ধ্বংস করেছি ধর্মযাজকী পেশা

, যুক্তিতর্ক

মাহমুদ আহমদ | 2023-08-31 10:09:53

মানবতার কবি, অসাম্প্রদায়িক কবি কাজী নজরুল ইসলাম সত্য-সুন্দর আর কল্যাণের পূজারী ছিলেন। তিনি চেয়েছেন সম্প্রদায়ের ঊর্ধ্বে মানুষের মুক্তি। তাই প্রকৃত সাম্যবাদীর মতো তিনি লিখেছেন- “কাটায়ে উঠেছি ধর্ম-আফিম-নেশা/ ধ্বংস করেছি ধর্মযাজকী পেশা,/ ভাঙি মন্দির, ভাঙি মসজিদ/ ভাঙিয়া গির্জা গাহি সঙ্গীত,/ এক মানবের একই রক্ত মেশা/ কে শুনিবে আর ভজনালয়ের হ্রেষা!’’

কত চমৎকার ভাবেই না তিনি বাস্তবাতা ফুটিয়ে তুলেছেন কবিতার মাধ্যমে। গতকাল আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুলের হামিদ কারজাই বিমানবন্দরের প্রবেশপথে দুটি আত্মঘাতী বোমা হামলায় অন্তত ১৩ মার্কিন সেনাসহ নিহতের সংখ্যা ১০০ ছাড়িয়েছে। ভয়াবহ এ হামলায় ১৫০ জনেরও বেশি লোক আহত হয়েছে। খবর বিবিসির।

বিশ্বময় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, অরাজকতা, নৈরাজ্য, ধর্মের নামে রক্তপাত আর চলছে মাজহাবি যুদ্ধ। নিজ ধর্মের শ্রেষ্ঠত্বের দোহায় দিয়ে অন্য ধর্মের অনুসারীদের প্রতি হিংসা-বিদ্বেষ ছড়ানো মনে হয় এক ধরনের অলিখিত প্রবণতা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এসব থেকে মুক্ত হতে আজীবন যিনি সংগ্রাম করেছেন তিনি হলেন মানবতার কবি, অসাম্প্রদায়িক কবি কাজী নজরুল ইসলাম।

তিনি একাধারে কবি, সাহিত্যিক, সংগীতজ্ঞ, সাংবাদিক, সম্পাদক, রাজনীতিবিদ এবং ঈসনিক হিসেবে অন্যায় ও অবিচারের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছেন যা বিশ্বের ইতিহাসে চির স্মরণীয় হয়ে আছে। তিনি কাব্যে যেমন বিদ্রোহী ছিলেন বাস্তবেও ছিলেন তেমনি বিদ্রোহী। মানবতাবাদ, অসাম্প্রদায়িকতা আর নারী-পুরুষ তথা সমাজের সাম্য রক্ষা তার কবিতায় প্রতিফলিত হয়।

তিনি বাংলা সাহিত্যের এক দিকপাল হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছেন এবং থাকবেন। নজরুল শুধু ভাবাবেগের দ্বারা ইসলামি ভাবধারায় কবিতা বা গান লেখেননি। তিনি চেয়েছিলেন মাতৃভাষায় সৃজনশীল প্রকাশের মাধ্যমে ধর্মকে বা ধর্মের প্রকৃত বাণীকে সর্বসাধারণ্যের কাছে গল্পের মতো পৌঁছে দিতে।

যার যার ধর্ম স্বাধীনভাবে পালন করার যে শিক্ষা তা তিনি হৃদয়ে ধারণ করেছিলেন এবং তার লিখনীতে তা সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। তিনি লিখেছেন-

“নাইকো এখানে কালা ও ধলার আলাদা গোরস্থান।/নাইকো এখানে কালা ও ধলার আলাদা গির্জা-ঘর,/নাইকো পাইক-বরকন্দাজ নাই পুলিশের ডর।/এই সে স্বর্গ, এই সে বেহেশ্ত, এখানে বিভেদ নাই,/যত হাতাহাতি হাতে হাত রেখে মিলিয়াছে ভাই ভাই!/নেইকো এখানে ধর্মের ভেদ শাস্ত্রের কোলাহল,/পাদরি-পুরুত-মোল্লা-ভিক্ষু এক গ্লাসে খায় জল।/হেথা স্রষ্টার ভজনা-আলয় এই দেহ এই মন,/হেথা মানুষের বেদনায় তাঁর দুখের সিংহাসন!/সাড়া দেন তিনি এখানে তাঁহারে যে-নামে যে-কেহ ডাকে,/যেমন ডাকিয়া সাড়া পায় শিশু যে-নামে ডাকে সে মাকে!/পায়জামা প্যান্ট ধুতি নিয়া হেথা হয় নাকো ঘুঁষোঘুঁষি,/ধুলায় মলিন দুখের পোশাকে এখানে সকলে খুশি।”

