‘আবার চেষ্টা করুন’

, যুক্তিতর্ক

এরশাদুল আলম প্রিন্স | 2023-08-27 21:48:25

নির্বাচন যে এদেশে একটা উৎসব ছিল দেশবাসী তা ভুলতেই বসেছিল। এবারের ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে হারিয়ে যাওয়া সেই উৎসবের আমেজ কিছুটা হলেও ফিরে এসেছে। সিটি ভোটে নির্বাচনী প্রচার প্রচারণা ছিল তুঙ্গে। যদিও সেই প্রচার প্রচারণা সীমাবদ্ধ ছিল শুধুই নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী ও তাদের খাস সমর্থকদের মাঝেই। সাধারণ মানুষ নির্বাচনী আলাপ-আলোচনায় শামিল হয়েছে বটে, কিন্তু নির্বাচনে তারা নিজেরা শামিল হয়নি। তবে ভোটের মাঠে গরম হাওয়া উষ্ণতা ছড়িয়েছে কম না। কিন্তু সেই উষ্ণতা শেষমেশ ভোটারদের শীতনিন্দ্রা ভাঙাতে পারেনি। জাতীয়তাবাদী রোদ কিংবা আওয়ামী উত্তাপ কোনোটিই ঢাকার আম নাগরিকের আড়মোড়া ভাঙাতে পারেনি। ভোটের হিসাব সে কথাই বলছে।

আম ভোটারদের হৃদয়ে জমে থাকা কালো মেঘ সিটি ভোটে কাটেনি। নির্বাচন কমিশনের দাবি, ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে আনা কমিশনের কাজ না। নির্বাচনে ভোটার আসা না আসা নিয়ে কমিশন ও সরকারের মন্তব্যও বেশ কৌতূহলোদ্দীপক। এক প্রার্থী বলেছেন, উন্নয়নের জন্যই ভোটাররা ভোট দিতে যাননি। একজন বলেছেন ভোটাররা ঘরে বসে পোলাও মাংস খেয়ে ছুটি কাটাচ্ছেন, তাই ভোটা কম পড়েছে। প্রধান নির্বাচন কমিশনার বলেছেন ৩০% এর চেয়ে বেশি ভোট হয়নি। যদিও তিনি প্রচ্ছন্নভাবে গড় ভোটারের পরিমাণ বুঝিয়েছেন। ভোটের এই হার নিয়ে সন্দেহ থাকতে পারে। কিন্তু যদি ধরেও নিই যে এই পরিমাণ ভোট কাস্টিং হয়েছে, সেটিও কি যথেষ্ট আশাব্যঞ্জক?

সিটি ভোট নিয়ে নানা জনের নানা কথা। অনেকের অভিযোগ অনেকের সন্তুষ্টি। একপক্ষ বলছে ভোট ভালো হয়েছে, আরেক পক্ষ বলছে মন্দ। সিইসি বা ভোট কর্তৃপক্ষের একই কথা, তাদের কাছে কেউ কোনো অভিযোগ করেনি, কাজেই এতো সুষ্ঠু নির্বাচন আগে হয়নি। আসলেই তো কমিশনের কাছে কেউ অভিযোগ না করলে কমিশন কীভাবে ব্যবস্থা নেবে?

বিএনপির অভিযোগ তাদের এজেন্টদের বের করে দেওয়া হয়েছে বা ঢুকতেই দেওয়া হয়নি। এদিকে সিইসি যে কেন্দ্রে ভোট দিতে গিয়েছিলেন সেখানে আওয়ামী লীগ-বিএনপি দুই দলেরই এজেন্ট ছিল। কাজেই নির্বাচন সুষ্ঠু হয়নি একথা বলার সুযোগ নেই। সুষ্ঠু ভোট হয়েছে বলেই বিএনপি সম্মানজনকভাবে পরাজিত হয়েছে। বিএনপির এজেন্ট না থাকার বিষয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনারের মন্তব্যটি গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলেছেন, এজেন্টদের ভোট কেন্দ্রে থাকার সক্ষমতা থাকতে হবে। বিএনপির ভোটার বা এজেন্ট আনা নিশ্চয় কমিশনের কাজ নয়। বিএনপির নিজের ব্যর্থতার দায়ভার কমিশন বা সরকারী দলকে দেওয়া মানে উদোর পিণ্ড বুদোর ঘারে দেওয়া। আওয়ামী লীগ যদি ভোটকেন্দ্র দখল করে তবে বিএনপির নেতা কর্মীরাতো ভোটকেন্দ্র পাহারা দিতে পারতো। কিন্তু তারা তো ঘর থেকেই বের হয়নি।

এবারের ভোটে সর্বজনীনভাবে ইভিএম ব্যবহার হয়েছে। এর আগের কোনো কোনো ভোটে কোনো কোনো কেন্দ্রে ইভিএম ব্যবহার হয়েছে। এবারই প্রথম কোনো ভোটে পুরোপুরি ইভিএম ব্যবহার হয়েছে। কমিশনের ইভিএম পরীক্ষা সফল না বিফল তা নিয়েও নানা জনের নানা মত। গণমাধ্যমে যা এসেছে তাতে একে সফল বলা যায় না। অভিযোগ অনেক। স্বয়ং সিইসিই ইভিএমে ভোট দিতে পারেননি। অনেক ভোটারই ইভিএমে ভোট দিতে পারেননি। ইভিএম অনেক ভোটারকেই চিনতে পারেনি। ইভিএমও এদেশের প্রার্থী, দলের নেতা, চেয়ারম্যান, মেম্বার, এমপি, মন্ত্রী, সরকার বিরোধীদলদের মতোই-ভোটারদের চিনতে পারে না। ইভিএমও ভোটার সিইসিকে চিনতে পারেনি। ইভিএমে বারবার চেষ্টার পর স্ক্রিনে ভেসে উঠেছে "আবার চেষ্টা করুন"। ইভিএম সিইসিকে চিনতে পারেনি এ দায় কার?

ভোট শেষ। দুই মেয়র পেয়েছেন পদ। ঢাকা কী পেয়েছে, কী পায়নি সে হিসাব খাতা খোলা রইলো আগামী ভোট পর্যন্ত। কিন্তু স্ক্রিনে ভেসে ওঠা ওই কথাটি আমাদেরকে কি কিছু শিখিয়ে গেলো? আমরা অনেক চেষ্টা করে গণতন্ত্রে এসেছি, ভোটাধিকার পেয়েছি, পেয়েছি ভাষা, স্বাধীনতা। কে জয়ী কে পরাজিত সে হিসাব না হয় নাই হলো। কিন্তু ভোটে আমরা কী পেলাম কী হারালাম সে হিসাবটাও অন্তত একবার মিলিয়ে দেখা যেতে পারে। যে পরাজিত সে চেষ্টা করলে আজ বা কাল জয়ী হতেও পারে, বিজয়ী ধরে রাখতে পারবে জয়ও। সাময়িক জয়-পরাজয় বড় কথা নয়। কিন্তু মান, খ্যাতি, যশ, সম্মান, ঐতিহ্য একবার হারালে তা কি আর ফিরে আসে? তবুও চেষ্টায় দোষ নেই। ইভএম এর "আবার চেষ্টা করুন" বার্তাটি হয়তো আমাদের সে কথাই জানিয়ে গেল।

এ সম্পর্কিত আরও খবর