সন্ত্রাস ও বঞ্চনার শিকার রোহিঙ্গাদের সামনে নতুন স্বপ্নের ঝিলিক!
মিয়ানমারের স্বদেশে ফিরতে না পেরে হতাশ কক্সবাজারে আশ্রয়গ্রহণকারী পনেরো লক্ষাধিক রোহিঙ্গা। তাদেরকে ঘিরে ধরেছে সন্ত্রাস ও বঞ্চনা। তদুপরি, আত্মপরিচিতি ও নাগরিকতার সংকটে পর্যুদস্ত এই উদ্বাস্তু ও গৃহহীন জনগোষ্ঠী। এদিকে, মিয়ানমারের আরাকান বা রাখাইন রাজ্যে বিদ্রোহী সশস্ত্র গ্রুপগুলোর দ্বারা আক্রান্ত হয়ে জল ও স্থলপথে প্রতিদিনই কিছু না কিছু রোহিঙ্গা শরণার্থী বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নিচ্ছে। এমতাবস্থায়, নতুন রাজনৈতিক স্বপ্নের ঝিলিক দেখা গেছে শরণার্থী জীবনকে কেন্দ্র করে।
কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের শরণার্থী শিবিরকে বলা হয় বিশ্বের সবচেয়ে বড় রিফিউজি ক্যাম্প। অক্টোবরের মাঝামাঝি কয়েকদিন ক্যাম্প ও সংলগ্ন এলাকায় ঘুরে আশার আলোর দেখা মিলেনি কারো চোখে-মুখে। রোহিঙ্গাদের মতোই হতাশ স্থানীয়রাও। কেউ জানে না, মানুষগুলো কবে ফিরে যেতে পারবে নিজভূমিতে। অনেকেই চিন্তা করছেন নতুন কর্মপন্থা নিয়ে।
যুবক আবদুস সালাম মোটামুটি বাংলা জানেন। ক্যাম্পের ভেতরের অমানবিক পরিস্থিতির বিবরণ দিয়ে বললেন, 'কোনো রকমে বেঁচে আছি। দিন দিন পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে। এভাবে আর কতদিন থাকবো?'
রোহিঙ্গা বিষয়ক গবেষক শফিউল্লাহ মনে করেন, 'বিশ্বে নতুন নতুন সংকট সৃষ্টি হওয়ায় আন্তর্জাতিক ফোকাস রোহিঙ্গাদের দিক থেকে ক্রমশ সরে যাচ্ছে। রোহিঙ্গা সংকট প্রলম্বিত হওয়ায় এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মনোযোগ অন্যদিকে সরে যাওয়ায় রোহিঙ্গাদের জন্য আর্থিক সহায়তা কমেছে এবং তাদের জন্য পরিচালিত কর্মসূচি অব্যাহত রাখতে আর্থিক সংকটে পড়েছে সংশ্লিষ্টরা। '
তিনি জানান, 'রোহিঙ্গা ক্যাম্পে স্বাস্থ্যকেন্দ্র ১৬০ থেকে কমে এখন ১২০-এ দাঁড়িয়েছে এবং আর্থিক সংকটের কারণে বর্তমানে চালু স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোও তাদের সেবা উল্লেখযোগ্যভাবে কমিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছে। রোহিঙ্গাদের জন্য বরাদ্দের পরিমাণও অনেক কমেছে।'
স্থানীয়রা মনে করেন, 'অভাব, বঞ্চনা ও হতাশার কারণে রোহিঙ্গারা অপরাধমূলক কাজে জড়িয়ে পড়ছে। তাদের অনেকেই মাদক, অস্ত্র ও মানব পাচারে অংশ নিতে বাধ্য হচ্ছে। সন্ত্রাসের সঙ্গেও অনেকের সংযোগ তৈরি হচ্ছে। এই পরিস্থিতির আশু অবসান হওয়ার জন্য বিকল্প পদক্ষেপ নেওয়া দরকার।'
এসব বক্তব্য বহুলাংশে সত্য। প্রায়ই ক্যাম্পে আন্তঃগোষ্ঠী সশস্ত্র লড়াই হচ্ছে। সোমবার (২১ অক্টোবর) ভোরে উখিয়ার ১৭ নং রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ঘরে ঢুকে একই পরিবারের ৩ জনকে গুলি করে হত্যার ঘটনা ঘটেছে। প্রায়ই ওয়ালাপালং পুলিশ ক্যাম্পের আওতাধীন বর্ধিত ক্যাম্প-২০ এর লাল পাহাড় সংলগ্ন এস-৪ ও বি-৭ ব্লক এলাকা দিয়ে ১৫-২০ জন অজ্ঞাত দুষ্কৃতকারী ক্যাম্পে হানা দেয়। স্থানীয় লোকজনও এ কারণে ভীত-সন্ত্রস্ত।
রোহিঙ্গাদের একাধিক সংগঠন স্বদেশ প্রত্যাবাসনের জন্য আগ্রহী হলেও তারা কিছু শর্ত দিয়েছে। যার মধ্যে রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারের নাগরিকত্ব প্রদান এবং স্ব স্ব ঘরবাড়িতে নিরাপত্তার সঙ্গে প্রত্যাবাসন অন্যতম। তাদের মতে, 'প্রাণ নিয়ে যেখান থেকে পালিয়ে এসেছি, জীবনের নিরাপত্তা না পেলে সেখানে কেন যাবো?'
