কী কথা তাহার সাথে?

, যুক্তিতর্ক

কবির য়াহমদ | 2023-10-13 15:21:44

রূপসী বাংলার কবি জীবনানন্দ দাসের অমর কবিতা ‘আকাশলীনা’। এমন মানুষ খুব কমই আছে যারা শুনেনি কিংবা আওড়ায়নি—‘সুরঞ্জনা, ওইখানে যেওনাকো তুমি,/বোলোনাকো কথা ওই যুবকের সাথে’; অথবা ‘কি কথা তাহার সাথে? তার সাথে’ লাইনগুলো।

বাংলাদেশের নির্বাচনকে উপলক্ষ্য করে হঠাৎ করে ঢাকাস্থ মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের তৎপরতা লক্ষ্য করে জীবনানন্দের কবিতার নির্দিষ্ট ওই লাইনগুলো বারবার মনে পড়ছে। বাংলাদেশিদের জন্যে আমেরিকার ভিসানীতির পর পিটার হাসই যেন এখন দেশের ক্ষমতা নির্ধারণের প্রধান ব্যক্তি। তার বাসায়-দপ্তর কিংবা নানা জায়গায় তার সাক্ষাতে যেভাবে লাইন ধরছেন রাজনৈতিক ও রাজনীতি-ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিরা তাতে বারবার প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করছে— ‘কি কথা তাহার সাথে? তার সাথে!’ তাকে যেভাবে আলোচনায় রাখা হয়েছে, অথবা নিজেকে তিনি যেখানে নিয়ে যাচ্ছেন তাতে মনে হচ্ছে পরের নির্বাচনে কারা ক্ষমতায় আসছেন, সেটা বুঝি তিনিই নির্ধারণ করবেন! অবাক লাগছে; অস্বস্তিও! অস্বস্তির কারণ রাজনৈতিক নয়, আত্মসম্মানের অথবা দেশের সম্মানের।

এমনিতেই আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্বের অধিকাংশই পশ্চিমাদের প্রতি বিনত। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে এই বিনত কিংবা নতজানু প্রবণতা আরও বেড়েছে। বিশেষ করে সরকারবিরোধী রাজনৈতিক নেতৃত্বের। ভোট ও মাঠের রাজনীতিতে বেকায়দায় থাকা সরকারবিরোধী অংশ এই মুহূর্তে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে পশ্চিমাদেরকেই তাদের শেষ আশ্রয়স্থল ভাবছে। অপেক্ষায় আছে নানামুখী নিষেধাজ্ঞার। নিষেধাজ্ঞা দিয়েই কেবল আওয়ামী লীগকে ঠেকানো যাবে—এমনই বিশ্বাস তাদের।

ক’মাস আগে আমেরিকা যখন বাংলাদেশের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ভিসানীতি দিয়েছিল তখন সরকারবিরোধী অংশের প্রকাশ্য উল্লাস আমরা দেখেছি। এই উল্লাস এখনো আছে, যদিও সরকার রাজনৈতিকভাবে তার কিছুটা মোকাবিলা করেছে। তবু আছে। এই অপেক্ষা, অথবা আশাবাদের বিএনপির মাঠের আন্দোলন অনেকটাই স্তিমিত হয়ে পড়েছে। আন্দোলনের চাইতে বিদেশিদের কাছে ধর্না দেওয়াটাই রুটিনওয়ার্ক এখন তাদের। তারিখ ঘোষণা করে সরকার পতনের ঘোষণা, ব্যর্থ হওয়ার পর বিদেশিদের মুখাপেক্ষী হয়ে যাওয়া—এটা আর যাই হোক আত্মসম্মান প্রকাশ করছে না বলে আমরা মনে করছি।

সুষ্ঠু নির্বাচন ও গণতন্ত্রের কথা বলে আমেরিকার যে ভিসানীতির উল্লেখ, সেটা ইতোমধ্যেই প্রয়োগ শুরু হয়ে গেছে। মার্কিনীরা জানিয়েছে সুষ্ঠু নির্বাচনে যারা বাধা দেবে সে সংশ্লিষ্টদের ভিসা নিষেধাজ্ঞা দিচ্ছে তারা। এই তালিকায় আছে গণমাধ্যম সংশ্লিষ্টরাও। ফলে আমেরিকার ভিসাপ্রত্যাশীদের অনেকের মাঝে কিছুটা হলেও উৎকণ্ঠা শুরু হয়ে গেছে। যে আমেরিকার ভিসা চায়নি কখনোই তার মধ্যেও এনিয়ে আলোচনা, যে আমেরিকার ভিসা চাওয়ার আশাও করেনি, তাদের মাঝেও এই উৎকণ্ঠা। উৎকণ্ঠা নামের এই রূপক-রোগ সংক্রামক প্রায়, গ্রাস করছে সকল স্তরকেই। 

