মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রতি আগ্রহ বিশ্বব্যাপী। আমেরিকানরা নির্বাচনে যাওয়ার সাথে সাথে তাদের রাজনৈতিক পছন্দগুলো বিশ্বের জন্য প্রভাব ফেলে এবং সারা বিশ্ব তাকিয়ে থাকে এটা দেখতে যে, কে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে আসবেন এবং তার দ্বারা বিশ্বের ভালো বা মন্দ কি কি নীতি ও পরিকল্পনাগত পরিবর্তন হবে।
মার্কিন নির্বাচন এমন এক মুহুর্তে অনুষ্ঠিত হচ্ছে যখন ইউরোপ এবং মধ্যপ্রাচ্য দুটি যুদ্ধের আক্রান্ত। চীনের দৃঢ়তা এবং অর্থনৈতিক উত্থান পশ্চিমী জোটের নেতৃত্বাধীন আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার উপর অভূতপূর্ব চাপ সৃষ্টি করছে। মার্কিন-মিত্র ইসরায়েল ও মার্কিন-শত্রু ইরান যুদ্ধংদেহী অবস্থানে পরস্পরের মুখোমুখি। দক্ষিণ চীন সাগর ও তাইওয়ান নিয়ে উত্তেজনা বিরাজমান।
বিশ্বপরিক্রমার এসব ঘটনার সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষে মার্কিন স্বার্থ জড়িত। ফলে কমলা হ্যারিস বা ট্রাম্পের প্রেসিডেন্সিতে মার্কিন নীতির ধারাবাহিকতা থাকবে নাকি বিরতির সংকেত দিয়ে নতুন নীতির সূচনা ঘটাবে? বিশ্ব নেতারা কীভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নতুন নেতৃত্বের সাথে তাদের ভবিষ্যত চলমান রাখবেন? নাকি তারা বাধ্যতামূলক পরিবর্তনের সম্মুখীন হবেন? এসব প্রশ্নের পাশাপাশি বিশ্বের নানা বিষয়ে স্থিতি বা পালাবদলের ইঙ্গিত লুক্কায়িত থাকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট কে হচ্ছেন, তার নীতি ও মনোভাবের মধ্যে।
স্পষ্টতই দেখা গেছে, ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিস ডেমোক্র্যাট প্রার্থী মনোনীত হওয়ার পর থেকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট পদের প্রতিযোগিতা আরও জোরদার হয়েছে। তিনি এখন বাজারের প্রিয় মুখে পরিণত হয়েছেন। তবে একরোখা ডোনাল্ড ট্রাম্পও দাপুটে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন। এদের কোনও একজনের জয় নিছক ব্যক্তির বদল নয়। তাদের একগুচ্ছ নীতি ও কৌশলের প্রতিস্থাপনও বটে, যা বাকি বিশ্বের উপর বহুমাত্রিক প্রভাব ফেলবে।
যেমন, ট্রাম্পের অধীনে শুল্ক নীতি একটি বিশ্বব্যাপী শক হবে। চীনের জন্য প্রস্তাবিত ৬০% শুল্ক বস্তুগত বৃদ্ধিকে প্রভাবিত করে এশিয়ায় মিশ্র প্রভাব ফেলবে। ইউরোপও কম প্রভাবিত হবে না। ট্রাম্প ন্যাটো এবং এশিয়া-প্যাসিফিক উভয় ক্ষেত্রেই মার্কিন নিরাপত্তা ব্যবস্থা হ্রাসের হুমকি দিয়েছেন। এটি ইউরোপীয় প্রতিরক্ষা ব্যয়কে প্রভাবিত করবে। কেননা, প্রসারিত ইউরোপীয় অর্থের জন্য ট্রাম্প চাপ দেবেন।
ট্রাম্পের নীতিগুলো বিশ্বব্যাপী মিশ্র প্রতিক্রিয়ায় ছড়িয়ে পড়বে। মার্কিন প্রবৃদ্ধি হার এবং ডলারের উপর প্রভাব ফেলবে ট্রাম্পের নীতি। অভিবাসন ও সামাজিক কল্যাণের ক্ষেত্রগুলো সঙ্কুচিত হবে। বিশেষত, ভর্তুকি ও চ্যারিটি বহুলাংশে কমবে।
অতএব, বিশ্বব্যাপী নির্বাচনের বছর ২০২৪ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উপর একটি বড় প্রভাব ফেলবে বলে সবাই একমত। কারণ, ট্রাম্পের প্রতিদ্বন্দ্বী ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিসের বৈদেশিক নীতির রূপ অস্পষ্ট। প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্প নির্বাচিত হলে, বৈদেশিক নীতি বিশেষজ্ঞরা আশা করেন যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিশ্ব শাসন থেকে সরে আসবে এবং আরও জাতীয়তাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করবে। কমলার ক্ষেত্রে আগাম ধারণা করা বেশ মুস্কিল। তিনি বৈশ্বিক ইস্যুর চেয়ে দেশের ভেতরের বিষয়গুলো নিয়ে বেশি সোচ্চার।
