বাংলাদেশে কমিউনিটি লেড হাউজিং: সমস্যা ও সম্ভাবনা

, যুক্তিতর্ক

সফিকুল ইসলাম মিলটন | 2024-06-10 14:21:40

ভাবুন তো! স্থাপত্যবিদ্যায় কোন ডিগ্রি নেই, নির্মাতা হিসেবে কোন অভিজ্ঞতা নেই- তাও ঘরবাড়ি স্থাপনার সাথে সরাসরি যুক্ত থেকে কাজ করার সুযোগ পাচ্ছেন। বিষয়টা অনেকের কাছেই এক মামুলি খবর হলেও কিছু মানুষের কাছে বেশ রোমাঞ্চকর। নিয়মিত শিক্ষাজীবন শেষ করে অনেকটা শখের বসে স্থাপত্যবিদ্যায় পড়াশোনা করেন অনেকে। তবে কেবল শখের জন্যই নয়, নির্মাণ ও স্থাপত্যে সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ আমাদের আর্থ-সামাজিক জীবনে নানা ইতিবাচক প্রভাব রাখতে পারে। যেকোন পেশার ও বয়সের মানুষের নির্মাণ ও স্থাপত্যকলায় অংশগ্রহণ করার এই ধারণাটাই বিশ্বব্যাপী কমিউনিটি হাউজিং, কমিউনিটি লেড হাউজিং (Community Led Housing- CLH) বা সামাজিক গৃহায়ন হিসেবে পরিচিত।

আবাসন ব্যবস্থা সহজ ও সাশ্রয়ী করতে অলাভজনক অনেক সংগঠন বিশ্বজুড়ে কাজ করছে। কমিউনিটি পর্যায় থেকেই অনেক মানুষ নিজ নিজ অভিজ্ঞতা ও জ্ঞান আদান প্রদানের মাধ্যমে সহজ করে তুলছে সামাজিক গৃহায়ন।

বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের কমিউনিটি হাউজিং নিয়ে কাজ করা সংগঠনগুলোর জোট বিল্ডিং এন্ড সোশাল হাউজিং ফাউন্ডেশন (বিএসএইচএফ) ২০১৬ সালে কমিউনিটি লেড হাউজিং এর কিছু মানদণ্ড দাঁড় করায়।

প্রথমত, তারা মনে করে সোশাল হাউজিং এর ক্ষেত্রে কমিউনিটি সক্রিয়ভাবে জড়িত থাকবে প্রতিটা ধাপে। প্রতিটা সিদ্ধান্ত কমিউনিটি পর্যায় থেকেই আসবে। দ্বিতীয়ত, কমিউনিটি গ্রুপগুলো বাড়িগুলোর দীর্ঘ সময়ের মালিকানা ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে থাকবে। তৃতীয়ত, সোশাল হাউজিং থেকে প্রাপ্ত সুবিধাগুলো সুনির্দিষ্ট আইন ও নীতিমালার মাধ্যমে রক্ষা করা হবে। বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে কমিউনিটি লেড হাউজিং একটি সামাজিক আন্দোলনের মতো করে ছড়িয়ে পড়ছে যেখানে সাধারণ মানুষ হাউজিং প্রজেক্টগুলো দেখাশোনা করছে, সিদ্ধান্ত নিচ্ছে যার ফলে নির্মাণ ব্যয় কমে এসেছে লক্ষণীয়ভাবে।

মানুষ স্বভাবতই দলগতভাবে বসবাস করতে চায়। তবে প্রতিবেশী নির্বাচনের সুযোগ পেলে নিজের পেশা ও আয়ের মাত্রার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ প্রতিবেশী নির্বাচনের প্রবণতা থাকে সবার মধ্যে। আধুনিক কর্মময় জীবনে দিনশেষে প্রতিবেশীরা যদি সহনশীল ও সহমর্মী না হন তাহলে জীবন যেন বিষিয়ে উঠে। এজন্যই কমিউনিটি লেড হাউজিংয়ের ধারণা দিনদিন জনপ্রিয় হচ্ছে।

