র‌্যাগিং, যাদবপুর ও আমাদের সচেতনতা

, যুক্তিতর্ক

ড. মাহফুজ পারভেজ | 2023-09-01 20:01:10

কলকাতার লোকজন আমাকে বলেছেন, যাদবপুরের নাম আগে ছিল জাভেদপুর। তথ্যটি বিশ্বাসযোগ্য। কারণ, আশেপাশের এলাকাগুলোর নাম এখনও একবালপুর, সলিমপুর রয়েছে। দেশভাগের আগে দক্ষিণ কলকাতার এসব অঞ্চল ছিল মুসলিম অধ্যুষিত। রাজনৈতিক পালাবদলের তোড়ে দিনে দিনে জনচরিত্রের মতো এলাকার নামও বদলে হয়ে গিয়েছে জাভেদপুর থেকে যাদবপুর।

যাদবপুর এখন মশহুর বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য। পশ্চিমবঙ্গ তো বটেই, ভারতের মধ্যে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় অগ্রগণ্য। লেখাপড়ার মানে, মুক্তচিন্তায়, প্রগতিশীলতায় যাদবপুর ক্যাম্পাস অগ্রণী। একদা বামদের শক্ত ঘাঁটি যাদবপুরে হিন্দুত্ববাদী সাম্প্রদায়িক শক্তি খুব একটা সুবিধা করতে পারেনি। মোটের উপর বিশ্ববিদ্যালয়টি গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, উদারনৈতিক বৈশিষ্ট্য বজায় রেখে চলেছে।

এহেন যাদবপুর এখন সংবাদ শিরোনামে। র‌্যাগিং নামক ঘটনার কারণে। রাষ্ট্রীয় স্তরে স্বৈরাচারী আধিপত্যবাদের নখদাঁত যখন চার দিকে ত্রাসের সঞ্চার করছে, ঠিক তখনই ঘরের কাছে আর এক স্বৈরাচারী আধিপত্যবাদের উৎকট প্রকাশ সজোরে ধাক্কা দিল সমাজকে। যাদবপুরের হোস্টেলে নাকি মুক্তমনা, প্রগতিপন্থী সব ছাত্রের বাস, তাদেরই হাতে এক নবাগত ছাত্রের হত্যা! আধিপত্যবাদী হয়েছে তারাই, যারা নাকি প্রকাশ্য মাঠেময়দানে আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে খুবই সরব।

কখনও এমন দাবি করা হয় যে, নবাগত ছাত্রদের সামাজিক জড়তা ভাঙা, সিনিয়রদের সঙ্গে সুসম্পর্ক তৈরি করায় নাকি তা সহায়ক। এমনটা সত্যি কখনও হতে পারেনা। আমির খান, কারিনা কাপুর, বোমান ইরানি অভিনীত ও রাজকুমার হিরানি পরিচালিত ব্লকব্লাস্টার সিনেমা 'থ্রি ইডিয়টস' যারা দেখেছেন, তারা অন্তত র‌্যাগিং-এর সুফল বলে কিছু আছে বিশ্বাস করতে পারবেন না।

ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের র‌্যাগিং বিরাট আলোড়ন তুললেও এবং সবার নজরে এলেও এটাই সত্যি যে, বাংলাদেশের বহু প্রতিষ্ঠানে এটি একটি বিষবৃক্ষ-তুল্য। বহু শিক্ষার্থীর শারীরিক ও মানসিক ক্ষতি হয়েছে এ সমস্যার কারণে। অনেক পরবর্তী জীবন বিষিয়ে গিয়েছে এই দুঃস্বপ্নের ছোবলে।

র‌্যাগিং সমস্যার সঙ্গে জড়িয়ে আছে রাজনৈতিক ও সমাজতাত্ত্বিক কার্যকারণ। আধিপত্য বিস্তার ও বলপ্রয়োগের কর্তৃত্ববাদী মানসিকতার গর্ভে এই অবক্ষয় ও অনাচারের জন্ম। আর কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় যেহেতু সমাজের বাইরে কোনও বিচ্ছিন্ন দ্বীপ নয়, সেহেতু সমাজের অন্ধকার বিষয়গুলো কুপ্রভাব সেখানেও প্রকট।