প্রবীণ রোহিঙ্গা শকুর মাহমুদ বলেন, 'আমরা আন্তর্জাতিক সহায়তায় নিরাপত্তার নিশ্চয়তা না পেলে জেনেশুনে মৃত্যুর মুখে ফিরে যেতে পারি না।'
এদিকে, মিয়ানমার সরকার এবং আরাকান বা রাখাইন প্রদেশ দখলকারী আরাকান আর্মি (এএ), কেউই রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারের নাগরিক বলে স্বীকার করে না। তাদের মতে, রোহিঙ্গারা বহিরাগত। কিন্তু রোহিঙ্গারা দাবি করেন যে, 'ঐতিহাসিকভাবে তারা আরাকান অঞ্চলের বাসিন্দা। মিয়ানমারের জাতীয় ইতিহাসে তাদের সংগ্রামী অবদান রয়েছে। কিন্তু জাতিগত বিদ্বেষের কারণে তারা গণহত্যা ও নিপীড়নের শিকার হয়ে দেশত্যাগে বাধ্য হয়েছেন। আরাকানে তাদের জন্মগত অধিকার রয়েছে। সেখানে তাদের জমিজমা, সহায়-সম্পদ, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও পূর্বপুরুষের কবর বিদ্যমান। তারা তাদের জাতীয়তা ও নাগরিকতার দাবি ত্যাগ করবেন না।'
'রোহিঙ্গাদের ভবিষ্যৎ' সম্পর্কে জানতে কয়েকজন রোহিঙ্গা নেতা ও স্থানীয় মানুষদের নিয়ে আলোচনাকালে তাদের নতুন রাজনৈতিক স্বপ্নের কথা জানা যায়। তারা বললেন, 'চরম হতাশার মধ্যে থেকে রোহিঙ্গারা সন্ত্রাসের দিকে যাচ্ছে। তীব্র বঞ্চনা তাদেরকে কঠোর পথে ঠেলে দিচ্ছে। এই পরিস্থিতি ঠেকাতে হবে। বাংলাদেশসহ বিশ্বের নানা স্থানে আশ্রয় গ্রহণকারী রোহিঙ্গা কমিউনিটিকে একত্রিত করে স্বদেশ প্রত্যাবাসনের জন্য আন্তর্জাতিক চাপ ও প্রচারণা শুরু করতে হবে। রোহিঙ্গা গণহত্যার বিরুদ্ধে বিশ্ব জনমত তৈরি করতে হবে। শুধু আশ্রয় নিয়ে বসে থাকলে হবে না। নিজেদের দাবি নিয়ে নিয়মতান্ত্রিক লড়াই করতে হবে।'
বছরের পর বছর গণহত্যা ও নির্যাতনে গৃহহীন রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী শরণার্থী শিবিরের বিপন্ন পরিস্থিতিতে সন্ত্রাস ও বঞ্চনা কবলিত হলেও তাদের মধ্যে নতুন ও ইতিবাচক রাজনৈতিক স্বপ্নের ঝিলিক এক আশাবাদী ভবিষ্যতের জন্ম দিচ্ছে।
ড. মাহফুজ পারভেজ: অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম; প্রফেসর ও চেয়ারম্যান, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও নির্বাহী পরিচালক, চট্টগ্রাম সেন্টার ফর রিজিওনাল স্টাডিজ, বাংলাদেশ (সিসিআরএসবিডি)।