সামাজিক গৃহায়ন ধারণাটি প্রথম আশির দশকে ইংল্যান্ডে বেশ সারা ফেলে। এ সময় মূলত শ্রমজীবী মানুষেরা একইসাথে নিজেদের মালিকানায় একই বাড়িতে বসবাস করার কথা ভাবা শুরু করে। যেহেতু শ্রমজীবী মানুষদের কাছে একা বসত বাড়ি তৈরি করে বসবাস করা এক প্রকার অসম্ভব ছিল তাই তারা একসাথে হয়ে অল্পদিনেই একটা মাথাগোঁজার ঠাঁই যোগাড় করাটাকে বুদ্ধিমানের কাজ মনে করতে থাকে।

এর আগে ইংল্যান্ডসহ অন্যান্য পশ্চিমা দেশগুলোতে গৃহায়নকে কেন্দ্র করে রাজনীতি চলেছে বহুদিন। শ্রমিক সংঘগুলো এই সময় নির্বাচনে বেশ প্রভাব বিস্তার করতো। মার্গারেট থেচারের ‘Right to Buy’ সামাজিক আন্দোলনের ফলে শ্রমিকরা নিজেদের জন্য জমি ও বাড়ি কেনার সুযোগ পায়। কেবল তাই নয়, একটা বড় অংকের মূল্যছাড়েরও ব্যবস্থা করা হয় তাদের জন্য। অনেক শ্রমজীবী মানুষ তখন এই সুবিধা নিতে থাকে। একটা সময় পর গিয়ে তারা সামাজিকভাবে গৃহায়নের চিন্তা করে। বিংশ শতাব্দীতে যে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর উদ্ভব ঘটে, সামাজিক গৃহায়নের প্রতি তারা আকৃষ্ট হয় খুব দ্রুতই।

বিশ্বের বহু দেশে বর্তমানে কমিউনিটি হাউজিং বেশ জনপ্রিয় এক ধারণা। বিশেষ করে শহরাঞ্চলে জমির স্বল্পতা ও উচ্চমূল্য অনেককে কমিউনিটি হাউজিং এর প্রতি আকৃষ্ট করছে। অল্প জায়গায় বহুতল ভবন তৈরি করে অধিক মানুষের জন্য আবাসন তৈরি করা সম্ভব। বাংলাদেশ যেহেতু ২০২৬ সালের মধ্যে এলডিসি থেকে বের হতে যাচ্ছে তাই উচ্চ জনসংখ্যার এই দেশে কমিউনিটি হাউজিং নিয়ে ভাবার কোন বিকল্প নেই। বিশেষ করে সরকার যখন গ্রামগুলোতেও শহরের মতো আধুনিক সুযোগ সুবিধা প্রদান করতে সচেষ্ট তখন এই বিপুল জনগোষ্ঠীর মধ্যে কমিউনিটি ভিত্তিক গৃহায়নকে জনপ্রিয় করা জরুরি। শিল্পের আরও প্রসার, জনসংখ্যা বৃদ্ধি- প্রভৃতি বিষয় আগামী কয়েক যুগ পর গ্রামগুলোতেও কমিউনিটি হাউজিং বৃদ্ধি পাওয়ার পেছনে বড় প্রভাবক হিসেবে কাজ করবে।

৮ম বৃহত্তম জনসংখ্যার দেশ হয়েও উন্নত ও উন্নয়নশীল অনেক দেশের মতো এখানে ব্যাপক পরিসরে কমিউনিটি লেড হাউজিং এর জন্য সরকারি বা বেসরকারি কোন উদ্যোগ দেখা যায় নি। ফলে বাংলাদেশে কমিউনিটি হাউজিং এর ক্ষেত্রে ব্যর্থতার হার তুলনামূলক অনেক বেশি। সাধারণত দেখা যায় আবাসন সুবিধা প্রতিষ্ঠার জন্য একদল মানুষ একসাথে হলেও নেতৃত্ব দেন অল্প কিছু মানুষ। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এক্ষেত্রে দুর্নীতি যেমন বেশি হয় তেমনি নেতৃত্বের ব্যর্থতার দায়ভার নিতে হয় বাকি সবার। কোন এলাকায় একটা বাড়ি তৈরি করতে গেলে অনেকগুলো বিষয় মাথায় রেখে, সুবিধা-অসুবিধা বিবেচনা করে তবেই কাজে হাত দিতে হয়। উন্নত দেশগুলোতে এজন্য সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে অনেক সংগঠন গড়ে উঠতে দেখা যায় যারা মূলত জমি বাছাই, আইনগত সহযোগিতা, পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নসহ একটা প্রজেক্টের প্রতিটা ক্ষেত্রে উদ্যোগ গ্রহণকারীদের সহায়তা করে থাকে।

