যতটা সহজ মনে করা হয়েছিল, বাস্তবে তা হয়নি। রুশ আগ্রাসনের বিরুদ্ধে বীরদর্পে লড়ছে ইউক্রেন। সারা বিশ্ব, এমনকি, খোদ রাশিয়াতেও যুদ্ধবাজ পুতিন নিন্দা, ধিক্কার ও প্রতিবাদের মুখোমুখি। বিশ্বের মানবিক বিবেক পুতিনকে দেখছে হিটলারের ভয়াল ছায়ায়। এরই মধ্যে বেলারুশ সীমান্তের গোমেল অঞ্চলে রাশিয়ার প্রতিনিধিদের সঙ্গে ইউক্রেনের শান্তি আলোচনা শুরু হয়েছে।
সোমবার (২৮ ফেব্রুয়ারি) ইউক্রেন প্রেসিডেন্ট কার্যালয়ের উপদেষ্টা মাইখাইলো পোডোলিয়াক বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে এ তথ্য জানালে যুদ্ধের পঞ্চম দিনে খুলতে চলেছে আলোচনার রাস্তা। সোমবার রাশিয়া এবং ইউক্রেনের প্রতিনিধিদের শান্তি বৈঠক হতে চলেছে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে তৈরি হওয়া প্রজাতন্ত্র বেলারুশের প্রধান প্রশাসনিক অঞ্চল গোমেলে। যুযুধান দু’পক্ষের প্রতিনিধিদের শান্তি বৈঠকের আলোচনায় সম্মতি দিয়েছে বেলারুশ সরকার।
আলোচনা ও শান্তি প্রচেষ্টার বিপরীতে রাশিয়াকে পরমাণু অস্ত্র মোতায়েনেরও অনুমতি দিয়েছে বেলারুশ। বেলারুশ সরকারের এই সিদ্ধান্তে আমেরিকার নেতৃত্বাধীন ন্যাটো জোটের উপর চাপ বাড়তে পারে বলে মনে করছেন প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞদের কেউ কেউ। বেলারুশ সরকারের তরফে এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘শান্তি বৈঠকের আয়োজনের জন্য সমস্ত প্রস্তুতি সারা হয়ে গিয়েছে।’
প্রসঙ্গত, গত রবিবার (২৭ ফেব্রুয়ারি) রাশিয়ার তরফে মিনস্কে শান্তি বৈঠকের প্রস্তাব দেওয়া হলেও ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভোলোদেমির জেলেনস্কি প্রাথমিক ভাবে বেলারুশে আলোচনায় বসতে রাজি হননি। পরিবর্তে, পোল্যান্ডের রাজধানী ওয়ারশ, হাঙ্গেরির রাজধানী বুদাপেস্ট, স্লোভাকিয়ার রাজধানী ব্রাতিস্লোভা, তুরস্কের রাজধানী ইস্তানবুল এবং আজেরবাইজানের রাজধানী বাকুর নাম প্রস্তাব করেন তিনি। এর আগে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট কার্যালয় বলেছিল, আলোচনায় কিয়েভের লক্ষ্য অবিলম্বে যুদ্ধবিরতি এবং ইউক্রেন থেকে সমস্ত রাশিয়ান বাহিনী প্রত্যাহার করা।
একদিকে সৈন্য লেলিয়ে আর অন্যদিকে পারমানবিক অস্ত্রের বোতামে আঙুল রেখে পুতিন আসলে কতটুকু শান্তি চান, সেটাই বড় প্রশ্ন। 'বানরের পিঠা ভাগের মতো' পরিস্থিতি জেনেও ইউক্রেন আলোচনায় বসে প্রমাণ করেছে যে, তারা শান্তি চায়।