অবশ্যই এসব কথা বলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এমন ঘটনার দায় সম্পূর্ণভাবে এড়াতে পারে না। এই সমস্যাটাকে নির্মূল করতে না পারলেও তাকে প্রতিহত করার প্রত্যক্ষ দায়িত্ব কর্তৃপক্ষের ছিল বা আছে। কেন প্রতিবাদী ছাত্ররা, ন্যায়ের পক্ষাবলম্বী শিক্ষকরা র‌্যাগিং নিয়ে হইচই করেননি ও তা দমনে সচেষ্ট হন নি, এমন প্রশ্ন উঠবেই। হয়তো অনেক শিক্ষক জানতেনই না কতটা কী ঘটে চলেছে। বাংলাদেশের ক্যাম্পাস ও হলগুলো কেমন বিভীষিকা বিরাজমান, সেটা অনেকে জানেন না বা না-জানার ভাণ করেন। যখন কোনও ছাত্র বা ছাত্রী চরম নির্যাতনের চিত্র উপস্থাপন করেন, তখনই কেবল কর্তৃপক্ষের 'বিবেক' নড়েচড়ে মাত্র। তারপর পরিস্থিতি আগে যা ছিল, তা-ই হয়।

আসলে যাদবপুর বা এ ধরনের ঘটনাকে নিন্দা করে কিংবা রাজনৈতিক স্বার্থে না-দেখার ফন্দিফিকির করে সমস্যার সমাধান হবে না। এজন্য প্রয়োজন সৎসাহস, প্রতিকার ও সচেতনতা। বরং বলা ভালো, স্বচেতনতা। যেখানে থাকবে আত্মসমীক্ষা ও আত্মমর্যাদা, নযা অপরের মর্যাদা ও নিরাপত্তাকে নিরঙ্কুশ করতে পারবে।

সমাজব্যবস্থার ক্ষমতাকাঠামোতে এবং মানবপ্রকৃতিতে আধিপত্যবাদের একটি দিক যে প্রবলভাবে আছে, তা অনস্বীকার্য। কিন্তু সেই সামাজিক মানুষের মধ্যেই ভালবাসা ও পারস্পরিকতার সম্পর্কসূত্র বিরাজমান, যা মানুষ হিসাবে আমাদের মর্যাদাবান, ঐশ্বর্যময় ও পাশবিকা থেকে মুক্ত করে।

ফলে মানুষ রূপে নিজের মধ্যে ও আশেপাশে মনের অন্ধকারকে পরাভূত করে আলোটাকে জ্বালিয়ে রাখার সচেতন ও স্বচেতন দায়িত্ব নিতেই হয়। মানুষ হিসাবেই এমন মানবিকতা পালনের নৈতিক দায়িত্ব প্রতিটি মানুষেরই রয়েছে। এই দায়িত্ব পালন না করলে অবক্ষয় ও সমস্যা বাড়বেই। র‌্যাগিংও বাড়তেই থাকবে।

বলার অপেক্ষা রাখেনা, যাদবপুরের কিছু কিছু ছাত্র র‌্যাগিং-এর অপরাধে অপরাধী। সুতরাং তাদের কী ভুল হয়েছিল, তা শনাক্ত করে সংশোধনের পন্থা বের করতে হবে। ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বহীনতা ও শৈথিল্যকেও চিহ্নিত করে প্রতিকারের পথে যেতে হবে। ছাত্র হলেই সাতখুন মাফ নয়, বরং তাদেরকেও বিধিবদ্ধ আইনের অনুশাসনে রাখতে হবে। অবশ্যই নজরদারি বাড়াতে হবে। প্রয়োজনে সিসি ক্যামেরা দিয়ে নজরদারি করতে হবে।

এসব হয়তো ব্যক্তিগত স্বাধীনতা ও গোপনীয়তা হ্রাস করবে। কিন্তু সামগ্রিক স্বার্থে এগুলো মেনে নেয়া ছাড়া উপায় নেই। তবে, সিসি টিভির পর্দায় ঘটনার প্রতিফলন দেখার আগে অবশ্যই আয়না সামনে দাঁড়িয়ে নিজেদের চেহারাটাও দেখতে হবে এবং নিজেদের ভেতরকার পশুত্ব আর অমানবিকতাকে সাফসাফাই করতে হবে সর্বাগ্রে।

ড. মাহফুজ পারভেজ, প্রফেসর, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়; অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম; নির্বাহী পরিচালক, চট্টগ্রাম সেন্টার ফর রিজিওনাল স্টাডিজ, বাংলাদেশ (সিসিআরএসবিডি)।

এ সম্পর্কিত আরও খবর