দুয়োধ্বনির দুর্বৃত্তরা...

, যুক্তিতর্ক

কবির য়াহমদ, অ্যাসিস্ট্যান্ট এডিটর, বার্তা২৪.কম | 2024-02-10 11:53:47

খন্দকার মুশতাক আহমেদ ও সিনথিয়া ইসলাম তিশা নামের দুজনকে দুয়োধ্বনি দিয়ে বইমেলা থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে। বয়সের দিক থেকে বড়ধরনের পার্থক্য থাকলেও সম্পর্কের দিক থেকে তারা স্বামী-স্ত্রী। একজন বইমেলায় পরিচিতিতে লেখকও বটে। নিরাপদে বইমেলা ছাড়তে তাদের সহায়তা করেছে একদল আনসার সদস্য।

গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, ঘটনাটি শুক্রবার (৯ ফেব্রুয়ারি) বিকেলের। বাংলা একাডেমির একুশে গ্রন্থমেলার সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অংশে অন্য লেখকদের মতো দর্শনার্থী অথবা পাঠকদের নিজের বই সম্পর্কে জানান দিচ্ছিলেন খন্দকার মুশতাক আহমেদ। স্টলে ভিড়ও ছিল বেশ। ওই সময় হঠাৎই একদল লোক ভুয়া-ভুয়া, ছি ছি, লুচ্চা-লুচ্চা দুয়োধ্বনিতে সরগরম করে তোলে পরিবেশ। এরপর বাধ্য হয়েই তাদেরকে মেলা প্রাঙ্গণ ত্যাগ করতে হয়।

মিজান পাবলিশার্স নামের প্রকাশনা সংস্থাটি প্রকাশ করেছে খন্দকার মুশতাক আহমেদের ‘তিশার ভালোবাসা’ এবং ‘তিশা এন্ড মুশতাক’ নামের দুটি বই। শুক্রবার দুয়োধ্বনি শোনার আগেও তারা বইমেলায় গেছেন, বই প্রদর্শন করেছেন, বিক্রিতে অংশ নিয়েছেন, পাঠক-দর্শনার্থীদের সঙ্গে সেলফি তুলেছেন। অর্থাৎ কালই যে তাদেরকে বইমেলায় প্রথম দেখা গেল এমন না। ফলে এই যে দুয়োধ্বনি এবং বইমেলা থেকে বের হয়ে যেতে বাধ্য করার ঘটনা, এটা সরলভাবে দেখার সুযোগ কমে আসে। এটা স্রেফ যে কিছু উশৃঙ্খল যুবকের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া ভাবার কারণ নাই। এর সঙ্গে জড়িত থাকতে পারে তৃতীয় কেউ। হতে পারে অন্য কোন প্রকাশনা সংস্থার কেউ, হতে পারে অন্য এক দল লোক যারা অসম বয়েসিদের সম্পর্ককে গ্রহণ করার মত উদারতা শেখেনি।

মুশতাক আহমেদের বয়স ষাট। স্ত্রীর সঙ্গে তার বয়সের পার্থক্য চল্লিশের বেশি বলে গণমাধ্যমের খবর। তারা একে অন্যকে ভালোবেসে বিয়ে করেছেন। রাজধানীর মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের গভর্নিং বডির সদস্য ছিলেন খন্দকার মুশতাক আহমেদ এবং একই কলেজের একাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী ছিল সিনথিয়া ইসলাম তিশা। তাদের সম্পর্ক নিয়ে অনেক আলোচনা হয়েছে। হাইকোর্টে পর্যন্ত গড়িয়েছিল সম্পর্ক। আদালতে নিজের সিদ্ধান্ত নেওয়ার মতো প্রাপ্তবয়স্কের প্রমাণ দিয়েছেন তিশা। পরিবার ছেড়েছেন তবু মুশতাককে ছেড়ে যাননি। তিশার বাবা মোশতাকের বিরুদ্ধে অপহরণ ও ধর্ষণের মামলা করেছিলেন। মেয়ে অপ্রাপ্তবয়স্ক বলে দাবি করেছিলেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে তিশা জানান তাকে অপহরণের ঘটনা ঘটেনি, এবং তিনি প্রাপ্তবয়স্ক হিসেবে কোনোকিছুতে প্ররোচিত না হয়ে স্বেচ্ছায় মুশতাকের হাত ধরেছেন।

মুশতাক-তিশার প্রেমকাহিনি নিয়ে অনেক চর্চা হয়েছে। নিতান্ত অপরিচিত এই জুটি ভাইরাল হয়েছেন। বিভিন্ন মাধ্যমে জানা যাচ্ছে তাদেরকে ঘিরে নাকি লোকজন সেলফি তোলে থাকে। শুরুর দিকে আলোচনা থেকে তারা নিজেদেরকে সরিয়ে রাখলেও একটা সময়ে এসে নিজেরাই প্রকাশিত হয়েছেন। বিভিন্ন মাধ্যমে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। বয়সের দিক থেকে অসম সম্পর্ক হলেও তারা যে সুখী দম্পতি এর প্রমাণ তারা দিতে চাইছেন। বলছেন, তারা বিয়ে করেছেন, পাপ করেননি।

এই জুটি যখন নিজেদের জগতে সুখী তখন তাদের নিয়ে এত মাথাব্যথা কেন মানুষের, কেন এত চর্চা, বইমেলায় কেন তাদের দুয়োধ্বনি দেওয়া? এটা কি তবে ব্যক্তি স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ নয়? তারা বইমেলাসহ যেকোনো জনসমাগমস্থলে যেতে পারেন, এখানে আপত্তি থাকার কথা না কারোর।

