বিশ্বশান্তি: ঠিক জায়গাতে অঙ্গুলি নির্দেশ করবে কে?

, যুক্তিতর্ক

ড. মাহফুজ পারভেজ | 2024-06-08 11:42:07

মেরুকরণে বিদীর্ণ পৃথিবী চরমভাবে অভিভাবকহীন হয়ে পড়েছে। কেউই কাউকে গ্রাহ্য না করে নিজ নিজ শক্তিবলয়ের পাগলাঘোড়া দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। ফলশ্রুতিতে মুখ থুবড়ে পড়েছে বিশ্বশান্তি। অকাতরে মারা যাচ্ছে আমজনতা। ঠিক জায়গাতে অঙ্গুলি নির্দেশ করে সমস্যার সুরাহা করতে পারছে কেউই। থামাতে পারছে না বিশ্বব্যাপী রক্তস্রোত ও মৃত্যুর মিছিল।

কিছু সংস্থা আছে, যারা বিশ্বশান্তি, স্থিতি ও নিরাপত্তার কথা বলে। জাতিসংঘ তাদের অন্যতম প্রধান মুখপাত্র। শক্তিতে ও ক্ষমতায় জাতিসংঘের চরম অবক্ষয় ও অধঃপতন হয়েছে। যুযুধান পক্ষগুলো জাতিসংঘকে সামান্যতম পরোয়া করে না। অবলীলাক্রমে অপকর্ম চালিয়ে যায়।

ক্ষেত্র বিশেষে জাতিসংঘকে শাক্তিশালী ও দাপুটে দেশগুলোর বশংবদে পরিণত হতে দেখা যায়। কিছু কথাবার্তা বললেও কাজের কাজ কিছুই করতে পারে না সংস্থাটি। জন্মের পর থেকে এতো অসহায় ও অকার্যকর আর কখনো হয় নি জাতিসংঘ।

অন্যান্য সংস্থা, যেমন জোটনিরপেক্ষ আন্দোলন একদা সংঘাত নিরসনে ও শান্তি প্রতিষ্ঠায় কার্যকর ভূমিকা পালনের সক্ষমতা দেখিয়ে ছিল। সেসব দিনও অতীত হয়ে গিয়েছে। আন্তর্জাতিক সংস্থার মতো আঞ্চলিক জোটগুলোও এখন দুর্বল, অসহায়। শক্তিশালী নেতৃত্বের অভাবে লবেজান ও ক্ষয়িষ্ণু।

ফলে বিশ্বশান্তি নামক বিষয়টি অধরা সোনার হরিণের মতো ধরাছোঁয়ার বাইরেই থাকছে। কেউই ঠিক জায়গাতে অঙ্গুলি নির্দেশ করতে পারছে না বলে মৃত্যু, রক্তপাত ও সংঘাতই সর্বত্র বিরাজমান। আর বিপন্ন বিশ্ববাসী নারকীয় অশান্তির অক্ষম দর্শক মাত্র।

দৃষ্টান্তস্বরূপ, ফিলিস্তিনের ক্ষুদ্র জনপদ গাজা উল্লেখ করা যায়। আধুনিককালে এমন বর্বর ও নারকীয় গণহত্যা নজিরবিহীন। প্রতিদিনই উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষকে নির্বিচারে হত্যা করা হচ্ছে সেখানে। অথচ সেখানেও মেরুকরণ ও গোত্রতন্ত্র। একদল বলছে, ইসরায়েল হত্যা করে ঠিক কাজ করছে। আরেক দল, হত্যার নিন্দা করছে। বাস্তবে হত্যা থামাতে পারছে না কেউই।

ইসরায়েলের বিরুদ্ধে মানবতা বিরোধী অপরাধের বিচার চেয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ দমন আদালতে যাওয়া হয়েছে। ইসরায়েলও তাদের অভিযোগ নিয়ে হামাসের বিরুদ্ধে আইনের আশ্রয় নিতে পারতো। কিন্তু তারা সে পথে না গিয়ে নিজেরাই আইন হাতে তুলে নিয়েছে এবং প্রতিশোধমূলক গণহত্যা চালিয়ে যাচ্ছে।