সুবিধা হল প্রথাগত ব্রোকারদের তুলনায় এ ধরনের সংগঠনগুলো বেশ কম খরচে কাজটা করে দেয়, আবার পুরোটা সময় উদ্যোগ গ্রহণকারীরা নিজেরাও সব করতে পারে, সিদ্ধান্ত নিতে পারে। প্রথাগত কোন হাউজিং প্রতিষ্ঠান বা ব্রোকারদের থেকে সুবিধা নিতে গেলে কিছু কারনে খরচ কয়েক গুণ পর্যন্ত বেড়ে যেতে পারে। প্রথমত এসব প্রতিষ্ঠান পুরো অর্থায়ন করে ব্যাংক বা অপ্রাতিষ্ঠানিক লোন থেকে যার সুদ বহন করতে হয় ক্রেতাদের। এ ছাড়াও ব্রোকাররা একটা প্রজেক্টের প্রতিটা ক্ষেত্রে কাজ করায় তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে। প্রতিটা ধাপে এভাবে খরচ বাড়তে বাড়তে অনেক বেশি খরচ বেড়ে যায় শেষ পর্যন্ত।

আর্থিক বিষয় ছাড়াও বেশকিছু সামাজিক সমস্যা রয়েছে যা কমিউনিটি হাউজিং অনেক সহজ করে দেয়। ব্রোকারদের থেকে কোন ইউনিট ক্রয় করলে পুরো সোসাইটিতে কারা বসবাস করবে, আদৌ প্রতিবেশী হিসেবে আপনি যেমন পরিবার চান তেমন পাবেন কি না- এই বিষয়গুলো জানার সুযোগ থাকে অনেক কম। অর্থনৈতিক সুবিধার পাশাপাশি এই সামাজিক দিকগুলোও বর্তমানে বেশ ভাবনার কারন হয়ে দাঁড়িয়েছে। একজন ডাক্তার চাইবেন তার পাশের ফ্ল্যাটে আরেকজন ডাক্তার বসবাস করবেন। একইভাবে যেকোন পেশার মানুষই মোটামুটি একই রকম জীবনযাপন যাদের, আশেপাশে তাদেরকেই চাইবেন। এতে পুরো কমিউনিটিতে সামাজিক বন্ধন বেশ দৃঢ় হয়, সবাই সবাইকে নিয়ে সন্তুষ্ট থাকেন। এমন হলে সামগ্রিকভাবে কমিউনিটির সদস্যদের মানসিক স্বাস্থ্যের উপর ইতিবাচক প্রভাব পরে, অপরাধপ্রবণতা কমে। ডেভেলপারদের দিয়ে একটা বাড়ির কাজ করালে তারা আয়ের দিকে বেশি মনযোগ দেয়। ফলে অনেক সময় সঠিকভাবে বিল্ডিং কোড মেনে কাজ করা হয় না। সামাজিক গৃহায়নের ক্ষেত্রে মূল লক্ষ্য থাকে সাশ্রয়ী ও টেকসই বিল্ডিং তৈরি করা।

জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে অসংখ্য মানুষ এক স্থান থেকে অন্য স্থানে স্থানান্তরিত হতে বাধ্য হচ্ছে। বসবাসযোগ্য জমির পরিমাণ প্রতিনিয়ত কমছে। কেবল ঢাকার দিকে তাকালেই দেখা যায় গত দুই দশকে দ্বিগুণ জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০০০ সালে দশ মিলিয়ন জনসংখ্যা নিয়ে প্রথমবার মেগাসিটির কাতারে নাম লেখায় ঢাকা। ২০২৪ সালে এসে কেবল ঢাকা মেট্রো এলাকাতেই জনসংখ্যা এখন প্রায় ২৪ মিলিয়ন।