শুধু রুশ বা ইউক্রেনের জন্যেই নয়, কৃষ্ণসাগরের তীরে শান্তির প্রতিষ্ঠা সারা বিশ্বের কাছেই ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। সামরিক, রাজনৈতিক বা ভূ-কৌশলগত দিকের চেয়েও অর্থনৈতিক কারণে শান্তি অধিকতর পরিহার্য এই আন্তর্জাতিক বাণিজ্য রুটে। প্রসঙ্গত, যুদ্ধের প্রাথমিক ধাক্কায় চলাচল ও নিরাপত্তা হুমকির কারণে সৃষ্ট সঙ্কটে লাফিয়ে বাড়ছে জ্বালানি তেল এবং বিভিন্ন নিত্যব্যবহার্য সামগ্রী। করোনাকালের চরম আর্থিক মন্দা ও বেকারত্বের পটভূতিতে ইউক্রেনে রুশ আগ্রাসন যেভাবে বৈশ্বিক অর্থনীতির বিপদঘণ্টা বাজাচ্ছে, তাতে আগ্রাসী করোনাভাইরাসের আরেক নিন্দিত সহোদর রূপে পুতিনের মুখচ্ছবি চিত্রিত হচ্ছে মানবতা হন্তারক হিটলারের আদলে।
চলমান বৈশ্বিক মহামারি করোনাকালের বিপর্যস্ত মানবিক, আর্থিক, জীবনধারণের সঙ্কুল পরিস্থিতিতে রুশ প্রেসিডেন্ট যে কাণ্ডটি করলেন, তা বিশ্ববাসীকে হতবিহ্বল করেছে এবং হিটলারের দানবীয় বিভীষিকার কথাই বিশ্ববাসীকে মনে করিয়ে দিয়েছে। অপ্রস্তুত একটি শান্তিবাদী, নিরীহ দেশকে তিনদিক থেকে সাড়াশি আক্রমণে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করেছে পুতিনের রুশ বাহিনী, হিটলারের আক্রমণাত্মক আচরণের সঙ্গেই তুল্য।
ভাবতে অবাক লাগে, একবিংশ শতকের বিশ্বায়নের আবহে বহুত্ববাদী সম্মিলিত বৈশ্বিক সমাজের কাঠামোটি বার বার আঘাত প্রাপ্ত হচ্ছে মধ্যযুগীয় বর্বরতায়, যে অন্ধকার মধ্যযুগ হাজার বছর আগে পেছনে ফেলে আলোকিত পৃথিবীর মানব সম্প্রদায় এগিয়ে এসেছে সভ্যতার শান্তিপূর্ণ পথে। কিন্তু মানুষের অগ্রসরমান সুসভ্য সভ্যতাকে এখনও আক্রান্ত করছে পশ্চাৎপদ মধ্যযুগীয় সশস্ত্র তাণ্ডব।
যে ইউরোপে একদা বিদেশি খেদাও বলে বীভৎসতা করছে জেনোফোবিয়া আর মার্কিন মুলুকে বর্ণবাদ হুঙ্কার দিয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যে গোত্র ও গোষ্ঠী হত্যা করছে পরস্পরকে। দক্ষিণ এশিয়ায় জাতিগত সহিংসতায় মরছে রোহিঙ্গারা। ভারতে রণধ্বনি দিচ্ছে সাম্প্রদায়িকতা। চীনে সংখ্যালঘু নিধনের মচ্ছব চলছে। সেখানে আবার বড় মাছ কর্তৃক ছোট মাছ গিলে খাওয়ার 'মাৎস্যন্যায়' চলছে পুতিনের মতো দানবের দ্বারা, যারা ক্ষুদ্র ও দুর্বল প্রতিবেশী রাষ্ট্রকে নিমর্মভাবে সংহার করতে উদ্যত।
এ কোন্ পৃথিবীর কুৎসিত চিত্র দেখতে পাচ্ছি আমরা এই অতি-অগ্রসর, অতি-উন্নত, প্রযুক্তি, যুক্তি ও বিজ্ঞানের পৃথিবীতে? মনে হচ্ছে মধ্যযুগের শক্তির রণহুঙ্কারের নৃশংসতা ফিরে আসছে। ফ্যাসি ও নাৎসিবাদের রক্তলোলুপ দানবেরা আবার নতুন পরিচিতি ও অবয়বে ধেয়ে আসছে শান্তির সবুজ পৃথিবীতে!
