একা একা স্কুলে যেতে ভয় করতাম আমরা।

সোভিয়েতরা আফগানিস্তান আক্রমণ করেছিল ডিসেম্বর ২৪, ১৯৭৯ সালে। তারা টানা নয় বছর যুদ্ধ করে ১৯৮৯ সালের ১৫, ফেব্রুয়ারী আফগান ছেড়ে চলে যায়। দুর্গম পাহাড়ি গ্রামে গেরিলা যুদ্ধে টিকতে না পেরে সোভিয়েতরা আফগানিস্তান ছাড়তে বাধ্য হয়। দীর্ঘ নয় বছরে আফগানদের ৯০,০০০ মুজাহেদিন ও ১৮,০০০ সরকারী সেনা নিহত হয়েছিল। দেশটিতে বহুযুগ থেকে নানা জাতিগত সংঘাত, উপদলগুলোকে দুর্বল করে তোলে এবং গৃহযুদ্ধের সুযোগে সোভিয়েতরা আক্রমণ চালিয়ে সবকিছু দখলে নেবার চেষ্টা করেও বিফল হয়।

আফগানিস্তানে তালেবানের আবির্ভাবের পূর্বে মুজাহেদিনরা ক্ষমতায় ছিল মুজাহেদিনদের নেতা ছিলেন তৎকালীণ আফগান প্রেসিডেন্ট বুরহানউদ্দিন রব্বানী। মুজাহেদিনরাই আশির দশকে সোভিয়েত বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল।

এরপর ১৯৯০ সালে জন্ম নেয় তালেবান নামক আন্দোলন। তালেবান পশতু শব্দ। পশতু ভাষায় তালেবান শব্দের অর্থ ছাত্র। আরবী ভাষায়ও তা’লিব শব্দের অর্থ শিক্ষার্থী। পাকিস্তানের উত্তরে ১৯৯০ সালের শুরুর দিকে তালেবান আন্দেলনের জন্ম হলেও পরবর্তীতে তা সশস্ত্র সংগঠন হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। ১৯৯৪ সালের কান্দাহারের পাহাড়ি এলাকা দখলে নিয়ে তারা গড়ে তোলে ব্যাপক কর্মকান্ড। তারা ১৯৯৫ সালে হেরাত দখল করে নেয় ও ১৯৯৬ সালে কাবুল দখল করে। সেখানকার স্কুল ও মাদ্রাসাগুলোতে প্রথম এই আন্দোলন সংগঠিত হয়। ১৯৯৬-২০০১ সাল পর্যন্ত তার আফগানিস্তান শাসন করে। 

২০০১ সালে প্রেসিডেন্ট মোল্লা ওমরের সময় আমেরিকান সৈন্যরা নানা অযুহাতে আফগানিস্তানে ঢুকে পড়ে ও ব্যাপক আক্রমণ চালায়। আমেরিকান সৈন্যরা জোর করে মোল্লা ওমরের সরকারকে উৎখাত করে ও ক্ষমতা দখল করে নেয়। তার ঠিক বিশ বছর পর ২০২১ সালে মার্কিন সৈন্যরা নিজেরাই আফগান ছেড়ে চলে যায়।

১৯৯৬-২০০১ সাল পর্যন্ত তালেবানী শাসন আফগানিস্তানে মানুষের মৌলিক অধিকার হরণ করেছিল বলে ব্যাপক প্রচরণা রয়েছে। বিশেষ করে নারীদের আধুনিক শিক্ষা হরণ, চাকুরী ও মর্যাদার ব্যাপারে তাদের ব্যাপক কড়াকড়ি আরোপ করা ছিল।

তালেবান এতদিন ক্ষমতার বাইরে থেকে পাহাড়ের গুহায়, প্রবাসে, গ্রামে-গঞ্জে তাদের প্রশিক্ষণ চালিয়ে যেতে থাকে। ২০১৩ সালে তারা বিদেশী উইং জোরদার করে এবং কাতারে তাদের অফিস খোলার কথা ঘোষণা করে । এরই মধ্যে পাকিস্তানের একটি হাসপাতালে তাদের নেতা মোল্লা ওমরের মৃত্যু হলে দু’বছর সে খবরকে গোপন রাখা হয়। সাথে সাথে তারা মোল্লা মনসুরের নেতৃত্বে সংগঠিত হয়ে সহিংস হয়ে উঠে। মোল্লা মনসুর এক ড্রোন হামলায় নিহত হলে ২০২০ সালে মার্কিন সৈন্যদের সাথে তালেবানদের এক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।

২০২১ সালে বাইডেন ক্ষমতা লাভের পর আমেরিকার আফগানিস্তান নীতিতে বড় পরিবর্ত আসে। ২০২০ সালে করোনায় মরণ কামড়ে মার্কিনীদের ব্যাপক মৃত্যু ও অর্থনৈতিক ক্ষতি দেশটিকে বৈদেশিক যুদ্ধের খরচ কমানোর কৌশল পরিবর্তনের দিকে ধাবিত করে। মার্কিনীরা এত বছর ধরে বিদেশে যুদ্ধাস্ত্র বিক্রি করে এবং সামরিক আক্রমণ করে অত্যাচার চালিয়ে বেড়াচ্ছিল। কিন্তু করোনাকালীণ ব্যাপক ভয়াবহতা সামাল দিতে তাদের হিমশিম খেতে হচ্ছে। ব্যাপক বেকারত্ব, সামাজিক অস্থিরতা, অপরাধপ্রবণতা ও মুক্তবাজার ব্যবসায় ধ্বস তাদেরকে নতুন করে ভোগাচ্ছে। মার্কিনীরা বছরে দুই ট্রিলিয়ন ডলার যুদ্ধ করে পানিতে ঢেলে বেড়াচ্ছিল। এই বিরাট খরচ সামলানো তাদের জন্য বড় হুমকি-যেহেতু চায়না তাদের সাথে প্রতিযোগিতায় পাল্লা দিয়ে দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে বিশ্বময়। এছাড়া বলা হয়ে থাকে, ভিয়েতনামের সায়গন যুদ্ধে হেরে তারা কম্যুনিষ্টদেরকে তাজা করেছিল। এবার আফগানিস্তানে ইসলামের সংগে হেরে নিজেদেরকে ইরান ও আরবীয় তেলের মাঝে বিকি-কিনি করে সেই ক্ষতি পুষিয়ে নিতে চায়।

