২৮ অক্টোবরের ফলাফল চর দখলের রাজনীতির ব্যর্থ মহড়া?

, যুক্তিতর্ক

লুৎফে আলি মহব্বত | 2023-10-28 19:59:02

অনেক বড় ক্ষতি হতে পারতো লক্ষ লক্ষ মানুষের উতপ্ত উপস্থিতির কারণে। ভিন্ন ভিন্ন মতের এতো বিপুল জনসমাগম সামগ্রিকভাবে শান্তিপূর্ণ হবে বলে অনেকেই আশা করেনি। তারপরেও বিচ্ছিন্ন কিছু সংঘাত-সংঘর্ষের মধ্যে একজন পুলিশ সদস্যের দুঃজনক মৃত্যু হয়েছে। আরও কিছু বিচ্ছিন্ন নাশকতার ঘটনা ঘটলেও বড় কোনও বিপদ হয়নি। এটাই আপাতত স্বস্তিকর। তবে, আশঙ্কার বিষয় হলো, ২৮ অক্টোবর গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার পরীক্ষিত পন্থা আলাপ, আলোচনা, সংলাপ ও সমঝোতার বদলে চর দখলের রাজনীতির একটি ব্যর্থ মহড়া দিয়ে গেলো।

১৭ বছর আগে ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবরের দুঃসহ স্মৃতিকে বিবেচনায় নিলে ২০২৩ সালের ২৮ অক্টোবর হাল্কার উপর দিয়ে গিয়েছে। যদিও ২৮ অক্টোবর আওয়ামী লীগ ও বিএনপির রাজনৈতিক কর্মসূচিকে ঘিরে আশঙ্কা ছিল জনমনে। ছিল টানটান উত্তেজনা। উৎকণ্ঠা। অনিশ্চয়তা।

তবে এবারের ঘটনাপ্রবাহে ছিল বিদেশি দেশগুলোর পরোক্ষ তৎপরতা। বিশেষত, যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ বিদেশি পর্যবেক্ষকদের নজর রাখছে মনে করে দলগুলো ছিল কৌশলী। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ছিল তুলনামূলক সংযত। ফলে সব মিলিয়ে ২৮ অক্টোবরের কর্মসূচি নিরাপত্তার বিবেচননায় ভালোয় ভালোয় শেষ হয়েছে।

ভালোর মধ্যেও কিছু মন্দ এড়ানো সম্ভব হয়নি কোনও কোনও পক্ষের অতিউৎসাহী আচরণের কারণে। সারাদিন উত্তেজনার মধ্যেও যখন সবকিছু ঠিকঠাক ছিল, তখন বেলা দুইটার দিকে নয়া পল্টনে পরিস্থিতি খারাপ হতে শুরু করে। পাশের কাকরাইলে, বিজয়নগরে খণ্ড খণ্ড সংঘর্ষ ছড়িয়ে যায়। কিছু ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনাও ঘটে। এক পর্যায়ে পুলিশ উপর্যুপরি টিয়ার শেল, সাউন্ড গ্রেনেড ছুড়ে ছত্রভঙ্গ করে বিএনপির জমায়েত।

বরাবরের মতোই কী কারণে সংঘাত শুরু হলো তার পরিষ্কার কোনও ভাষ্য পাওয়া যায়নি। বদলে পারস্পরিক দোষারোপের পালা শুরু হয়। বিএনপি বলেছে, আওয়ামী লীগ তাদের আগে ধাওয়া দিয়েছিল। আওয়ামী লীগ বলেছে, বিএনপি প্রথমে আক্রমণ করেছে। পুলিশ বলেছে, বাধ্য হয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে তারা অ্যাকশনে যেতে বাধ্য হয়েছে।

বিএনপিকে এমতাবস্থায় ভাঙা সমাবেশে সন্তুষ্ট হয়ে কর্মসূচি গুটিয়ে নিতে হয়েছে। মাঠদখলের এতো আয়োজন করে এবং এতেগুলো মানুষকে ঢাকায় ডেকে এনে দলটি কি পেলো? এসব কথা তো তারা সাংবাদিক সন্মেলন ও দলীয় সভা থেকেই বলতে পারতেন। গণতান্ত্রিক রাজনীতির আরও অনেক শান্তিপূর্ণ পদ্ধতিতে দাবি আদায়ের পথে এগিয়ে যেতে পারতো বিএনপি। বিশাল আয়োজন সামাল দিতে না পারায় এবং যৌক্তিক পরিণতিতে পৌঁছাতে ব্যর্থ হওয়ায় বিএনপি নেতৃত্বের প্রতি কর্মী-সমর্থকদের আস্থায় ভাটা পড়তে পারে। ভবিষ্যতে দলের ডাকে লোকজন কতটুকু উৎসাহ দেখাবে, তাও বলা মুস্কিল।

আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকায় সন্ত্রাস ও শক্তি প্রয়োগের ঝুঁকি নেয় নি। সফলভাবে নিজেদের কর্মসূচি সম্পন্ন করে সাংগঠনিক দক্ষতা ও জনসমর্থনের প্রমাণ রেখেছে। দলীয়ভাবে বিরূপ সমালোচনার সম্মুখীন হওয়ার বিষয়গুলোকে সচেতনভাবে এড়িয়ে যেতে সফল হয়েছে আওয়ামী লীগ।

উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সবচেয়ে সুচতুর আচরণ করেছে জামায়াতে ইসলামী। অনুমতি না পেলেও বু্দ্ধিমত্তার সঙ্গে সমাবেশ করেছে তারা। শক্তি প্রদর্শন ও সংঘর্ষে লিপ্ত হওয়ার অবস্থা থেকে গা বাঁচিয়ে আগেভাগে সমাবেশ শেষ করে নির্বিঘ্নে সরে গেছে জামায়াত। ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবরের রক্তপাতের মতো কোনও দায় এবার তারা তাদের কাঁধে সচেতনভাবেই নেয়নি।

ফলে মূল চাপ গেছে বিএনপির উপর দিয়ে। কর্মী-সমর্থকদের নিয়ন্ত্রণে রেখে শান্তিপূর্ণভাবে সমাবেশই শেষ করতে পারেনি দলটি। তারা সংঘর্ষ করেছে নাকি সংঘর্ষের উস্কানি বা ফাঁদে পা দিয়েছে, সে প্রশ্নের চেয়ে বড় হয়ে দেখা দিয়েছে সফলভাবে কর্মসূচি সমাপ্ত করতে না পারার ক্ষেত্রে বিএনপির ব্যর্থতার বিষয়টি।

মোদ্দা কথায়, ২৮ অক্টোবরের যাবতীয় রাজনৈতিক তৎপরতার ফলাফল চর দখলের রাজনীতির ব্যর্থ মহড়া হয়ে থাকলো। গণতন্ত্রের উত্তরণের পথে কোনও ইতিবাচক বার্তা বহন করতে পারলো না। ফলে গণতন্ত্র ও ভোটের অধিকারের জন্য আন্দোলন যে চর দখলের রাজনীতির পথে সফলতা পাবে না, সংলাপ-সমঝোতা-আলোচনার মাধ্যমেই লাভবান হবে, এই সত্যটিই আরেকবার স্পষ্টতর হল।

লুৎফে আলি মহব্বত: বিশ্লেষক। কন্ট্রিবিউটিং করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম।

এ সম্পর্কিত আরও খবর