অগ্নিগর্ভ রাজনীতি: 'এই ধ্বংসের দায়ভাগে আমরা দুজনে সমান অংশীদার'

, যুক্তিতর্ক

ড. মাহফুজ পারভেজ | 2023-10-31 12:58:25

'কে সংঘাতপ্রবণ', এই বিচার করতে করতে দেশ অগ্নিগর্ভ হয়ে পড়েছে। বিপুল সমাবেশকে শান্তিপূর্ণ রাখতে না পেরে সংঘাতের ফাঁদে পা গলিয়েছে বিএনপি। তাদের দীর্ঘ বছরের লালিত শান্তিপূর্ণ আন্দোলন এখন সরকার কর্তৃক আরোপিত 'সন্ত্রাসমূলক' অভিযোগে বিদ্ধ। দলটির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে রাজনীতির অবসান ঘটছে ২৮ অক্টোবর প্রদোষকালে। পরবর্তীতে তরমা লাগানো হয়েছে 'ক্রাইম সিন'-এর।

মুদ্রার আরেক পিঠে ২৮ অক্টোবরের শক্তি ও সংঘাতের রাজনীতির প্রলম্বিত ছায়াপাত ঘটেছে। পরবর্তীতে হরতালসহ বিএনপির তিন দিনের অবরোধে জ্বালাও পোড়ায়ের ঘটনা ঘটে চলছে। বিপুল গ্রেফতার আর প্রচুর মামলা ছাড়াও পুলিশের গুলিতে প্রাণহানি হয়েছে। আওয়ানী লীগ মাঠে আছে সরবে। নির্বাচন ও সুষ্ঠু রাজনীতির জন্য ফলপ্রসূ সংলাপ ও সমঝোতার পথের দিকে না গিয়ে বিএনপিকে ঠেকাতে সংঘাতের ফাঁদে যদি ধীরে ধীরে আওয়ামী লীগও পা দেয়, তাহলে কার লাভ? তখন কে কাকে অভিযুক্ত করবে?

এদিকে, ২৮ অক্টোবর বিএনপির মহাসমাবেশ ঘিরে ঢাকায় সংঘটিত সহিংসতা ও প্রাণহানির ঘটনার পুঙ্খানুপুঙ্খ তদন্তের জন্য কর্তৃপক্ষের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। এতে দায়ী ব্যক্তিদের জবাবদিহিতারও দাবি জানিয়েছে দেশটি। অনুরূপভাবে, বাংলাদেশে রাজনৈতিক সমাবেশকে ঘিরে সহিসংতা ও প্রাণহানির ঘটনায় উদ্বেগ জানিয়েছেন জাতিসংঘ মহাসচিব আন্থোনিও গুতেরেস। তিনি সব পক্ষকে সহিংসতা, অতিরিক্ত বলপ্রয়োগ বা নির্বিচারে আটক করা থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানিয়েছেন।

গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, যথারীতিভাবে, লজ্জা ও পরিতাপকে সর্বাঙ্গে জড়িয়ে বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবী ও সুশীল সমাজ এখন পর্যন্ত মৌনব্রত পালন করছেন। হাজার হাজার মাইল দূর থেকে শান্তির পক্ষে ও সংঘাতের বিরুদ্ধে কথাবার্তা চললেও 'মেড ইন বাংলাদেশ' বু্দ্ধিজীবীদের মুখে কুলুপ। মাঠে, ময়দানে, এমনকি বিবৃতি বা কলাম থেকেও তারা নিরাপদ দূরত্বে রয়েছেন। অথচ এরাই বাণী ও বচনে দেশের প্রধান মিডিয়ার কাঁধে বসে জাতিকে জ্ঞান দেন।

একমাত্র ব্যতিক্রম অর্থনীতিবিদ ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ। যিনি তার সহপাঠী, আটক বিএনপি নেতা মীর্জা ফখরুলের প্রসঙ্গ টেনে বিদ্যমান পরিস্থিতি সম্পর্কে কিছু কথা বলেছেন। তাঁর সামান্য তৎপরতায় কথিত বুদ্ধিজীবীদের প্যাসিভ চরিত্র পাপমুক্ত হয় না। পাপ অবশ্য এদের থেকে মুক্ত হতে পারে না। বরং খোদ 'পাপ'কেই হজম করে ফেলতে পারেন না। বাংলাদেশের রাজনীতির মতোই বুদ্ধিবৃত্তিক বলয়ে চলছে নৈরাজ্য।

ফলে সঙ্কট সমাধানে সততার সঙ্গে কেউ এগিয়ে আসার মনোবল দেখাতে পারেন না। সমঝোতার জন্য মাঝখানে দাঁড়ানো হিম্মত দেখানোর ঘটনা তো অকল্পনীয় ও দূরস্থিত। এমনকি 'উটপাখি' কবিতায় সুধীন্দ্রনাথ দত্ত'র মতো এতটুকু বলার সাহসও কারো নেই: "আমি জানি এই ধ্বংসের দায়ভাগে/আমরা দুজনে সমান অংশীদার।"

অতএব, বরাবরের মতো বিদেশিদের নসিয়ত আমাদের শুনতে হচ্ছে। আর ভবিষ্যতে সবকিছু শান্ত ও স্বাভাবিক হলে শুনতে হবে ধেড়ে, পাতি ও সিকি বুদ্ধিজীবীর বাগাড়ম্বর!

ড. মাহফুজ পারভেজ, প্রফেসর, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়; অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম; নির্বাহী পরিচালক, চট্টগ্রাম সেন্টার ফর রিজিওনাল স্টাডিজ, বাংলাদেশ (সিসিআরএসবিডি)।

এ সম্পর্কিত আরও খবর