জনগণ মৌলিক পরিবর্তনের জন্য তৈরি

  • ফরহাদ মজহার
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

কবি, সমাজ চিন্তক ফরহাদ মজহার। ছবি: সংগৃহীত

কবি, সমাজ চিন্তক ফরহাদ মজহার। ছবি: সংগৃহীত

‘জুলাই বিপ্লব’ বা ‘আগস্ট বিপ্লব’ ইত্যাদি নানা নামে বলা হচ্ছে বটে, তবে এর রাজনৈতিক চরিত্রটা বোঝা আমাদের বিশেষভাবে জরুরি। এই বিপ্লব মর্মের দিক থেকে ব্যক্তির স্বাধীন সত্তা এবং রাজনৈতিক আত্মমর্যাদা প্রতিষ্ঠার বিপ্লব। ব্যক্তির অধিকার ও পূর্ণ স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠার জন্যই এই অভ্যুত্থান। এটা কোনো সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব নয়। কীভাবে ‘রাজাকার’ বলায় তরুণরা অপমানিত বোধ করেছে। আমাদের ছেলেমেয়েরা অভ্যুত্থানটা করে ফেলতে পেরেছে। এটা দেখে আমি অভিভূত।

প্রথমত, এটা অসাধারণ ঘটনা। অভূতপূর্ব, সব অর্থেই। ভূ-রাজনীতি, বিশ্ব ইতিহাস, স্থানীয় রাজনীতি- সবদিক থেকেই এটা একেবারে নতুন ধরনের ঘটনা। ইউরোপে ফরাসি বিপ্লব হয়েছে। যেখানে ফিউডাল শ্রেণিকে পরাস্ত করে বুর্জোয়ারা ক্ষমতায় এসেছে। এখানে কিন্তু আরও বড় ঘটনা দেখতে পাচ্ছি। একটা ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র গড়ে তোলা হয়েছিল। নিউ লিবারেল ইকোনমিক অর্ডারের মাধ্যমে একে গড়ে তোলা হয়েছে। সিকিউরিটির অজুহাতে একটা হিংস্র রাষ্ট্র আমরা দেখেছি, র‍্যাব তৈরি করা হয়েছে, নির্যাতনের বহুরকম পদ্ধতি বের করা হয়েছে। ফলে এই গণ-অভ্যুত্থান তো হওয়ারই কথা!

বিজ্ঞাপন

বিএনপিকে বোঝানো দরকার, জনগণ মৌলিক পরিবর্তনের জন্য তৈরি। বিএনপি বারবার ভুল করছিল এবং বারবার পিছিয়ে পড়ছিল। তারা কখনো রাজনীতিকে- অর্থাৎ জনগণের রাজনৈতিক চেতনা ও আকাঙ্ক্ষাকে প্রাধান্য দেয়নি। তারা সব সময় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন চেয়েছে। জনগণ যে মৌলিক পরিবর্তন চায়, এটা কেন তারা বোঝেনি, সেটা এখনো আমার কাছে রহস্য।

এখন আমাদের একসঙ্গে কাজ করতে হবে। এই অভ্যুত্থানের শুরুতে বিএনপি কিছুটা বিভ্রান্ত থাকলেও পরে তারা বিচক্ষণ একটা পজিশন নিয়েছে। এখন তারা বর্তমান সরকারকে সময় দিতে চেয়েছে। তারা যদি ভিন্ন অবস্থান নেয় তাহলে প্রতিবিপ্লবীরা শক্তিশালী হতে পারে। আমি দীর্ঘদিন খালেদা জিয়ার কাছাকাছি থাকায় তার রাজনৈতিক বাসনা বা ইচ্ছা বুঝতে পারতাম। তিনি কী চাইছেন, এই অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সেটা আবারও প্রমাণ হলো।

বিজ্ঞাপন

জনগণ যখন একটা দেশ স্বাধীন করেছে তখন আপনি জনগণকে বলবেন, তোমরাই এমন একটা গণপরিষদ নির্বাচিত কর যাতে তোমরা তোমাদের রাষ্ট্র গঠন করতে পার। যেখানে আমরা স্বাধীন বাংলাদেশে স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশ হিসেবে নতুনভাবে ‘গঠনতন্ত্র’ প্রণয়ন করব।