মুশতাক-তিশার প্রেম-বিয়েকে মনে-মনে মেনে নাও নিতে পারেন কেউ, কিন্তু এর প্রকাশ করার অধিকার নেই। তারা প্রাপ্তবয়স্ক, এবং বয়সের ক্ষেত্রে অসম সম্পর্ক হলেও তাদের সিদ্ধান্তে হস্তক্ষেপের অধিকার কেউ রাখার কথা না। তারা বই লিখতে পারেন। বই বিক্রি বৃদ্ধিতে বইমেলার স্টলে যেতে পারেন। কারো ইচ্ছা হলে সে বই কিনবে, নয়ত না; কিন্তু তাদেরকে ভুয়া-ভুয়া বলে বইমেলা থেকে বের হতে বাধ্য করার অধিকার কেউ রাখে না। কেমন আছেন তারা—এটা বুঝতে দরোজার ওপাশে কান পাতার অধিকারও কারো নেই। এসব অনধিকার চর্চা। এবং এই চর্চার কোনো অবস্থাতেই সমর্থনযোগ্য নয়।

এমন না যে বাংলাদেশে অসম বয়েসি কোন জুটি বিয়েতে বসে না। অনেক কবি-সাহিত্যিক, রাজনীতিবিদ, প্রবাসী এবং বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের মধ্যে এই চর্চা রয়েছে। যদিও এটা অন্যরকম চর্চা, তবু এই চর্চা মেনে নেওয়ার মতো মানসিকতা থাকতে হবে আমাদের। তা না হলে ব্যক্তিস্বাধীনতা চর্চা বাধাগ্রস্ত হয়, হবে।

মুশতাক-তিশাকে ঘিরে অপ্রীতিকর যে ঘটনা ঘটল কাল অমর একুশে গ্রন্থমেলায় তার প্রভাব কেবল এক ঘটনাতেই সীমাবদ্ধ থাকবে বলে মনে হচ্ছে না। এই ঘটনা আরও অনেক ঘটনার পথ উন্মুক্ত করে দিল। আগামীতে কেউ কাউকে এভাবে কিংবা আরও করুণভাবে বইমেলা থেকে বিতাড়িত করে দিতেও পারে। এটা স্বেচ্ছাচারের পথ উন্মুক্ত করে দিল কিনা এনিয়ে ভাবা উচিত আয়োজকদের।

বইমেলায় প্রকাশনা সংস্থা-সংস্থায় সুস্থ প্রতিযোগিতা থাকা অস্বাভাবিক নয়। অদ্যকার এই ঘটনা যদি কোন প্রকাশকের মাথায় অন্যকে ঘায়েলের অসুস্থ পথ হিসেবে ধরা দেয় তবে এটা কীভাবে রুখে দেওয়া যাবে?

কাল মুশতাক-তিশা দুয়োধ্বনির মুখে পড়ার পর আমরা দেখলাম একদল আনসার সদস্যের সহায়তায় তারা বইমেলা প্রাঙ্গণ ত্যাগ করেছেন। এখানে কেন কর্তৃপক্ষ দুয়োধ্বনি দেওয়া দুর্বৃত্তদের নিবৃত্ত করতে গেল না? তারা কেন ভাবল এই দম্পতিকে বের করে দেওয়াই এর সমাধান? এর মাধ্যমে কি আরও অনেক অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার পথ উন্মুক্ত করে দেওয়া হলো না? এর জবাব দেবে কে? ঘটনার পর এখন পর্যন্ত আয়োজক কর্তৃপক্ষ বাংলা একাডেমি কিংবা পুলিশের বক্তব্য চোখে পড়েনি। তারা কি তবে এটা এড়িয়েই যাবে? এমনটা অনুচিত বলে মনে করি।

বাংলা একাডেমির স্লোগান ‘বাঙালি জাতিসত্তা ও বুদ্ধিবৃত্তিক উৎকর্ষের প্রতীক’। মুক্তচিন্তার লেখকেরা আক্রান্ত হওয়ার পর আগেও বাংলা একাডেমির কোন ভূমিকা আমরা দেখিনি। অর্থবোধক একটা স্লোগান ঝুলিয়ে রেখে বাংলা একাডেমি বিবিধ আয়োজন, পুরস্কার প্রদানের কাজ করে আসছে দীর্ঘদিন ধরে। তাদের কাছে লেখকের স্বাধীনতা, লেখার স্বাধীনতা নিয়ে ভাবনার সময় হয়ত সামান্যই। এবার এখানে সাংগঠনিক কিংবা আয়োজনের দুর্বলতার অংশ হয়ে ওঠেছে মুশতাক-তিশার এই অপমান। কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে বিশৃঙ্খলাকারীদের সনাক্তে প্রশাসনের ভূমিকা চাওয়া হয়নি, বরং আক্রান্তদের মেলা প্রাঙ্গণ ত্যাগ করানোর মাধ্যমে অসহায় আত্মসমর্পণ করা হয়েছে। এটা প্রতিষ্ঠানের স্লোগানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক ভূমিকা কিনা ভেবে দেখার অনুরোধ করি।

মুশতাক-তিশা দুজনই প্রাপ্তবয়স্ক। তাদের সম্পর্ক নিয়ে অনধিকার চর্চা অনুচিত। এই অনধিকার চর্চা মাছের বাজারে হলেও কথা থাকত। এটা হয়েছে বইমেলার মতো জায়গায় এবং এই বইমেলার আয়োজক ‘বাঙালি জাতিসত্তা ও বুদ্ধিবৃত্তিক উৎকর্ষের প্রতীক’ স্লোগানধারী বাংলা একাডেমি!

এ সম্পর্কিত আরও খবর