নির্বাচন ও পাকিস্তানে গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ

, যুক্তিতর্ক

ড. মাহফুজ পারভেজ | 2024-02-07 19:52:28

২০২৪ সালে বিশ্বের ৭৮ দেশে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ায় এ বছরকে বলা হচ্ছে নির্বাচনের বছর। গণতন্ত্রের সবচেয়ে বড় উৎসব নামে পরিচিতি নির্বাচন হলেও বিশ্ব কর্তৃত্ববাদের কবল থেকে মুক্ত হতে পারবে কিনা, তা নিয়ে রয়েছে সংশয়। বিশেষ করে, ক্ষয়িষ্ণু গণতন্ত্রের দেশগুলো নিয়ে এমন আশঙ্কা প্রবল। যে দেশগুলোর মধ্যে পাকিস্তান অন্যতম। বৃহস্পতিবার (৮ ফেব্রুয়ারি) সেখানে জাতীয় নির্বাচন।

১৯৪৭ সালে দক্ষিণ এশিয়ায় ভারত ও পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম হলেও দেশ দুটির রাজনৈতিক ভাগ্যের গতিপথ ভিন্ন। ভারত সংসদীয় গণতন্ত্রকে বেছে নিলেও পাকিস্তান গণতন্ত্রের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারেনি। পাকিস্তান থেকেছে ফৌজি শাসনের বুটের তলায়। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের সামরিক ও বেসামরিক স্বৈরতন্ত্রের রাহুমুক্ত হয়ে গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষায় বাংলাদেশ স্বাধীন হয়ে গণতন্ত্রকে আলিঙ্গন করলেও পাকিস্তান সেনা ছাউনির অর্গল মুক্ত হতে পারেনি।

জন্মের ৭৭ বছর পর ২০২৪ সালের নির্বাচন পাকিস্তানে গণতন্ত্রের জন্য শুভ বার্তা বয়ে আনবে বলে বিশ্বাস করা দুষ্কর। বিশেষজ্ঞরা এ বিষয়ে যথেষ্ট সন্দিহান। আয়েশা জালাল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের টাফ্টস ইউনিভার্সিটির ইতিহাসের অধ্যাপক, 'জার্নাল অব ডেমোক্রেসি'তে এক লেখায় প্রশ্ন তুলেছেন, 'পাকিস্তানে কি গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ আছে?'

পাকিস্তানে গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ যে অন্ধকারাচ্ছন্ন তার তাজা প্রমাণ হলো, দেশটির জাতীয় নির্বাচনের আগের দিন এক স্বতন্ত্র প্রার্থীর অফিসের সামনে বোমা হামলার ঘটনা। পাকিস্তানের বেলুচিস্তানে সে হামলায় নিহতের সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ১৫ জন এবং এখন পর্যন্ত আহতের সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ৩০ জন। হতাহতের সংখ্যা আরো বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

ধারণা করা হয়, পাকিস্তানে সন্ত্রাস ও অগণতান্ত্রিক ব্যবস্থা জারির বিষয়ে ক্যান্টনমেন্টের প্রচ্ছন্ন মদদ থাকে। গণতন্ত্রকে কাজ করতে না দেওয়ার সব রকমের কৌশল আর্মির জানা। কাকে ক্ষমতায় থাকতে দেওয়া হবে আর কাকে দেওয়া হবে না, এ সিদ্ধান্ত গ্রহণের মালিক দেশের জনগণ নয়, আর্মি। মোদ্দা কথায়, সরকার ও রাজনীতিতে পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর একচ্ছত্র প্রভাবের বিষয়টি 'ওপেন সিক্রেট'।

গণতন্ত্রকে নাজেহাল করতে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী পছন্দের দল বা নেতাকে ক্ষমতায় আনা-নেওয়ার খেলায় সর্বশেষ ভর করেছিলেন সদ্য কারাবন্দী ইমরান খানকে। তাকে নিয়ে আর্মির পরীক্ষা ব্যর্থ হয়েছে। তিনি ক্যান্টনমেন্টের কব্জায় থাকতে রাজি না হওয়ায় ক্ষমতাচ্যুত হয়ে কারাগারে যেতে বাধ্য হয়েছেন। এর আগে, প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ় শরিফকে যখন সুপ্রিম কোর্ট বরখাস্ত করল, তখনও তার পিছনে আর্মির হাত ছিল।

সর্বশেষ পরিস্থিতি পর্যালোচনায় দেখা যায়, প্রথমে সেনাকর্তাদের চোখে ইমরান খান পছন্দসই ব্যক্তিই ছিলেন— পাকিস্তান মুসলিম লিগ (পিএমএল)-এর নওয়াজ় শরিফের তুলনায়। ২০১৩-তে জাতীয় স্তরে পিএমএল(এন) জিতলেও পাখতুন-প্রধান খাইবার পাখতুনখোয়ায় জয় পেল পিটিআই। তার পর থেকেই শুরু হল ইমরান খানের ধর্না, প্রতিবাদ আন্দোলন। তিনি সঙ্গী পেলেন ইসলামি বুদ্ধিজীবী নেতা তাহির-উল-কাদরিকে। নাগরিক সমাজের একাংশে কাদরি ছিলেন বেশ ক্ষমতাশালী, নওয়াজ় শরিফ ও তাঁর ভাই পাঞ্জাব-নেতা শাহবাজ় শরিফের কঠিন প্রতিপক্ষ। তবে খান-কাদরি আন্দোলনের মধ্যেই ঘটে গেল পেশোয়ারে পাবলিক স্কুলে সন্ত্রাসী হানা, যাতে মারা গেল ১৫০টি শিশু। তারপর পরিস্থিতি দ্রুতই আর্মির নিয়ন্ত্রণে চলে আসে।

যে দেশে ‌গণতন্ত্র প্রথম থেকেই সামরিক-নিয়ন্ত্রিত পুতুল, জাতীয় পার্লামেন্টকে বলীয়ান করা সেখানে একটা অতি জরুরি কাজ হওয়ার কথা, তা হয় নি। তার বদলে তৈরি হয়েছে সামরিক শক্তিবলয়। পাকিস্তানে সকলেই জানে এবং মানে যে ক্ষমতায় পৌঁছনোর সহজতম পথ হল সামরিক বাহিনীকে তোষণ করা। এমন পরিস্থিতিতে বৃহস্পতিবার পাকিস্তানে জাতীয় নির্বাচন। কত দূর স্বাভাবিক, নিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক হতে পারে এই ভোট? এই ভোটে গণতন্ত্রের মুখ দেখতে পাবে পাকিস্তান?

প্রশ্ন অনেক। যার উত্তর জানা নেই। গণতন্ত্র হয়তো বহু সামাজিক-অর্থনৈতিক সঙ্কটের মধ্যে তলিয়ে যাওয়া পাকিস্তানকে বাঁচাতে পারতো। আনতে পারতো রাজনীতির স্থিতি ও ভারসাম্য এবং অর্থনীতির গতি। কিন্তু পাকিস্তানের নির্বাচন ও রাজনীতি সামরিক প্রভাব মুক্ত হতে পারবেন কিনা, সেটাই বড় আশঙ্কার বিষয়, যার মধ্যে নিহিত রয়েছে পাকিস্তানে গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ।

ড. মাহফুজ পারভেজ, প্রফেসর, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়; অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম; নির্বাহী পরিচালক, চট্টগ্রাম সেন্টার ফর রিজিওনাল স্টাডিজ, বাংলাদেশ (সিসিআরএসবিডি)।

এ সম্পর্কিত আরও খবর