আমাদের জনগণ কোথায় বলেছে যে, তারা ‘বাঙালি জাতীয়তাবাদ’ চায়? কোথায় বলেছে তারা ‘ধর্ম নিরপেক্ষতা’ চায়? কোথায় বলেছে যে তারা ‘সমাজতন্ত্র’ চায়? শেখ মুজিবের ছয় দফার মধ্যে এসব ছিল? কী এগুলো? ’৭২-এর সংবিধান ছিল একদিকে প্রণয়ন প্রক্রিয়ার দিক থেকে পাকিস্তানিদের রচিত সংবিধান। কারণ, পাকিস্তানের সংবিধান রচনার জন্যই তাদের নির্বাচিত করা হয়েছিল। অন্যদিকে সেটা ছিল ইন্ডিয়ানদের বাংলাদেশে শাসন করার কলোনিয়াল হাতিয়ার। লিগ্যালি ছিল পাকিস্তানিদের আর পলিটিক্যালি ছিল ইন্ডিয়ানদের সংবিধান। এই সংবিধানকে তো অবশ্যই ছুড়ে ফেলে দিতে হবে। এত বছর পর যখন সুযোগ এসেছে এখনো কেন তারা এটি ছিঁড়ে ফেলেনি, সেটাই সন্দেহের।

ড. ইউনূস হচ্ছেন পিপলের সভারেন পাওয়ার বা জনগণের সার্বভৌম ক্ষমতার প্রতিনিধি। অতএব, তিনি এখন যা কিছু বলেন বা আদেশ দেন, সেটাই কিন্তু আইন-লিগ্যালি এবং পলিটিক্যালি। এখন উকিলরা প্রতিবিপ্লব করার জন্য যে তর্কটা করে সেটা হলো সংবিধান ছাড়া কি দেশ চলবে? ইংল্যান্ড কীভাবে চলে? সেখানে তো কোনো লিখিত সংবিধান নেই। বাংলাদেশের যেসব উকিল এই ষড়যন্ত্রের সঙ্গে যুক্ত, তাদের আমি সাবধান করে দিচ্ছি, আমাকে বুঝিয়ে বলতে হবে, ইউকে সংবিধান ছাড়া কীভাবে চলে? বিশ্বের বহু দেশ আছে সংবিধানই নেই। আসলে সংবিধান বা তথাকথিত আইন সব সময়ই সমাজে থাকে। সেটা লিখিত থাকতে হবে তার কোনো যুক্তি নেই। এই অভিপ্রায়েরই নির্বাচিত প্রতিনিধি হচ্ছেন ড. ইউনূস। তাকে ঘিরে জনগণের ইচ্ছাটা অলিখিত রূপে আছে। এটাকে এখন লিখিত রূপ দিতে হবে। এটাই মূল ব্যাপার।

আমি জনগণের পক্ষে কথা বলব। আমি সরকারের প্রতিনিধি নই। ড. ইউনূস শুধু ঘোষণা দিয়ে বলবেন, এখন যা কিছু আইন আমাদের সমাজে আছে বা চলে আসছে তাদের সব আইনই নতুন বাংলাদেশ বহাল থাকবে। যেসব আইন আন্তর্জাতিক মানবাধিকারের সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ এবং সাংঘর্ষিক- সেগুলো বাতিল হয়ে যাবে। এই ঘোষণার ভিত্তিতে বিচারপতিরা নতুন গঠনতন্ত্র প্রণয়ন অবধি বিচার চালাবেন, আদালত চলবে, সব প্রশাসন চলবে।

যে তরুণরা বিপ্লবের মাধ্যমে তাকে সামনে নিয়ে এসেছেন, তাদের বিপ্লবী গার্ড হিসেবে রাখা যেতে পারে- যেন কেউ প্রতিবিপ্লব করতে না পারে। প্রতিবিপ্লব যদি আমরা ঠেকাতে চাই তাহলে দ্রুত ড. ইউনূসের হাতে সব ক্ষমতা দিতে হবে। এটা গণ-অভ্যুত্থানের সরকার। বাংলাদেশের তরুণরা তো একটা অ্যান্টি কলোনিয়াল অ্যান্টি ইম্পেরিয়ালিস্ট মুভমেন্টের সঙ্গে জড়িত। দীর্ঘকাল তারা ফ্যাসিজমের বিরুদ্ধে লড়াই করেছে। জেন-জিদের পক্ষে এই ধরনের বিপ্লব ঘটানো অসম্ভব। বিপ্লব করেছে তারাই, যারা সমাজ, ইতিহাস ও বস্তবতা সম্পর্কে জানে।