গ্লোবাল পলিটিক্সের পণ্ডিতরা সাম্প্রতিক দশকগুলোতে মার্কিন পররাষ্ট্র নীতির সামগ্রিক ধারাবাহিকতার আলোকে মনে করেন, যারাই নির্বাচিতই হোক না কেন, বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সম্পৃক্ততার ক্ষেত্রে বড় পরিবর্তনের আশা কম। তা সত্ত্বেও, তারা মার্কিন নির্বাচনকে বহুপাক্ষিকতা ও বহুপাক্ষিকতা-বিরোধীদের মধ্যে একটি প্রতিযোগিতা হিসেবে দেখেন। যার মধ্য দিয়ে উগ্র জাতীয়তাবাদ ও নব্য বর্ণবাদের পুনরুত্থানের বিপদ আঁচ করছেন তারা। এটি হলে বিশ্বের গণতন্ত্রবাদী ধারা ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং কর্তৃত্ববাদ মাথাচাড়া দেবে।
মনে করা হয়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সম্ভবত চীনকে মোকাবেলা করা এবং বিশ্ব সম্পর্কে একটি ম্যানিচিয়ান দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তোলার জন্য তার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনার মধ্যে রয়েছে। ফলে "পশ্চিম বনাম পূর্ব," "গণতন্ত্র বনাম স্বৈরাচার," মর্মে বিশ্বের বিভাজনটি আরও প্রলম্বিত হয়ে "গ্লোবাল নর্থ বনাম গ্লোবাল সাউথ"-এর লাইন ধরে সম্প্রসারিত হবে। এই দৃষ্টিভঙ্গিটি দীর্ঘস্থায়ী হয়ে বৈশ্বিক বৈষম্য বাড়াবে। বৈষম্যের উপর ভিত্তি করে তৈরি হওয়া নতুন নতুন বিপদের সম্মুখীন হবে সারা বিশ্ব। এতে সামনের দিনগুলোতে একদিকে পশ্চিমা শক্তি এবং অন্যদিকে সংখ্যাগরিষ্ঠ বিশ্বের মধ্যে একটি কী-লক বা অচলাবস্থা তৈরি হওয়ার আশঙ্কা দেখা যাচ্ছে।
ঐতিহাসিকভাবে, গ্লোবাল নর্থ আক্রমনাত্মকভাবে গ্লোবাল সাউথের উদ্যোগগুলোকে দমন করেছে। যার লক্ষ্য ছিল উত্তর গোলার্ধের একচ্ছত্র নেতৃত্ব ও কর্তৃত্বে তাদের জন্য উপযোগী আরও ভারসাম্যপূর্ণ এবং আরও স্বাচ্ছন্দ্যদায়ী আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা তৈরি করা। গ্লোবাল সাউথের অনেকেই ট্রাম্প এবং রাষ্ট্রপতি জো বাইডেনের মধ্যে তাদের ইস্যুগুলোর জন্য সারগর্ভ সমর্থনের বিষয়ে সামান্য পার্থক্য দেখেন। উভয় প্রশাসনের পদক্ষেপগুলোকে মূলত অলঙ্কৃত এবং প্রতীকী হিসাবে দেখেন। কমলাও এর ব্যতিক্রম নন।
এই প্রেক্ষাপটে, অনেক গ্লোবাল সাউথ রাজনৈতিক এবং চিন্তাশীল নেতারা বিশ্বব্যাপী শাসন ব্যবস্থা সংস্কারের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উপর নির্ভর করেন না। বরং, তারা নতুন অংশীদারিত্ব এবং বিকল্প বহুপাক্ষিক ফোরামের সন্ধান করেন, যা তাদের স্বার্থকে এগিয়ে নিতে এবং আন্তর্জাতিক উন্নয়ন এবং জলবায়ু অর্থায়নকে সুরক্ষিত করতে সহায়তা করতে পারে। পশ্চিমে প্রচলিত প্রজ্ঞার বিপরীতে, এই নেতারা মার্কিন নেতৃত্বাধীন "নিয়ম-ভিত্তিক আদেশ"-এর বিপরীতে আন্তর্জাতিক নিয়মের সার্বজনীনতাকে এগিয়ে নিতে চান।
বিশ্বব্যাপী মার্কিন প্রভাবের অবসানের জন্য মুক্ত পৃথিবী আকুল। তারা মনে করেন, আজকের প্রেক্ষাপটে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উচিত তার নেতৃত্বের ভূমিকাকে নতুন করে সংজ্ঞায়িত করা, যার ভিত্তিতে গতকালের সংঘাত আগামীকালের জন্য সহযোগিতামূলক প্রচেষ্টায় রূপান্তরিত করা সম্ভব হবে। ওয়াশিংটনের উচিত মিত্র ও অংশীদারদের সাথে আস্থা ও সম্মানের সাথে লেনদেন করা। এটি মার্কিন সীমানার বাইরের বিশ্বকে নতুন বিন্যাসে উপস্থাপিত করতে পারবে। যে বিশ্ব হবে মার্কিন প্রভাব মুক্ত, শান্তিময়, স্থিতিশীল।
মার্কিনিদেরও উচিত একটি একেবারে নতুন ডিজাইনের সাথে নতুন করে বোনা একটি বহুপাক্ষিক টেপেস্ট্রি হিসাবে বহুমাত্রিক ও ইনক্লুসিভ বিশ্বের স্বপ্ন দেখা। এমন একটি মহত্তম প্রত্যাশা নিয়েই মার্কিন ভোটের প্রতি বৈশ্বিক আগ্রহ থাকা দরকার। যে আগ্রহে কে নির্বাচিত হলেন তা গুরুত্বপূর্ণ নয়। গুরুত্বপূর্ণ হলো কোন আদর্শ জয়ী হয়ে বিশ্বের জন্য কি কি কল্যাণময় পরিবর্তন এনেছে, তা বিবেচনা করা।
ড. মাহফুজ পারভেজ: অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম; প্রফেসর ও চেয়ারম্যান, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও নির্বাহী পরিচালক, চট্টগ্রাম সেন্টার ফর রিজিওনাল স্টাডিজ, বাংলাদেশ (সিসিআরএসবিডি)।