২৮ অক্টোবর: দলীয় শক্তির মহড়া, নির্বাচন ও গণতন্ত্রের অগ্নিপরীক্ষা

, যুক্তিতর্ক

ড. মাহফুজ পারভেজ | 2023-10-25 11:31:30

রাজনীতি, বিশেষত আগামী নির্বাচন নিয়ে মতপার্থক্যে লিপ্ত দলগুলো অবশেষে দলীয় শক্তি প্রদর্শনের পথই বেছে নিল। অনেক দিন বাকযুদ্ধের পর সরকার ও বিরোধী পক্ষ ২৮ অক্টোবর রাজধানী ঢাকার উন্মুক্ত রাজপথে শক্তির মহড়ায় অবতীর্ণ হতে যাচ্ছে। সর্বত্র শঙ্কার ঘূর্ণাবর্ত: কি হবে ২৮ অক্টোবর?

সতর্ক হলে আশঙ্কা ও অনিশ্চয়তা এড়ানো এবং দলগুলোর দ্বৈরথ রোধ করা সম্ভব ছিল। সংলাপ ও আলোচনার পথে বিরোধ মীমাংসার একটি পথও হয়ত খুঁজে পাওয়া যেত। দেশি-বিদেশি নানা মহল থেকে বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোকে বারংবার 'যুযুৎসা'র কবল থেকে মুক্ত হতে এবং শান্তির পথে আসতে যারপরনাই আর্জি জানানোও হয়েছিল। সবকিছুই অরণ্যের রোদনে পর্যবসিত হয়েছে। একগুঁয়ে মনোভাবে রাজনীতি চলে গেছে মধ্যযুগীয় মল্লযুদ্ধের অস্থির প্রান্তরে। ফলশ্রুতিতে, দলীয় শক্তির আসন্ন মহড়ার কারণে অগ্নিপরীক্ষার মুখে নিপতিত হয়েছে গণতন্ত্র। নির্বাচনে অংশগ্রণ ঘিরে দেখা দিয়েছে অনিশ্চয়তা।

তাত্ত্বিক ভাষায় রাজনৈতিক দলকে বলা হয় রাজনৈতিক ব্যবস্থার 'লাইফ লাইন' বা 'জীবন রেখা'। কেননা, রাজনৈতিক দল ছাড়া গণতন্ত্র ও নির্বাচন অচল। রাজনৈতিক দলগুলোই গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে ভোটের মাধ্যমে হাত ধরাধরি করে এগিয়ে নিয়ে চলে। কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলোর ঝগড়াফসাদে খোদ গণতন্ত্র ও নির্বাচন কোণঠাসা হয়ে অগ্নিপরীক্ষার মুখে পড়লে তার দায় কার উপর বর্তাবে? অবশ্যই রাজনৈতিক দলের উপর। কারণ, গণতন্ত্র অর্জন করা এবং গণতন্ত্র সুসংহত ও রক্ষা করার দায়িত্ব জনগণ রাজনৈতিক দলগুলোকেই অপর্ণ করে। ফলে গণতন্ত্রকে বিপদে ফেলে, এমন কিছু করা রাজনৈতিক দলগুলোর এখতিয়ারের বাইরে। নির্বাচনকেও ব্যাহত করা গণতন্ত্রের জন্য বিপদজনক। এসব বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোকে সদা সতর্ক থাকতে হয়।

অতএব, ২৮ অক্টোবর দলীয় শক্তির মহড়ায় গণতন্ত্র যদি অগ্নিপরীক্ষার মুখে পড়ে এবং নির্বাচন যদি অনিশ্চিত হয়, তাহলে গণতন্ত্র ও নির্বাচন ব্যবস্থাকে নিরাপদ রাখার দায়দায়িত্ব রাজনৈতিক দলগুলোকেই নিতে হবে। কোনও রাজনৈতিক দলের কোনও কর্মকাণ্ডে গণতন্ত্রের কোনও ক্ষতি হলে বা নির্বাচন ব্যাহত হলে, সে দায়ভার সংশ্লিষ্টদেরই নিতে হবে।