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শুরু থেকেই আমেরিকার ভিসানীতি উদ্ভূত উদ্বেগকে তুড়ি মেরে ওড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছেন। ২২ ঘণ্টা বিমান ভ্রমণ করে আমেরিকা না গেলে কী হয়, বাংলাদেশের জনগণও তাদের নিষেধাজ্ঞা দেবে—এমন নানা কথা বলেছেন। তাঁর আশঙ্কা নির্বাচন নিয়ে আমেরিকা যতটা না আগ্রহী তারচেয়ে বেশি আগ্রহী ষড়যন্ত্রে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আব্দুল মোমেনও বলছেন, প্রয়োজনে বাংলাদেশও নিষেধাজ্ঞা দেবে। নিষেধাজ্ঞা দিয়ে আমেরিকা কোথায় গণতন্ত্র এনেছে—এ প্রশ্নও করছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী। এদিকে, প্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী যখন ঝাঁঝাল ভাষায় কথা বলছেন, আপসের বাইরে আত্মসম্মানের কথা বলছেন, তখন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও প্রভাবশালী মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের ভাষা ভিন্ন। তাঁর ভাষায়—তলে তলে আপস হয়ে গেছে। তিনি এও বলছেন—পিটার হাসের মুরুব্বিদের সঙ্গে নাকি তাদের আপস হয়ে গেছে! তলে তলে আপসের এই বক্তব্য প্রকাশ্য সমাবেশে দিয়ে তৃপ্ত হয়েছেন যদিও ওবায়দুল কাদের, তবে শেষে তিনি বলেছেন এসব নাকি জনগণ খায়! এটা কি মানুষের মনস্তত্বকে সূক্ষ্ম উপহাস নয়?

আমেরিকা তাদের ভাষায় সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্যে বাংলাদেশের জন্যে ভিসানীতি দিয়েছে, নিষেধাজ্ঞা দেবে বলছে—প্রকৃত অর্থে এগুলো আমাদের জন্যে অপমানজনক বিদেশি পদক্ষেপ। হ্যাঁ, আমরা আমাদের দেশে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন চাই। একই সঙ্গে চাই বিদেশি হস্তক্ষেপমুক্ত নির্বাচন। আমাদের সীমাবদ্ধতা আছে, নির্বাচন প্রক্রিয়া-পদ্ধতি নিয়ে আমাদের দেশে অস্বস্তি আছে, বিতর্ক আছে; কিন্তু এগুলো আমাদের ব্যর্থতা, আমাদের সংকীর্ণতা কিংবা সীমাবদ্ধতা। এই সীমাবদ্ধতা আছে বলেই কি আমরা আত্মসম্মান হারাতে যাব? ঘরের সমস্যায় বাইরে লোক ডেকে আনব?

২০০৮ সালের নির্বাচনের পরের দুটো নির্বাচন নিয়ে নানা আলোচনা আছে। এখানে সরকারদল আওয়ামী লীগের একপাক্ষিক জয় হয়েছে, বিরোধীরা পাত্তা পায়নি, কিংবা তাদেরকে সুযোগ দেওয়া হয়নি। এখানে কেবল সরকার দলকে দোষারোপ না করে বিরোধীদেরও সীমাবদ্ধতা-সমস্যাকে আলোচনায় রাখা দরকার। বিরোধীদল শক্তিশালী না হলে সরকারে গিয়ে তারা কী করবে? সমস্যাসংকুল বিশ্বপরিস্থিতিতে তারা কি আদৌ প্রস্তুত? একটা দলকে যে নেতৃত্ব সঠিকভাবে পরিচালিত করতে পারছে না, তারা কি পারবে দেশকে সুন্দরভাবে চালাতে? ছোট্ট পরিসরে যারা অসফল, তারা কীভাবে বৃহৎ পরিসরে সাফল্যের আশা করে?

বিএনপিসহ বিরোধীদলগুলো সরকারের বিরুদ্ধে প্রবল গণআন্দোলন গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয়েছে। এখন তারা তাদের ব্যর্থতা আড়াল করতে আমেরিকার মুখাপেক্ষী হয়েছে। রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের কাছে ধর্না দিচ্ছে। আমেরিকা কি তবে বাংলাদেশের মালিক? আমেরিকা কি তবে নির্ধারণ করবে বাংলাদেশ কোন পথে যাবে? এখানে আমেরিকাকে ‘সালিশি পরিষদ’ গণ্য করার সুযোগ নাই, কারণ তারা সালিশি পরিষদ না হয়ে ‘মালিকপক্ষ’ হতে আগ্রহী।

 

