শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা শুনলেন, পরিবারের কেউ আর নেই!

, যুক্তিতর্ক

মোহাম্মাদ আনিসুর রহমান | 2023-09-01 22:13:24

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের মহান স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান (১৯২০-১৯৭৫) হত্যাকাণ্ডের সময় বিদেশে থাকায় শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা যেভাবে স্বপরিবারে নিহত হওয়ার ঘটনা শুনেছিলেন, তার এক বিশদ বর্ণনা ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়া তাঁর ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে ঘিরে কিছু ঘটনা ও বাংলাদেশ’ (১৯৯৩) শীর্ষক গ্রন্থে লেখেছেন। গ্রন্থটি থেকে জানা যায়, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট স্ত্রী শেখ হাসিনা, দুই সন্তান ও শেখ রেহানাসহ জনাব ওয়াজেদ মিয়া বেলজিয়ামে তৎকালীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত সানাউল হকের বাসভবনে অবস্থান করছিলেন। ভোর ছয়টার দিকে সানাউল হকের স্ত্রী জানান, তৎকালীন জার্মান রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন রশিদ চৌধুরী টেলিফোনে কথা বলতে চান। প্রথমে শেখ হাসিনা কথা বলতে গেলে জনাব চৌধুরী জানান যে, তিনি ড. ওয়াজেদ মিয়ার সাথে কথা বলতে চান। পরে, ড. ওয়াজেদ মিয়া টেলিফোন ধরলে হুমায়ুন রশিদ চৌধুরী বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড বিষয়ে বলেন এবং প্যারিস যাত্রা বাতিল করে জার্মানিতে তাঁর বাসভবনে ফিরে যেতে অনুরোধ করেন।

ঘটনা শোনার পর ওয়াজেদ মিয়া হুমায়ুন রশিদ চৌধুরীর অনুরোধে প্যারিস যাত্রা বাতিল করে সকাল সাড়ে দশটার দিকে সানাউল হকের সহযোগিতায় সবাই ব্রাসেলস ত্যাগ করে বিকেল সাড়ে চারটার দিকে জার্মানির বনে হুমায়ুন রশিদ চৌধুরীর বাসভবনে পৌঁছান। তারা পৌঁছানোর আগেই ঐ দিনে বাংলাদেশের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. কামাল হোসেন যুগোশ্লাভিয়া সফর শেষে ফ্রাঙ্কফুর্টে যাত্রাবিরতি করেন এবং বনে রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন রশিদ চৌধুরীর বাসায় গিয়েছিলেন। ঘটনার বিবরণ হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী তার ‘কূটনীতির অন্দরমহল’ (২০১২) গ্রন্থে এবং ড. কামাল হোসেন তার 'বাংলাদেশ: কোয়েস্ট ফর ফ্রিডম অ্যান্ড জাস্টিস’ (২০১৩) গ্রন্থের ভূমিকায় উল্লেখ করেছেন। সেদিন কান্নায় ভেঙে পড়া বঙ্গবন্ধুর সর্বস্ব হারানো এতিম দুই মেয়ে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানাকে ড. কামাল হোসেন, হুমায়ুন রশিদ চৌধুরী এবং তার স্ত্রী বারবার স্বান্তনা দিচ্ছিলেন। পাশাপাশি তারা বিবিসি, ভয়েস অব আমেরিকা ও অন্যান্য রেডিও স্টেশন থেকে স্ব-পরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড ও বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতির সর্বশেষ তথ্য সংগ্রহ ও জানার চেষ্টা করছিলেন। পরের দিন ১৬ আগস্ট, ১৯৭৫ ড. কামাল লন্ডনের উদ্দেশে যাত্রার জন্য গাড়িতে করে হুমায়ুন রশিদ চৌধুরী ও ওয়াজেদ মিয়ার সাথে বন বিমানবন্দরে যান। বিদায়ের সময় ওয়াজেদ মিয়া ড. কামাল হোসেনের হাত ধরে বলেন যে, ‘খন্দকার মোশতাক আহমদ খুব সম্ভবত আপনাকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী রাখার চেষ্টা করবেন। অনুগ্রহ করে আমার কাছে ওয়াদা করুন যে, আপনি কোন অবস্থাতেই খন্দকার মোশতাক আহমদের সঙ্গে আপোষ করে তার মন্ত্রিপরিষদে যোগদান করবেন না। ড. কামাল হোসেন উত্তরে বলেন যে, ড. ওয়াজেদ, প্রয়োজন হলে বিদেশেই মৃত্যুবরণ করতে রাজি আছি। কিন্তু কোন অবস্থাতেই খন্দকার মোশতাক আহমদের সঙ্গে এ ব্যাপারে আপোষ করে আমি দেশে ফিরতে পারি না। যদিও ড. কামাল হোসেন ব্যক্তিগত কারণে আজ আর বঙ্গবন্ধুর শেষ স্মৃতি তাঁর দুই মেয়ের পাশে নেই।

