পলিটিক্স না জাবিটিক্স

বিবিধ, যুক্তিতর্ক

গওহার নঈম ওয়ারা | 2023-08-26 02:04:38

সোনাগাজীর নুসরাত জাহান রাফি হত্যা মামলার সাইড কেস ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে আটক হন ওসি মোয়াজ্জেম। সেই আসামি মোয়াজ্জেমের জামিনের শুনানির সময় আদালত মন্তব্যে বলেছিলেন ‘কিছু কিছু ডিসি ও ওসি আছেন যারা নিজেদের জমিদার মনে করেন। সর্বেসর্বা মনে করেন। সবাই কিন্তু না। অনেক দেশেই এমন আছে, তবে আমাদের দেশে বেশি।’ (দেখুন যুগান্তর জুলাই ৯, ২০১৯)। শুনানিটা যদি জুলাইয়ের ৯ তারিখে না হয়ে নভেম্বরের ৭/৮ কি ৯ তারিখে হতো তাহলে কি আদালত ডিসি ওসির সাথে ‘দেশি ভিসি’ শব্দটা যোগ করতেন? হয়তো করতেন, হয়তো করতেন না।

ডিসি আমাদের আমলাতন্ত্রের শিখর পদ নয়। তারপরেও ডিসি হওয়ার স্বপ্ন দেখেন না এমন বিসিএস পাশ কর্মকর্তা মিলবে না। আবার সচিব থেকে সিনিয়র সচিব তারপর মন্ত্রী উপদেষ্টা হওয়ার পরেও তাদের ডিসিগিরির গপ্পো করার তেষ্টা মেটে না। যখন ডিসি ছিলেন তখন কেমনে রাতকে দিন করেছেন, চাঁদকে সূর্য বানিয়েছেন আর কোন ঘাটে ঘটা করে বাঘ আর হরিণকে এক দস্তরখানায় খানা খেতে বাধ্য করেছেন- তাঁর গল্প আর শেষ হয় না। এসব গল্পের সাক্ষী-প্রমাণ তাদের বসার ঘরেও সাজিয়ে রাখেন। এ বিষয়ে ওসি সাহেবদের প্রসঙ্গ সাহস হলে বারন্তরে আলাপ করা যাবে।

আরো পড়ুন: অনড় শিক্ষার্থীরা পিছু হটতে পারে, তদন্তের আশ্বাসে!

কিন্তু যতো মেধাবীই হও শিক্ষকদের সে সব গপ্পো মারা পদের কোনো মওকা নেই। একটামাত্র উপায় যদি কোনোমতে ভিসি হওয়া যায়। খুবই উত্তেজনাকর একটি পদে পরিণত হয়েছে এখন এই পদটি। একবারতো একজন অধ্যাপক উপাচার্য পদটি পেয়ে সূর্য ওঠার অপেক্ষা না করে রাত দুপুরেই ভিসির চেয়ারে গিয়ে ধপাস করে বসে কিতারথ্যের হাসি দিতে দিতে ছবি তোলেন। সেই পর্ণছবি (নাকি লোমহর্ষক ছবি) পরদিন কোনো কোনো কাগজের প্রথম পাতায় ছাপাও হয়। পদ না পাওয়া অন্যদের আকাঙ্ক্ষার পারদ চড়ে যায় আকাশে। বিশ্ববিদ্যালয়ের হাজার হাজার শিক্ষক, কিন্তু ভিসির পদ একটা, জীবনও একটা- তাইকি এতো প্রতিযোগিতা? দুষ্টের লালন আর লাঠি লাথির পালন?