তালেবানরা কাবুলে প্রবেশ করারা সাথে সাথে প্রেসিডেন্ট ঘানি চার গড়ি ও হেলিকপ্টার ভর্তি করে টাকা-পয়সা সহ বিদেশে পালিয়ে গেছেন বলে সংবাদে জানা গেছে। কাবুলের রুশ দূতাবাসের মুখপাত্র নিকিতা ইশচেঙ্কা বলেন, তিনি অনেক টাকা নিতে চেয়েছিলেন কিন্তু সব তুলতে পারেননি। রাস্তায় ফেরে গেছেন।

অন্যদিকে তালেবানরা দেশটিকে “ইসলামিক এমিরেটস্ অব আফগানিস্তান” নামকরণ করে ঘোষণা দিয়েছে। সবাইকে এই নিয়ম মানতে হবে। ইসলামিক নিয়মের কড়াকড়ি আরোপের ভয়ে গানি পন্থীরা আতঙ্কে দেশ ত্যাগের জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছেন।

ঘানি পন্থীরা অজানা নির্যাতনের ভয় পেয়ে মার্কিন নাগরিক বহনের প্লেনে উঠে আমেরিকা চলে যাবার জন্য কাবুলের কারজাই বিমান বন্দরে ছুটাছুটি করছেন। তারা রানওয়েতে চলন্ত সামরিক প্লেনের সাথে দৌড়াচ্ছে। কেউ বিমানের ছদে উঠে বসে পড়েছে। ১৫ আগষ্ট ২০২১ উড়ন্ত প্লেন থেকে পড়ে গিয়ে মারা গেছেন কয়েকজন। কোন বিমানবন্দরে এমন নিরাপত্তাহীন ও বিশ্রী কারবার আগে কেউ কখনও দেখেছেন বলে মনে হয় না। কেউ কেউ বিমানের চাকার হোল্ডারের মধ্যে ঢুকে নিজেকে লুকিয়ে রেখেছে। জানা গেছে, ইউএস সামরিক প্লেন- ১১০৯ উড্ড্য়নের সময় চাকার হোল্ডার বন্ধ করতে না পেরে পুনরায় ল্যান্ড করলে চাকার ভেতর থেকে মানুষের খন্ডিত দেহাবশেষ উদ্ধার কার হয়েছে।

তবে এটাই কি নিয়তি? পলায়নকৃত প্রেসিডেন্ট আশরাফ গানি বলেছেন, তিনি রক্তপাত এড়তে নীরবে বিদেশে পাড়ি জমিয়েছেন। তা না হলে কাবুলে অনেক মানুষ মারা যেত। অন্যদিকে আশরাফ গানির অনুপস্থিথিতে তার ভাইস প্রেসিডেন্ট আমরুল্লাহ্ সালেহ নিজেকে বৈধ তত্তাবধায়ক প্রেসিডেন্ট হিসেবে ঘোষণা দিয়েছেন। তিনি সবার সমর্থন চান। কিন্তু এখনও কোন সাড়া পাননি।

অন্যদিকে, তালেবানরা ঘোষণা করেছে বিনা রক্তপাতে তারা ক্ষমতা দখল করেছেন।  ২০ বছর পর কাবুলে প্রথম সংবাদ সম্মেলনে, “জনগণকে মুক্ত হওয়ার জন্য অভিনন্দন জানান। মুক্তি ও স্বাধীনতা প্রতিটি জাতির বৈধ অধিকার উল্লেখ করে তিনি বলেন, ২০ বছর সংগ্রামের পর আমরা (দেশকে) মুক্ত করেছি ও বিদেশিদের তাড়িয়েছি। এই মুহূর্ত গোটা জাতির জন্য গর্বের। জাবিহুল্লাহ বলেন, আফগানিস্তান যেন আর যুদ্ধক্ষেত্র বা সংঘাতের দেশ না হয় আমরা তা নিশ্চিত করতে চাই। আমাদের বিরুদ্ধে যারা লড়াই করেছে, তাদের সবাইকে আমরা ক্ষমা করেছি। আমরা শত্রুতার অবসান চাই। 'আমরা ঘরে ও বাইরে কোথাও কোনো শত্রু চাই না।”

তবে আফগানিস্তান নিয়ে এত দ্রুত কিছু মন্তব্য করারা ইচ্ছে আমার নেই। কারণ, সেখানকার জাতিগত কোন্দল এত বেশী যে সেজন্য যে কোন প্রতিশ্রুতির স্থায়ীত্বও খুব কম। তা না হলে প্লেনের চাকায় বা ছাদে চড়ে অথবা ইউএস সামরিক প্লেনে আমেরিকা পৌঁছানো যাবে না জেনেও সেখানকার ভীত-সন্ত্রস্ত মানুষ কেন নিজ ঘরবাড়ি ছেড়ে দেশান্তরী হবার জন্য এত পাগল হয়েছে সেটাই গভীর চিন্তার বিষয়।

লেখক: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডীন, সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সাবেক চেয়ারম্যান। E-mail: fakrul@ru.ac.bd

এ সম্পর্কিত আরও খবর