এ যে হিংস্রতা ঘটছে এবং গণহত্যা চলছে, তা স্পষ্টতই ইসরায়েলের দায়। কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও কতিপয় ইউরোপীয় দেশের মদদে ইসরায়েল শুধু যে হত্যাযজ্ঞ চালাচ্ছে তাই নয়, কোনো ধরনের জবাবদিহিতার বাইরেও থেকে যাচ্ছে। এমনকি ইসরায়েলি নেতা নেতানিয়াহু মার্কিন দেশের কংগ্রেসে ভাষণ দেবেন বলে জানিয়েছে রয়টার্স। এ প্রসঙ্গে নেতানিয়াহু বলেছেন, মার্কিন কংগ্রেসে বক্তব্য দেওয়ার সময় তিনি গাজা উপত্যকায় হামাসের বিরুদ্ধে চলমান যুদ্ধ নিয়ে প্রকৃত তথ্য উপস্থাপন করবেন। আগামী ২৪ জুলাই ওয়াশিংটন সফরকালে তিনি মার্কিন কংগ্রেসে বক্তব্য দেবেন বলে জানা গেছে। এতে গণহত্যার সাফাই দেওয়ারই সুযোগ পাবেন তিনি, যা গাজার মর্মান্তিক পরিস্থিতির আদৌ কোনো উন্নতি হনে না। বরং ইসরায়েল নিজের অপকর্মের বৈধতা অর্জনেরই চেষ্টা করবে।

অন্যদিকে, কিছু দেশ ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দিচ্ছে বটে, তবে তা গণহত্যা থামাতে বা ইসরায়েলকে দমন করতে কোনোই কাজে আসছে না। এ ধরনের নিরীহ ও নিরপেক্ষ মানবতাবাদী আচরণ ইসরায়েলের মতো উগ্র ও আগ্রাসী অপশক্তিকে হটাতে মোটেও কার্যকরী নয়।

এমতাবস্থায়, গাজায় গণহত্যা চলতেই থাকবে? প্রতিদিনই স্কুলে, হাসপাতালে, ঘরবাড়িতে, আশ্রয়কেন্দ্রে নারী, শিশু, বৃদ্ধ ও সাধারণ মানুষ মরতেই থাকবে? একপক্ষ হত্যাকে জায়েজ বলে উল্লাস করবে আর অপর পক্ষ মামুলি নিন্দা করে কাগুজে-বেদনা প্রকাশ করবে?

সম্ভবত এটাই গাজার নিয়তি। এটাই বিশ্ববাসীর দুর্ভাগ্য। শক্তিট দাপটে যাচ্ছেতাই করার এক 'মাৎস্যন্যায়' পরিস্থিতিতে এমনটিই ললাট লিখন। সভ্যতার অতি-উজ্জ্বল আলোকসজ্জা ও আতশবাজির তলায় এ এক অতি বাস্তব অন্ধকার অধ্যায়, যে কালো অধ্যায়ে বিশ্বশান্তি রক্ষার্থে ঠিক জায়গাতে অঙ্গুলি নির্দেশ করার মতো কোনো শক্তিশালী ও সাহসী সংস্থা, দেশ বা নেতা অবশিষ্ট নেই।

আফসোস! গাজায় অর্ধ-লক্ষ ছুঁই ছুঁই নিহত মানুষ মরার আগে বিশ্বশান্তি নামক শব্দটির অর্থ জেনে যেতে পারলো না। শান্তি প্রতিষ্ঠায় ঠিক জায়গাতে অঙ্গুলি নির্দেশ করার মতো কাউকে দেখে যেতেও পারলো না। একবিংশে বাগাড়ম্বর ও আস্ফালনের পৃথিবীকে নিজে রক্তে ভিজিয়ে তারা জেনে গেলো এক পরম সত্য। আর তা হলো, মানবিক ও সাহসী নেতৃত্বহীন পৃথিবী আসলে শূন্যতায় আচ্ছাদিত এক মৃত্যুর গর্ভগৃহ মাত্র।

ড. মাহফুজ পারভেজ: অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম; প্রফেসর ও চেয়ারম্যান, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও নির্বাহী পরিচালক, চট্টগ্রাম সেন্টার ফর রিজিওনাল স্টাডিজ, বাংলাদেশ (সিসিআরএসবিডি)।

এ সম্পর্কিত আরও খবর