সমকালীন রাজনীতির দ্বিচারিতা ও রিজভীদের ‘প্রত্যয়’

, যুক্তিতর্ক

আশরাফুল ইসলাম পরিকল্পনা সম্পাদক, বার্তা২৪.কম | 2024-04-02 22:29:59

লোকজ এক প্রবাদ শুনেছিলাম অনেক বছর আগে। একটি আঞ্চলিক পত্রিকার সম্পাদক প্রায়শঃই বলতেন, ‘গাঁজাখোরের বিচার হবে, করবে বিচার আফিম যে খায়’। তাঁর এই উক্তির মর্মার্থ তখন সেভাবে বুঝতে চেষ্টা না করলেও দেশের সমকালীন রাজনীতির হালচাল পর্যবেক্ষণে কথাটি মনে পড়ে গেল। আজ বিএনপি’র সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিব এডভোকেট রুহুল কবির রিজভী রাজধানীর নয়াপল্টনে দলীয় কার্যালয়ের সামনে এক কর্মসূচিতে দেশের অখণ্ডতা রক্ষার প্রশ্নে কঠিন প্রত্যয় জানিয়ে বলেছেন, ‘বাংলাদেশকে আরেকটি কাশ্মীর হতে দেবেন না’।

সরল বিচারে কথাটি নিয়ে বলতেই হয়, মুক্তিযুদ্ধ করে স্বাধীনতা পাওয়া বাংলাদেশ কেন আরেকটি কাশ্মীর হতে যাবে? যে দলের নেতা হিসেবে তিনি এই হুঁশিয়ারি দিলেন সেই বিএনপি রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থাকাকালেই আমরা দশ ট্রাক অস্ত্র নিয়ে দেশকে ‘আফগানিস্তান বা পাকিস্তান’ করার প্রচেষ্টা দেখেছি। আলোচিত সেই দশ ট্রাক অস্ত্র ধরা পড়ার পর বিচারে তৎকালীন সরকারের শীর্ষ ব্যক্তিদের জড়িত থাকার প্রমাণ বেরিয়ে এলে এটি দৃশ্যমান হয়ে উঠে যে দেশের রাজনীতিতে কারা সার্বভৌমত্বের হুমকি।

নিঃসন্দেহে আমাদের সমকালীন রাজনীতির গুণগত মান কিংবা রাজনীতিবিদদের নৈতিকতা নিয়ে সাধারণের অনেক প্রশ্ন আছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই জনতুষ্টি অর্জনে রাজনীতিবিদরা ব্যর্থ, এটি অস্বীকার করা যাবে না। কিন্তু দেশের কোন রাজনীতিবিদ যখন সার্বভৌমত্ব রক্ষার প্রশ্ন তুলেন তখন নৈতিক জায়গা থেকে তার রাজনৈতিক দলের অবস্থান সেই বিষয়ে স্ববিরোধী কিনা তা নিয়েও প্রশ্ন থেকে যায়। সুশাসন এবং সামাজিক ও অর্থনৈতিক সমতায়নের যে জনদাবি রাজনীতিবিদদের কাছে মানুষ প্রত্যাশা করে তা নিয়ে আমরা কেউই ভিন্নমত নই। যৌক্তিকভাবে এসব মৌলিক দাবির স্বপক্ষে সরকার বিরোধী দলগুলি অব্যাহত আন্দোলন-সংগ্রাম করবে। রাজনৈতিক দলগুলির এ ধরণের ক্রিয়াকলাপের মধ্য দিয়ে শ্যাডো সরকারের ভূমিকা পালন করা হয়। এ ধরণের বিরোধিতায় জনগণ লাভবানই হয়।

ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণের বিরুদ্ধে এই অঞ্চলের চিরপ্রতিবাদী মানুষেরা নিজেদের স্বাধিকার-স্বায়ত্বশাসন কিংবা চূড়ান্ত পরিণতি হিসেবে ‘পূর্ণ স্বরাজের’ দাবিতে বহু যুগ ধরে লড়াই সংগ্রাম করেছে। জনগণের হৃদয় উৎসারিত সেই সংগ্রাম-প্লাবনে ঔপনিবেশিক দানবরা হার মেনেছে। স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম ও পরবর্তী যুগে দেশের রাজনৈতিক ক্রমবিকাশের যে পরম্পরা তাতে লড়াই সংগ্রামের এই প্রবণতা বজায় থেকেছে সব সময়। কিন্তু সমকালীন রাজনীতিকে কিছুতেই আমাদের ঐতিহ্যিক পরম্পরার সঙ্গে মেলাতে পারছি না।

একজন রুহুল কবির রিজভীই যে এমন অর্বাচীন মন্তব্য করেন তা কিন্তু নয়। এই সময়ে রাজনীতির মাঠে-ময়দানে এমন অন্তঃসারশূন্য বক্তব্য আমরা প্রায়শই শুনি। এতে করে মোটাদাগে দুইটি বিষয় স্পষ্ট হয়ে ধরা দেয়; প্রথমতঃ রাজনীতির মানুষদের অন্তঃসারশূন্যতা, দ্বিতীয়তঃ প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার প্রবণতা, তা যে পন্থাতেই হোক না কেন। তৃতীয়তঃ জনস্বার্থের চেয়ে ক্ষমতায় আরোহণের তীব্র আকাঙ্খা।