ধারণা করা হচ্ছে ২০৫০ সাল নাগাদ ঢাকায় জনসংখ্যা গিয়ে দাঁড়াবে প্রায় ৪০ মিলিয়নে। এতো বিপুল জনগোষ্ঠীর আবাসন সংকট ভবিষ্যতে আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করবে। রাষ্ট্র কাঠামোর বিকেন্দ্রীকরণের পাশাপাশি শহরের আশেপাশের এলাকায় কমিউনিটি হাউজিং এর মাধ্যমে আসন্ন সংকট সামাল দিতে হবে। ইতোমধ্যে রিয়েল এস্টেট নিয়ে কাজ করা প্রতিষ্ঠানগুলো ঢাকা ও চট্টগ্রামের মতো বড় শহরগুলোর আশেপাশে মডেল টাউন গড়ে তুলছে।

তবে এর মাধ্যমে বিশাল মধ্যবিত্ত শ্রেণির আবাসন সমস্যা সমাধান করা অসম্ভব। এর মোটামুটি একমাত্র সমাধান হতে পারে কমিউনিটি হাউজিং। কেবল শহরাঞ্চলে নয়, এ ধরনের আবাসন ব্যবস্থা গ্রামীণ কৃষিজমি রক্ষার জন্যও বেশ কার্যকর হতে পারে। আরডিএ (রুরাল ডেভেলপমেন্ট অথরিটি) ‘পল্লিজনপদ’ নামে একটি পাইলট প্রকল্প হাতে নিয়েছিল যা মূলত গ্রামাঞ্চলে কম খরচে বহুতল ভবন নির্মানের মাধ্যমে কৃষিজমি রক্ষা ও আবাসন সমস্যা সমাধান করার উদ্দেশ্যে গৃহীত হয়েছিল। তবে আবাসন সংকটের ক্ষেত্রে বৃহৎ পরিসরে দীর্ঘ সময়ের জন্য, সাশ্রয়ী ও টেকসই সমাধান চাইলে শক্তিশালী নীতিমালা ও পাবলিক-প্রাইভেট সম্মিলিত প্রচেষ্টার প্রয়োজন। রিয়েল এস্টেট প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে দ্বিগুণ খরচে আবাসন সুবিধা না নিয়ে তুলনামূলক নামমাত্র খরচে পছন্দমতো জায়গায় সমমনা মানুষদের নিয়ে বসবাস করার জন্য কোন কমিউনিটি হাউজিং কতৃপক্ষের দারস্থ হওয়াটা বাস্তবিকভাবে বেশি গ্রহণযোগ্য।

কমিউনিটি হাউজিং যে বাংলাদেশে হচ্ছে না এমনটা নয়। তবে তদারকি করার জন্য কোন সুনির্দিষ্ট নীতিমালা, আইন ও কতৃপক্ষ না থাকায় এক্ষেত্রে সফলতার হার অনেক কম। অনেক সময় দেখা যায় ২০-৩০ জন একত্রিত হয়ে বিনিয়োগ করেন। কিন্তু দূরদর্শীতার অভাব, জমি বাছাই ও ক্রয়ের অনভিজ্ঞতাসহ প্রতিটা ক্ষেত্রে অভিজ্ঞতার অভাব বড় বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়। এখানেই একটি নির্দিষ্ট কাঠামোর প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়।

সারা বিশ্বে কমিউনিটি লেড হাউজিং নিয়ে যারা কাজ করছে তাদের আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্ক রয়েছে। বাংলাদেশে এমন শক্তিশালী কমিউনিটি গড়ে উঠলে কারিগরি জ্ঞান আদান প্রদানের পাশাপাশি নতুন নতুন যেকোন সংকট মোকাবিলা করা সহজ হবে। প্রযুক্তির এই যুুগে ব্যবহারিক জ্ঞান আদান প্রদান করা এখন যেকোন সময়ের চেয়ে সহজ। বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থার দিকে তাকিয়ে খুব সচেতনভাবেই বলা যায় ঠিকঠাক পরিকল্পনা, সহায়ক নীতিমালা ও সরকারি-বেসরকারি পদক্ষেপ পারে কমিউনিটি লেড হাউজিং এর মাধ্যমে দেশের আবাসন সংকট কার্যকরভাবে সমাধান করতে। আসন্ন সংকট সমাধান করতে এখন থেকেই কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।

সফিকুল ইসলাম মিলটন, প্রতিষ্ঠাতা এবং সিইও ব্যাংক অফিসারস্ হাউজিং সোসাইটি (বিওএইচএস)

এ সম্পর্কিত আরও খবর