আরও পড়ুন:  এক মুজিব লোকান্তরে, লক্ষ মুজিব ঘরে ঘরে

ড. ওয়াজেদ তার গ্রন্থে আরো উল্লেখ করেন, রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন রশিদ চৌধুরীর পরামর্শে এবং সহযোগিতায় শ্যালিকা রেহানা, স্ত্রী হাসিনা, শিশু সন্তান জয় ও পুতুল এবং নিজের জন্য ভারতের কাছে রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করেন। পরবর্তীতে অত্যন্ত গোপনীয়তার সাথে এয়ার ইন্ডিয়ার একটি বিমানে ২৫ আগস্ট সকাল সাড়ে আটটায় দিল্লির পালাম বিমানবন্দরে পৌঁছান তারা। তখনো তারা জানতেন হয়ত বেগম মুজিব এবং শিশু রাসেল বেঁচে আছেন। প্রায় দুই সপ্তাহ পর প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সাথে সাক্ষাতের সময় উপস্থিত একজন কর্মকর্তার মাধ্যমে তারা জানতে পারেন বঙ্গবন্ধুর পরিবারের আর কেউ-ই বেঁচে নেই। কান্নায় ভেঙে পড়লে ইন্দিরা গান্ধী শেখ হাসিনাকে জড়িয়ে ধরে সান্ত্বনা দিতে গিয়ে বলেন যে, ‘তুমি যা হারিয়েছো, তা আর কোনভাবেই পূরণ করা যাবে না। তোমার একটি শিশু ছেলে ও মেয়ে রয়েছে। এখন থেকে তোমার ছেলেকে তোমার আব্বা এবং  মেয়েকে তোমার মা হিসেবে ভাবতে হবে। এখন তোমার ছেলে-মেয়ে ও বোনকে মানুষ করার ভার তোমাকেই নিতে হবে’ (বিবিসি বাংলা, ১৬ অগাস্ট ২০১৭)।

পরিবারের সবাইকে হারানো শেখ হাসিনা ছেলে-মেয়ে ও বোনকে মানুষ করার ভার সামলে দেশের ভারও চার বার সামলে চলেছেন। শেখ হাসিনা এখন বাংলাদেশের উন্নয়নের রূপকার। তাই, সরকার প্রধান হিসাবে দেশের অগ্রযাত্রাকে টেকসই করার দায়ভারও এখন তাকেই নিতে হবে। বাংলাদেশ ও বঙ্গবন্ধু সমার্থক ও অবিচ্ছেদ্য। বাংলাদেশের সাথে বঙ্গবন্ধু অমর ও অবিনশ্বর। বঙ্গবন্ধুর মত অবিচল ও প্রকৃত দেশপ্রেম চর্চার জন্য দেশের আবহ গড়ে তোলার জন্য সকলকে কাজ করতে হবে, নয়লে দেশের সার্বিক উন্নয়ন সম্ভব নয়। শোককে শক্তিতে রূপান্তর করে এখন সময় ‘জনগণের পাশে সরকার’ ও ‘সরকারের পাশে জনগণ’ ব্যবস্থা গড়ে তোলা। 

মোহাম্মাদ আনিসুর রহমান

পি.এইচ.ডি গবেষক, জেঝিয়াং ইউনিভার্সিটি, চীন এবং  শিক্ষক, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, বশেমুরবিপ্রবি, গোপালগঞ্জ। ই-মেইল: anisrahaman01@gmail.com

আরও পড়ুন: বঙ্গবন্ধু চিরকালের, সব মানুষের অনন্ত অনুপ্রেরণা

‘রাত্রির চেয়েও অন্ধকার ছিল সেই অভিশপ্ত দিন’

এ সম্পর্কিত আরও খবর