যে হানাহানি, হিংসা, ঘৃণা, রক্তপাতের অন্ধ-অন্ধকার পেছনে ফেলে মানব সভ্যতা এগিয়েছে, সেই সভ্যতাকে পুনরায় আঘাত করেছে যুদ্ধবাজ, দানবীয় অপশক্তি। এই আঘাত শুধু একটি রাষ্ট্র, অঞ্চল বা জাতির বিরুদ্ধে নয়, তাবৎ মানবজাতির বিরুদ্ধে, মানবতার বিরুদ্ধে। বিশ্বের যেকোনও প্রান্তে, যে কোনও শহরে এই আঘাত করা হলেও তা ক্ষত-বিক্ষত-রক্তাক্ত করে পৃথিবীর প্রতিটি মানুষের মানবিক আত্মা ও শরীরকে। যে কারণে ইউক্রেনে রুশ আগ্রাসনে সারা বিশ্ব সংক্ষুব্ধ, উদ্বিগ্ন ও মর্মাহত।
ইতিহাস বলছে, হানাহানির পথে মৌর্য সম্রাট অশোক হয়েছিলেন ঘৃণিত। কলিঙ্গের যুদ্ধে লক্ষাধিক মানুষের মৃত্যুর কারণ হয়েছিলেন তিনি। পরিতাপে সব ছেড়ে অহিংসার পন্থা অবলম্বন করেই তিনি হতে পেরেছিলেন ইতিহাসখ্যাত মহামতি শাসক।
তথাপি, চেঙ্গিস, হালাকু, কুবলাই খানদের নির্মমতা তাদেরকে রেখেছে ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে। হিটলার, মুসোলিনির সঙ্গী হয়ে বিশ্বরাজনীতির পুতিনের মতো খলনায়কগণ আজও বহন করছে সেই নির্মমতার স্বাক্ষর এবং বিশ্বমানবতার ধিক্কার।
তারপরও শক্তিমত্তা, হিংসা, সন্ত্রাস এবং ঘৃণার রাজনীতি থেমে থাকেনি বরং বার বার সভ্যতার বুকে আঘাত করছে আর সুসংস্কৃতিপরায়ন মানবসত্তাকে ভাসিয়ে দিচ্ছে রক্ত, মৃত্যু, কান্না, আহাজারির নির্মমতায়। পৃথিবীর দিকে দিকে গৃহহারা মানুষ, নিগৃহীত রমণী, আশ্রয়হীন শিশুদের কাতর মুখে লেগে আছে সেইসব বর্বরদের আঘাতের শতচিহ্ন, যার সর্বশেষ বলি শান্তি ও সৌন্দর্যময় দেশ ইউক্রেন।
শক্তির বলে, ধর্মের নামে, বর্ণের নামে, রাজনীতির নামে এইসব যুদ্ধংদেহী মধ্যযুগীয় তাণ্ডবতা যারা করে, তারা মনুষ্যত্বের কলঙ্ক। হীন স্বার্থে মহত্তম মানবিকতাকে নিহত করে নিজের নোংরা মতলব চরিতার্থ করাই এইসব নিকৃষ্টদের নিন্দনীয় উদ্দেশ্য। এরা মানুষ, মানবতা ও পৃথিবীর শত্রু।
যে বা যারাই, যেখানেই, মানুষ ও মানবতার বিরুদ্ধে এহেন অপরাধ করে থাকুক, তা তীব্র নিন্দার ও প্রতিবাদের বিষয়। শক্তি, ঘৃণা, সন্ত্রাস ও হিংসার রাজনীতিকে সর্বদাই বইতে হবে ধিক্কার। আপাত বিজয়ী হলেও তাদেরকে থাকতে হবে ইতিহাসের নরককুণ্ডে।
এটাই ইতিহাসের শিক্ষা। এবং এটাও ইতিহাসের শিক্ষা যে, ইতিহাসের এই সুশিক্ষাটি সময় থাকতে অনেকেই গ্রহণ করেনা। গ্রহণ করে, রক্তের নদী, বিভাজন, অপরিসীম ধ্বংস, শোক ও সন্তাপ পেরিয়ে চূড়ান্তভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পর।
ঘৃণা, সন্ত্রাস ও হিংসার পৃষ্ঠপোষকতায় যে রাষ্ট্র, রাজনীতি ও রণনীতি আজকের এই অগ্রগামী পৃথিবীর কোথাও কোথাও পুতিন এবং যারা যারা গ্রহণ করছেন, তাদের শেষপ্রাপ্তিতে ভয়ঙ্কর ক্ষতি ছাড়া আর কিছুই থাকবে না। তাদের সামনে পড়ে থাকবে বেদনার মহাভারত, ধ্বংসের চিহ্নবাহী কুরুক্ষেত্র, স্বজনের মরদেহ, বুকভরা বিলাপ আর আত্মদংশনের কাতরতায় নিত্য-পরাজিত জীবনের দুর্বহতার কঠিন পরিস্থিতি।
কারণ, যুদ্ধবাজ 'ওয়ারলর্ড'দের ভাগ্যে শেষ পর্যন্ত সচরাচর যা ঘটে, তা হল, হয় তারা নিহত হন, অথবা তারা আত্মহত্যা করেন। তবে তারা পৃথিবী, মানবতা এবং সভ্যতার অনেক কিছুই ভেঙে চুরমার করে দিয়ে যান এবং ধ্বংসস্তূপের পাশের আস্তাবলে নিজের শেষ ঠাঁই খুঁজে পান!