বিএনপি এবং জামায়াত অত্যন্ত ভালো পজিশন নিয়েছে। জামায়াতে ইসলামীর পজিশন আরও ভালো। তারা বলছে, আমরা জনগণের জন্য কাজ করি, তাদের ভালোর জন্য কাজ করি। ফলে এ সরকার যতদিন ভালো কাজ করবে আমরা তাদের সঙ্গে থাকব। আমরা ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য ব্যস্ত হয়ে যাইনি। হেফাজতে ইসলামের নেতাদের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। তারা বলেছেন, যেভাবেই হোক এই সরকারকে রক্ষা করতে হবে।

প্রথমত চাই, ব্যক্তিস্বাধীনতা হরণ করার অধিকার রাষ্ট্রের থাকবে না, ব্যক্তির মর্যাদা ক্ষুণ্ণ করা যাবে না। দ্বিতীয়ত চাই, মানুষের জানমাল, জীবিকা রক্ষা করবে রাষ্ট্র। তৃতীয়ত চাই, আমাদের প্রাকৃতিক যত সম্পদ আছে, জনগণ সেই সম্পদের মালিক। এই সম্পদ যেন কোনোভাবে বিষাক্ত না হয়, বিদেশি শক্তি লুট করতে না পারে সেটা নিশ্চিত করতে হবে। এই সম্পদকে একটা শক্তিশালী অর্থনীতির ভিত্তি হিসেবে রূপান্তর করাই এখনকার কাজ। এর পর আদালত, প্রশাসন কীভাবে চলবে ঠিক করতে হবে।

গণভবন থেকে পাহারা তুলে নেওয়ার কোনো কারণ ছিল না। এটা কেন তুলে নেওয়া হলো? আমার প্রশ্ন আছে এখানে। গণভবন, বঙ্গভবন বা আমাদের আরও যত রাষ্ট্রীয় স্থাপনা আছে সেখান থেকে কি পাহারা তুলে নেওয়া যায়? মব তৈরি করা হয়েছে। এটা যারা আমাদের শত্রু হয়তো তারা করতে পারে। শেখ মুজিবের ৩২ নম্বরের মিউজিয়াম পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। শেখ মুজিবের প্রতি ঘৃণা থাকতে পারে, কিন্তু তার ওখানে মিউজিয়াম থাকলে সমস্যা কী? পোড়ানো হলো কেন?

ডক্টর ইউনূস ঢাকেশ্বরী মন্দিরে গিয়ে কী সুন্দর একটা কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, সবার আগে আমরা মানুষ। আপনারা কে হিন্দু কে মুসলমান, কেন ভাগ হয়ে যান? আমরা তো একটা পরিবার। এই পরিবারটা রক্ষা করতে হবে। এই পরিবারে ঝগড়া-বিবাদ থাকতে পারে। এই বোধটুকু আমাদের জাগিয়ে তোলা প্রয়োজন। আমাদের বুকের ক্ষত বিশাল, এটা সহজে শুকাবে না। এই সময়টায় আমাদের ঠাণ্ডা মাথায় কাজ করতে হবে।

আমরা দীর্ঘকাল থেকে এই ফ্যাসিজমের সমালোচনা করছি, বাকশাল থেকে এই হাসিনা সরকার পর্যন্ত। ধীরে ধীরে পিপলকে এডুকেট করেছি। পলিটিক্যাল এডুকেশন যে এরকম একটা পরিস্থিতিতে যেতে পারে, এটা তিনি অনুমান করতে পারেননি। তিনি আমাদের অপমান করেছেন।

কিন্তু পলিটিক্যাল এডুকেশন তো সমাজের বিশাল একটা অংশ পেয়ে গেছে। এটা তিনি ধরতে পারেননি।

আমি একতরফা বিচারের পক্ষে নই। আমি নেলসন ম্যান্ডেলার লোক। ট্রুথ অ্যান্ড জাস্টিস কমিশনের সবচেয়ে ভালো দিকটা হচ্ছে আমরা সত্যটা জানব। সত্য যখন আমরা জানি, তখনই কিন্তু জাস্টিস হয়। সত্য যখন আমরা জানি না, তখন আপনাকে আমি যতই শাস্তি দিলাম, তখন মনে হয় শাস্তিটা ঠিক হয়নি। ডক্টর ইউনূস বা আমাদের ছাত্ররা যদি তাকে চান আমার তো কিছু বলার নেই।

লেখক: কবি, সমাজ চিন্তক, মানবাধিকার কর্মী ও পরিবেশবাদী

খবরের কাগজ’র সৌজন্যে