নির্বাচন ও গণতন্ত্রের স্বার্থে বরং আলাপ-আলোচনা ও সমঝোতার পথে চললে পরিস্থিতি অগ্নিগর্ভ হয়ে ২৮ অক্টোবরের আসন্ন স্নায়ুচাপের উত্তেজনা দেশময় ছড়াতে পারতো না। ২৮ অক্টোবর নিয়ে ভীতি, আতঙ্ক আর আশঙ্কাও বিস্তৃত হতে পারতো না। নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির গণতান্ত্রিক আবহে এসব উত্তেজনা নানা বিপদের অভিমুখ খুলে দিতে পারে। বিপদের বদলে শান্তির পথে থাকাই সকলের জন্য কল্যাণকর হতো। কিন্তু এই সরল সত্যটিকে অবজ্ঞা করে দলগুলো যেভাবে রণহুংকারে মাঠে নেমেছো, তাতে সমগ্র দেশবাসীই উৎকণ্ঠিত। এই উৎকণ্ঠার অবসান না হলে সামনের পরিস্থিতি আরও বিপদাত্মক হওয়ার আশঙ্কাও তৈরি হয়। একের পর এক নানামুখী আশংকা গণতন্ত্র ও নির্বাচন তো বটেই জনগণের জন্যেও সুখকর নয়।

একইভাবে নির্বাচনী সন্ত্রাসের বিষয়টিও কাম্য নয়। কারণ তা গণতন্ত্রকে ভূলুণ্ঠিত করে। তবে, গণতন্ত্রের অর্থ এখন আর কেবল ভোটাধিকার এবং সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসনের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। গণতন্ত্র একটা স্পেস, একটা ভাবনা, একটা আদর্শ— যা নিজের বিপরীত কিছুকে স্বীকৃতি দিতে এবং তাকে গ্রহণ করতে শেখায়। ভিন্ন মত, ভিন্ন রুচি-সহ সব রকমের ভিন্নতাকে স্বীকৃতি দিতে শেখায়। একই সঙ্গে, গণতন্ত্র ক্ষমতার একচ্ছত্র কর্তৃত্বের বিকেন্দ্রীকরণের কথা বলে।

পাশ্চাত্যে এই গণতন্ত্র যেমন নিজের রাষ্ট্রের সঙ্গে লড়াই করে বুঝে নেওয়া অধিকার, উত্তর-ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রগুলোর ক্ষেত্রে এই গণতন্ত্র উপনিবেশ-বিরোধী লড়াইয়ের ফসল হিসাবে ঔপনিবেশিক শাসন মুক্তির সঙ্গেই সমান্তরাল ভাবে এসেছে। গণতন্ত্র আসলে কোনও ‘ওয়ান টাইম ইনভেস্টমেন্ট প্রজেক্ট’ নয়। গণতন্ত্রেরও নিজস্ব ওঠাপড়া থাকে। তাই, দলসমূহ ও নাগরিকেরও দায়িত্ব থাকে হুঙ্কারের বদলে ক্রমাগত তার উপর নজর রাখার। সমাজ ও রাষ্ট্রজীবনে নাগরিকের সচেতন যোগদান গণতন্ত্রের যথাযথ অভিমুখ নির্ধারণ করতে পারে এবং গণতন্ত্রকে ঘিরে পুঞ্জিভূত অনিশ্চয়তার অবসান হতে পারে।

ড. মাহফুজ পারভেজ, প্রফেসর, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়; অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম; নির্বাহী পরিচালক, চট্টগ্রাম সেন্টার ফর রিজিওনাল স্টাডিজ, বাংলাদেশ (সিসিআরএসবিডি)।

এ সম্পর্কিত আরও খবর