জাবির একজন সাবেক ছাত্র তার ডাইরিতে লিখেছেন “আজ থেকে ২৮ বছর আগে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে এক ভিসিবিরোধী আন্দোলনে আমাদের ভর্তি পরীক্ষা পিছিয়ে গেল। ভর্তি হয়েও ভিচি (তিনি এরপর আর ভিসি লেখেননি) বিরোধী আন্দোলনে অংশ নিয়েছি, তবে আজ বুঝি যে সেদিন কিছুই বুঝতাম না।

১৯৯২-৯৩ সালে ক্যাম্পাসে সবচেয়ে বেশি ভাংচুর ও তাণ্ডব যারা চালিয়েছিল, সেই ‘সীতাবিসর্জনে’ (আমি এটা বলতে ডাইরি লেখক কী বুঝিয়েছেন বুঝিনি) উৎসাহীদের অংশ হিসেবে আমিও ছিলাম। একটু উপরের ক্লাসে গিয়ে বুঝেছিলাম, ভিচিবিরোধী শিক্ষকগণ আমাদের কীভাবে উস্কিয়ে দিত। একদিন সিন্ডিকেট মিটিং চলাকালীন একজন শিক্ষক মিটিং থেকে বের হয়ে দৌড়ে আসলেন। আমাদেরকে বললেন, তোমরা কি করো? তাড়াতাড়ি কিছু ফুটাও। আমরা ফুটালাম এবং মিটিং পণ্ড হলো সেদিনের মতো। থার্ড ইয়ারে গিয়ে বুঝলাম, বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষাদান ব্যতীত আরো কিছু দায়িত্ব আছে। সেখান থেকে বৈধ বা অবৈধভাবে বেশি আয়ের সুযোগ আছে। সেইসব সুযোগ হাতিয়ে নেবার জন্য আমাদেরকে তারা উস্কাত।

আরো পড়ুন: বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কি এভাবেই চলবে? 

এই জাহাঙ্গীরনগরে সকল রাজনৈতিক পক্ষের ভিচির পক্ষে বা বিপক্ষে আন্দোলন হয়েছে, শিক্ষকতার বাইরে থেকে কিংবা অন্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আমদানি করেও ভিচি বানানো হয়েছে। কিন্তু যেই লাউ সেই কদু। অন্তত জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে আক্ষরিক অর্থেই এটা একটি পদবিরোধী আন্দোলনের সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে। মনে হয় মঙ্গল গ্রহ থেকে ভিচি আনলেও তার বিরুদ্ধে আন্দোলন হবে এবং সকল আন্দোলনই হয়তো যৌক্তিক হবে। শুধু ক্লাস পরীক্ষা বর্জন করে সাধারণ শিক্ষার্থী ও তাদের পরিবার হবে ক্ষতিগ্রস্ত।

তাই আমার মনে হয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে আর কোনো ভিচি নিয়োগ না দেয়াই উত্তম। এতে কোনো সমাধান আসবে না। সরকার চাইলে সব আইন ও নিয়ম করতে পারে। অন্তত জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য পাইলট প্রকল্প হিসেবে ভিচি পদের বিকল্প কিছু করে দেখা যেতে পারে...।"

এটা একজন সাবেক শিক্ষার্থীর নিতান্তই ব্যক্তিগত ডাইরির পাতায় লেখা অভিমত। বিদেশ থেকে শিক্ষকের সাথে সাথে এখন ভিসিও আসছেন। দেশে পাওয়া না গেলে আর সবার গায়ে কিছু না কিছু গন্ধ থাকলে কী আর করা? যে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা পোশাক শিল্পের একটা এক্সিকিউটিভ পয়দা করতে পারে না, একজন পেশাদার আইটি বিশেষজ্ঞ আনতে হয় ভারত থেকে- সেখানে প্রশাসনে পটু ভিসি পাবেন কই? তার ওপর পুরাতন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর দাবি- উপাচার্য হবেন তাদের শিক্ষকদের মধ্য থেকে। ভাল হয় যদি শিক্ষক ওই বিশ্ববিদ্যালয়েরই সাবেক ছাত্র হন। আর নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ের চাপ থাকে যে জেলার বিশ্ববিদ্যালয় ভিসির চৌদ্দ পুরুষের বাড়িঘর থাকতে হবে সেই জেলায়, না হলে অন্তত সেই বিভাগে।