গতকালও একটা বিষয় চোখে লেগেছে। আমেরিকার রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের বৈঠক এবং পরে অস্বীকার। বিএনপির মিডিয়া উইংয়ের পক্ষ থেকে প্রথমে বৈঠকের কথা বলা হয়েছিল। এনিয়ে দেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশ হয়েছিল। এরপর মির্জা ফখরুল সেই বৈঠকের তথ্য অস্বীকার করেছেন। তাঁর এই অস্বীকার নানা প্রশ্নের জন্ম দিচ্ছে। কেন তিনি অস্বীকার করছেন? আবার বৈঠক না হলে আগে কেন বিএনপি বৈঠকের তথ্য জানিয়েছিল? কেন এত গুরুত্ব আমেরিকার এক রাষ্ট্রদূতকে? আমেরিকা নিজেদের স্বার্থে বাংলাদেশের নির্বাচনে হস্তক্ষেপ করতে চাইছে, অথবা নির্বাচন আয়োজনকে প্রশ্নে ফেলে ভণ্ডুল করতে চাইছে। তাদের অতীত এবং সাম্প্রতিক বৈশ্বিক ইতিহাস শান্তির নয়, গণতন্ত্রের নয়; কর্তৃত্বের, দখলদারত্বের।

শিখ নেতা হারদিপ সিং নিজ্জার হত্যার পেছনে ভারত সরকারের হাত থাকতে পারে এমন মন্তব্য করে সম্প্রতি বোমা ফাটিয়েছেন কানাডায় প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো। তাঁর এই মন্তব্যের পর ভারত-কানাডার সম্পর্কের টানাপড়েন সৃষ্টি হয়েছে। কূটনীতিক প্রত্যাহারের ঘটনাও ঘটেছে। মুখোমুখি অবস্থায় পৌঁছেছে ভারত ও কানাডা। দেশে নরেন্দ্র মোদির প্রবল সমালোচনা-বিরোধিতা থাকা সত্ত্বেও দেশটির সকল রাজনৈতিক নেতৃত্ব-গণমাধ্যম মোদিকে না দেখে ভারতের স্বার্থ দেখেছিল। কারণ ওখানে মোদি ব্যক্তি নন, তিনি ভারতের প্রতিনিধি। ব্যক্তিস্বার্থকে অপ্রধান করে দেশের স্বার্থকে প্রাধান্য দেওয়ার যে নজির দেখিয়েছে ভারত, সেটা দূর অতীতের ঘটনা নয়, সাম্প্রতিক। আমাদের প্রতিবেশী দেশের এই অবস্থা আমাদের দেশে প্রভাব ফেলতে পারেনি।

হ্যাঁ, আমেরিকা-বাংলাদেশের সম্পর্ক সে পর্যায়ে যায়নি এখনো। এখনো কূটনীতিক প্রত্যাহার-বহিষ্কারের ঘটনা ঘটেনি। কিন্তু নিষেধাজ্ঞার শুরু করে আমেরিকা যার শুরু করেছে, তাতে প্রধানমন্ত্রী-পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ইঙ্গিতকে গভীরভাবে দেখলে মনে হয় বাংলাদেশের জন্যে চূড়ান্ত অপমানজনক কিছু হলে সীমিত সামর্থ্য নিয়ে হলেও কঠিন হতে পারে বাংলাদেশ। এমন অবস্থায় গেলে দেশের সবাই কি ঐক্যবদ্ধ হবে? মনে হয় না! ক্ষমতাই যেখানে ধ্যানজ্ঞান সেখানে কি দেশের অপমানকে বিবেচনায় নেবে কেউ?

আমাদের নির্বাচন, আমাদের সমস্যা, আমাদের সম্ভাবনা নিয়ে আমরা নিজেরাই সিদ্ধান্ত নিতে চাই। এখানে কেউ পরামর্শ দিতে পারে, কিন্তু পরামর্শের নামে হস্তক্ষেপ একদিকে যেমন অসৌজন্যমূলক, তেমনি অন্যদিকে আমাদের জন্যে অপমানজনক। এই অপমান আমাদের মাথায় রাখা উচিত। ভিসা নিষেধাজ্ঞার নামে আমেরিকার বর্তমান যে ভূমিকা সেটা আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্বের কারণেই প্রকাশ্য হস্তক্ষেপের দিকে যাচ্ছে। রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের দৌড়ঝাঁপ সবটাই কি কূটনৈতিক শিষ্টাচারের মধ্যে থাকছে—সে দিকে দৃষ্টি দেওয়া দরকার।

শিষ্টাচার অতিক্রম করে যদি কোন পক্ষ, তবে আমাদের সেই পক্ষকে এড়িয়ে যাওয়া উচিত। আত্মসম্মান বোধের জাগরণ ঘটানো উচিত। জীবনানন্দের ভাষায়—‘বোলোনাকো কথা ওই যুবকের সাথে’। কবিতার রূপক-অর্থের ওই যুবকের সঙ্গে কথা না বলে নিজেদের সীমাবদ্ধতাকে কাটিয়ে জনতাকে সর্বোত ক্ষমতার মালিক ভেবে তাদেরকে সঙ্গে নিয়ে এগিয়ে যাওয়া উচিত। 

‘ফিরে এসো এই মাঠে, ঢেউয়ে;/ ফিরে এসো হৃদয়ে আমার;/ দূর থেকে দূরে— আরো দূরে/ যুবকের সাথে তুমি যেওনাকো আর’।

এ সম্পর্কিত আরও খবর