জাতি ধর্ম, বর্ণ এবং সম্প্রদায়ের উর্ধ্বে ছিলেন তিনি। তাইতো লিখতে পেরেছেন, গাহি সাম্যের গান/ যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব বাধা ব্যবধান,/যেখানে মিশেছে হিন্দু, বৌদ্ধ, মুসলিম, খ্রিস্টান।’ তিনি লিখেছিলেন ‘মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই নহে কিছু মহীয়ান/নাই দেশ-কাল-পাত্রের ভেদ, অভেদ ধর্ম জাতি,/সব দেশে, সব কালে, ঘরে ঘরে তিনি মানুষের জ্ঞাতি।

নজরুল যে কতটা অসাম্প্রদায়িক ছিলেন তা ‘হিন্দু-মুসলমান’ প্রবন্ধ থেকে আরো স্পষ্ট হয়। তিনি লিখছেন: “নদীর পাশ দিয়ে চলতে চলতে যখন দেখি, একটা লোক ডুবে মরছে, মনের চিরন্তন মানুষটি তখন এ-প্রশ্ন করবার অবসর দেয় না যে, লোকটা হিন্দু না মুসলমান। একজন মানুষ ডুবছে, এইটেই হয়ে ওঠে তার কাছে সবচেয়ে বড়, সে ঝাঁপিয়ে পড়ে নদীতে। হিন্দু যদি উদ্ধার করে দেখে লোকটা মুসলমান, বা মুসলমান যদি দেখে লোকটা হিন্দু, তার জন্য তো তার আত্মপ্রসাদ এতটুকু ক্ষুণ্ণ হয় না। তার মন বলে, ‘আমি একজন মানুষকে বাঁচিয়েছি, আমারই মতো একজন মানুষকে।’

সমস্ত ধর্মীয় গোঁড়ামি থেকে বেরিয়ে তিনি সর্বদা চেয়েছেন জাতপাতের উর্ধ্বে মানবধর্ম প্রতিষ্ঠার কথা। তাই তো তিনি লিখেছেন- “জাতের নামে বজ্জাতি সব জাত-জালিয়াৎ খেল্ছে জুয়া,/ছুঁলেই তোর জাত যাবে? জাত ছেলের হাতের নয় তো মোয়া।/হুঁকোর জল আর ভাতের হাঁড়ি-ভাব্লি এতেই জাতির জান,/তাই ত বেকুব, করলি তোরা এক জাতিকে এক শ’-খান!/এখন দেখিস্ ভারত জোড়া প’চে আছিস বাসি মড়া,/মানুষ নাই আজ, আছে শুধু জাত-শেয়ালের হুক্কাহুয়া।”

ধর্ম যে সহনশীলতার প্রতীক তা তার কবিতায় এভাবে তুলে ধরেছেন- “জানিস নাকি ধর্ম সে যে বর্ম সম সহন-শীল,/তাকে কি ভাই ভাঙ্তে পারে ছোঁওয়া-ছুঁয়ির ছোট্ট ঢিল।/যে জাত-ধর্ম ঠুন্কো এত,/আজ নয় কাল ভাঙবে সে ত,/যাক্ না সে জাত জাহান্নামে, রইবে মানুষ, নাই পরোয়া।”

একই উৎস থেকে সবার সৃষ্টি, এই পরম সত্যটি তিনি এভাবে তুলে ধরেছেন- “সকল জাতই সৃষ্টি যে তাঁর, এ বিশ্ব-মায়ের বিশ্ব-ঘর,/মায়ের ছেলে সবাই সমান, তাঁর কাছে নাই আত্ম পর।/বলতে পারিস, বিশ্ব-পিতা ভগবানের কোন সে জাত?/কোন্ ছেলের তাঁর লাগলে ছোঁয়া অশুচি হন জগন্নাথ?/নারায়ণের জাত যদি নাই,/তোদের কেন জাতের বালাই?/(তোরা) ছেলের মুখে থুথু দিয়ে মা’র মুখে দিস ধূপের ধোঁয়া।/ভগবানের ফৌজদারী-কোর্ট নাই সেখানে জাত-বিচার,/পৈতে টিকি টুপি টোপর সব সেথা ভাই একাক্কার।/জাত সে শিকেয় তোলা রবে,/কর্ম নিয়ে বিচার হবে।”

নজরুলের কবিতায় একদিকে যেমন ঠাঁই পেয়েছে মুসলিম আদর্শ অন্যদিকে হিন্দু আদর্শ। সর্বোপরি এ সব কিছুর মূল সুতো হচ্ছে তার সাম্যবাদী মনোভাব, তার মানবতাবোধ। তিনি তার লেখনীতে যে সাম্যের ইঙ্গিত দিয়েছেন তা স্বাধীনতা, গণতন্ত্র, মানবতা এবং সুবিচারের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। জাতি-বৈষমম্য, শ্রেণি-বৈষম্য এবং ধর্মীয় বৈষম্যের প্রতি তার কণ্ঠ সর্বদাই সোচ্চার ছিল।