ভেতরে অন্য কারণ থাকতে পারে, কিন্তু আগের ভিসি আনোয়ার হোসেনকে জাবিয়ান নন বলে বাইরের লোক হিসেবে গণ্য করে তার বিরুদ্ধে দল পাকানোর অভিযোগ কি একেবারেই ভুল? তিনি আপন হওয়ার অনেক চেষ্টা করেও দোস্ত খুঁজে পাননি। ভর্তি পরীক্ষা সংগঠিত ও সম্পন্ন করার জন্য একটা ভাতা পেয়ে থাকেন শিক্ষকেরা। তিনিও পেয়েছিলেন আড়াই লক্ষ টাকা। সেই অর্থ নিজে না নিয়ে কল্যাণ তহবিলে জমা দিয়েছিলেন। “একজন শিক্ষকের জন্য আড়াই লক্ষ অনেক টাকা, আমি সেটা বিশ্ববিদ্যালয়কে দিয়েছি, তারপরও আপনাদের মন পেলাম না..” যাবার আগে আক্ষেপ করে সিনেট কক্ষে এমনটাই বলেছিলেন তিনি।

জোর পারসেপশন (গণধারণা) ঠিকাদার নির্বাচন আর দেনা পাওনা নিয়ে দুর্নীতি হয়েছে। কিন্তু ভিসি বলছেন, হয়নি, প্রমাণ দিন, প্রমাণিত হলে বিচার মাথা পেতে নেবো। সব দুর্নীতির অকাঠ প্রমাণ থাকে না। তবে অভিযোগ যাচাইয়ের অন্য তরিকা আছে।

বর্তমান ডিজিটাল বাংলাদেশে যেখানে পাঁচ লক্ষ টাকার কাজও ই-টেন্ডারের মাধ্যমে করা হয়, সেখানে প্রধানমন্ত্রী প্রদত্ত অধিকতর উন্নয়ন প্রকল্পের ১৪৫০ কোটি টাকার মধ্যে ৫টি হল নির্মাণে প্রায় ৪০০ কোটি টাকার কাজ এনালগ পদ্ধতিতে আহ্বান করা কি ঠিক হয়েছিলো? এজন্য দুর্নীতি যদি না-ও হয়ে থাকে তারপরেও সবার মনে অস্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন জাগাটা কি অস্বাভাবিক? তাছাড়া টেন্ডার শিডিউল ছিনতাই হওয়ার পর প্রশাসনকে জানানো হলেও এ ব্যাপারে প্রশাসন কোনো ব্যবস্থা যে গ্রহণ করেনি সেটা কি মিথ্যা ?

আরো পড়ুন: দুর্নীতি আড়াল করতেই ভিসিকে সমর্থন জাবি ছাত্রলীগের!

এসব প্রশ্নের জবাব দেয়ার জন্য কথিত টেন্ডারবাজির পুরা প্রক্রিয়া বাতিল করে, অস্বচ্ছতার মোড়কে যে সকল প্রতিষ্ঠান কাজ পেয়েছে সেই সকল প্রতিষ্ঠানকে কালো তালিকাভুক্ত করে আবার ই-টেন্ডার আহ্বান করলে সকল সমস্যার সমাধান হতে পারতো।

অস্বচ্ছ ব্যবস্থায় কাজ পাওয়া ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো যদি কাউকে টাকা দিয়ে থাকে, কার্যাদেশ বাতিল এবং কালো তালিকাভুক্ত হলে তখন তারা সেই টাকা ফেরত দিতে চাপ দিত। তখনই বোঝা যেতো দুর্নীতি হয়েছিলো কি হয়নি।

এখন জোড়াতালি দেয়ার সময় হয়তো পার হয়ে গেছে। অনেক কিল চড় লাথি লাঠির নিচে চাপা পরে গেছে উইন উইন সমাধানের পথ। হাসি মুখে মুখোমুখি বসে সমাধানসূত্র খোঁজার দিনও আর বাকি নেই। তবুও বলি, ভিসির পর ভিসি বলী দিলে স্বচ্ছতা আসবে না। লঙ্কায় যে যাবে সেই হবে রাবণ। এটাই লঙ্কার নিয়ম। তাই আগে দরকার লঙ্কার চিকিৎসা।

 

গওহার নঈম ওয়ারা: শিক্ষক, লেখক

এ সম্পর্কিত আরও খবর