দেশের অপরাপর রাজনৈতিক দলগুলির মতো বিএনপি ও এর নেতৃত্বের মাঝেও এইসব প্রবণতা প্রকট হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশের উন্নত দেশে রূপান্তরে দলগুলি নিজেদের মত করে জনগণকে নানা আশার ফুলঝুরি শুনিয়ে বেড়ান। কিন্তু বর্তমান বিশে^র উন্নত দেশগুলির রাজনীতিবিদদের জ্ঞাননির্ভর ও দূরদর্শী প্রাকটিসের মডেল তারা গ্রহণ করেন না। যদিও আমাদের রাজনীতিবিদরা হরহামেশাই উন্নত দেশে সফর করে বেড়ান। শোনা যায়, অনেকে সেসব দেশে সেকেন্ড হোমও গড়ে তুলেছেন। কিন্তু দূর্ভাগ্য যে সমাজ ও রাষ্ট্রকে এগিয়ে নেয় যে জ্ঞান ও প্রযুক্তি, তা আহরণে বা কাজে লাগানোর কোন সদিচ্ছাই তাদের মধ্যে দেখা যায় না।

আসা যাক মূল প্রসঙ্গে, মহান মুক্তিযুদ্ধে আমাদের অকৃত্রিম বন্ধুরাষ্ট্র ও প্রধান মিত্র ভারত। বাংলাদেশ ও ভারতের ঐতিহাসিক, নৃতাত্ত্বিক ও অভিন্ন ভাষা এবং সাংস্কৃতিক যে গভীর সম্পর্ক তা যেমন ঈর্ষণীয়, তেমনি বিরলও বটে। কিন্তু সেই মধুর সংহতিতে চিড় ধরানোর প্রাণপণ চেষ্টা স্বাধীনতার পর থেকেই প্রবল। ধ্রুব সত্য হচ্ছে, দেশের রাজনৈতিক পরিম-লের একাংশ এই সংহতি মেনে নিতে প্রস্তুত নয়। একাত্তরের হানাদার পাকিস্তানিদের ভাবাদর্শের সঙ্গে তাদের বক্তব্যে ঐকতান খোঁজে পাওয়া যায়। ব্যক্তি ও দলীয় স্বার্থের সঙ্গে সঙ্গে এই বিরোধ বহুলাংশে আদর্শিকও। যার জন্য একাত্তরে গোটা জাতি স্বাধীনতার প্রশ্নে ঐক্যবদ্ধ থাকলেও ক্ষুদ্র একটি অংশ বিপরীত মেরুতে অবস্থান নেয় এবং মাতৃভূমির শত্রুদের সঙ্গে বাঙালি নিধনে শামিল হয়। সেই ক্ষুদ্র অংশটি গেল অর্ধশতাব্দিতে রাজনৈতিক প্রশ্রয়ে অনেক হৃষ্টপুষ্ট হয়েছে, হয়েছে বলবান। সেই কারণেই বাংলাদেশকে কাশ্মীর হতে না দেওয়ার মত অর্বাচীন বক্তব্য আসে।

এই রাজনীতিবিদদের বাস্তবতার সঙ্গে একটুকু যোগ নেই যে, বাংলাদেশের অখ-তা রক্ষা করা ভারতের নিজের প্রয়োজনেই অত্যাবশ্যক। এবং এই অত্যাশ্যক কাজ শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী থেকে শুরু করে প্রতিটি সরকারই করে গেছেন, ভবিষ্যতেও করে যাবেন। দেশটির বিদেশনীতি, আরও স্পষ্ট বললে ‘বাংলাদেশ নীতিতে’ কোনো পরিবর্তন আসেনি; বরং ‘নেইবারহুড ফার্স্ট বা প্রতিবেশী প্রথম’ ধরণের আরও বলিষ্ঠ কর্মসূচি যোগ হয়েছে।

সেখানে ‘দিনে আন্ধা’ টাইপের বক্তব্য দিয়ে সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা বেশিদূর হালে পানি পাবে না, এটাই বলাই যায়। তাই আমাদের সমকালীন রাজনীতিতে গুণগত মান ও দূরদৃষ্টির যে শূণ্যতা প্রকট হয়েছে সেটা কাটাতে দলগুলিকে আরও মনোযোগী হওয়া জরুরি। এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশের স্বপ্নে বিভোর না হয়ে সবার আগে রাজনৈতিক দল ও নেতৃত্বের অন্দরে মানসিকতা এবং মূল্যবোধে আমূল পরিবর্তন প্রয়োজন। কেননা রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তন না এলে উন্নত দেশের রূপান্তরের নেতৃত্ব কিভাবে তৈরি হবে?

এ সম্পর্কিত আরও খবর