স্রষ্টার সান্নিধ্য পেতে বনে-জঙ্গলে যাওয়ার যে প্রয়োজন নেই এ বিষয়ে তিনি লিখেছেন-“কে তুমি খুঁজিছ জগদীশ ভাই আকাশ পাতাল জুড়ে’/কে তুমি ফিরিছ বনে-জঙ্গলে, কে তুমি পাহাড়-চূড়ে?/হায় ঋষি দরবেশ,/বুকের মানিকে বুকে ধ’রে তুমি খোঁজ তারে দেশ- দেশ।/সৃষ্টি রয়েছে তোমা পানে চেয়ে তুমি আছ চোখ বুঁজে,/স্রষ্টারে খোঁজো-আপনারে তুমি আপনি ফিরিছ খুঁজে!/ইচ্ছা-অন্ধ! আঁখি খোলো, দেশ দর্পণে নিজ-কায়া,/দেখিবে, তোমারি সব অবয়বে পড়েছে তাঁহার ছায়া।”

আজকে বিশ্বব্যাপী নারী অধিকার নিয়ে বিভিন্ন দেশে আন্দোলন হচ্ছে। যা নজরুল অনেক আগেই বিশ্ববাসীকে দেখিয়েছে। চিন্তা করার সুযোগ সৃষ্টি করেছে। তিনি লিখেছেন-“আমার চক্ষে পুরুষ-রমণী কোনো ভেদাভেদ নাই!/বিশ্বে যা-কিছু মহান সৃষ্টি চির-কল্যাণকর,/অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।/বিশ্বে যা-কিছু এল পাপ-তাপ বেদনা অশ্রুবারি,/অর্ধেক তার আনিয়াছে নর, অর্ধেক তার নারী।”

তিনি কখনও নারী শক্তিকে অবহেলা করেননি বরং সর্ব্দা প্রাধান্য দিয়েছেন। তিনি বলেছেন- “কোন কালে একা হয়নিকো জয়ী পুরুষের তরবারি/প্রেরনা দিয়েছে,শক্তি দিয়াছে বিজয়ালক্ষী নারী”

সকল ধর্মের সার্বজনীন মূল্যের প্রতি ছিল তার প্রগাঢ় আস্থা। আর এই আস্থা তাকে হিন্দু কিংবা মুসলমানের কবি না করে, করেছে বাংলা ও বাঙালির কবি। বর্তমান বিশ্বময় মাজহাবি কারণে যে রক্তপাত ঘটছে এ বিষয়ে তিনি লিখেছেন-

“হয়ত আমাতে আসিছে কল্কি, তোমাতে মেহেদী ঈসা,

কে জানে কাহার অন- ও আদি, কে পায় কাহার দিশা?

কাহারে করিছ ঘৃণা তুমি ভাই, কাহারে মারিছ লাথি?

হয়ত উহারই বুকে ভগবান্ জাগিছেন দিবা-রাতি!”

ধর্ম নিয়ে আজ যারা অতি বারাবারি করছে তাদের কাছে জানতে চাই, ধর্ম কি নৈরাজ্য সৃষ্টির নাম, ধর্মের নাম কি রক্তপাত? মোটেও তা নয়, ধর্ম শান্তির নাম। পৃথিবীতে প্রতিনিয়ত হাজার হাজার মানুষ প্রাণ হারাচ্ছে শুধুমাত্র মাজহাবি যুদ্ধে। অথচ আল্লাহপাকের কোনো মাজহাব নেই। সমগ্র সৃষ্টি একই মাজহাবের আর তা হল মানব মাজহাব আর একই উৎস থেকে আমাদের সবার সৃষ্টি এবং একই স্থানে সবার প্রত্যাবর্তন তারপরও আমরা সমাজে নৈরাজ্য সৃষ্টি করতেই যেন ভালবাসি। আর এ বিষয়টিই নজরুল তার অসংখ্য রচনায় সাবলিলভাবে তুলে ধরেছেন।

আসলে তিনি বাঙালি মুসলমানকে অসাম্প্রদায়িক চেতনায় উদ্বুদ্ধ করার জন্য সচেতন প্রয়াস নিয়েছিলেন। নিয়েছিলেন বিভিন্ন কৌশল। তিনি উপলব্ধি করেছিলেন ধর্মকে মাতৃভাষার মাধ্যমে চর্চা করতে হবে এবং ধর্মের মধ্যে যে অসাম্প্রদায়িকতা থাকতে পারে; থাকতে পারে পরমতসহিষ্ণুতা ও পরধর্মসহিষ্ণুতা, সেটি গল্প ও উপাখ্যান থেকে সাধারণ মানুষ বোঝার জন্য সাহিত্য মণ্ডিত করে প্রকাশ করতে হবে। এটাই ছিল তার স্বপ্ন।

পরিশেষে আমরা এটাই বলবো, বিশ্বময় সাম্প্রদায়িকতা, জঙ্গিবাদ, ধর্মীয় কুসংস্কারের বেড়াজাল থেকে মুক্তি পেতে নজরুল চর্চার বিকল্প নেই।

লেখক: ইসলামী গবেষক ও কলামিস্ট, ই-মেইল- masumon83@yahoo.com

এ সম্পর্কিত আরও খবর