গ্রামের স্বাস্থ্য: এক্সরে, অ্যাম্বুলেন্স ও উপ-স্বাস্থ্যকেন্দ্র যেখানে অচল

বিবিধ, যুক্তিতর্ক

নাহিদ হাসান | 2023-08-27 19:50:27

১.

১১.০১.২০২০, বেলা ৩টা। ৫০ শয্যার চিলমারী হাসপাতাল। হাসপাতালের মাঠে বেসরকারি অ্যাম্বুলেন্স ও ঔষধ কোম্পানির গাড়ি দাঁড়ানো। পাশে হাসপাতালের শেডে তালাবদ্ধ নতুন একটি ও নষ্ট একটি এম্বুলেন্স। মানে জরুরি কাজে বেসরকারি অ্যাম্বুলেন্সটি রেডি আর সরকারিটির তালাখোলার ঝামেলা। এই তালা সহজে খোলে না। এখানে ডাক্তারের মোট পদ ২৬টি। ২০টি পদে ২১ জন ও ৫ উপ-কেন্দ্রে ৫ জন। কিন্তু ৩৯তম বিসিএস থেকে ১০জন নিয়োগ পেয়ে মোট ডাক্তার ১৩ জন। সবাই মেডিকেল অফিসার। সকাল ৮টা থেকে ২টা পর্যন্ত ফিঙ্গারপ্রিন্ট দিয়ে হাজিরা দেন সবাই। সবাই প্রাথমিক চিকিৎসা দেন। কিন্তু কনসালটেন্ট ডাক্তার না থাকায় সাধারণ অপারেশনের জন্যও রোগীকে রেফার করা হয় রংপুরে, কুড়িগ্রামে। কিংবা যেনতেন ক্লিনিকে। একটি ক্লিনিকসহ ৩টি পয়েন্টে শুক্রবার বাইরে থেকে ডাক্তার আসেন এলাকায়। দেশে ১ হাজার ৫৮১ জন মানুষের জন্য ১ জন নিবন্ধিত চিকিৎসক। ১ লক্ষাধিক জনসংখ্যার ভাগে মোট ১৩জন ডাক্তার। চিলমারীতে তাহলে কত হাজারে ১ জন ডাক্তার?

দোতলাতে রোদ পোহাচ্ছেন সত্তুরোর্দ্ধ সাহেব আলি। হাঁপানি ও পায়ে পানি জমেছে। গ্রাম রমনা তেলিপাড়ায়। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ কুড়িগ্রামে রেফার করেছেন ২/৩ দিন আগে। কেনো যাননি, জানতে চাইলে তিনি হাঁপাতে হাঁপাতে বলেন, কুড়িগ্রামে যাওয়ার গাড়ি ভাড়া নাই বাবা। গত ১৩.০১.২০২০ তারিখ রাত সাড়ে ৮টায় যখন হাসপাতালে যাই, তখনও তিনি পুরুষ ওয়ার্ডে। পাশে ময়লা বিছানায় শুয়ে আছেন তার বৃদ্ধা বোন তীব্র ঠাণ্ডায় পাতলা একটি কম্বল জড়িয়ে। একই দিনে রাত নয়টায় মাথায় জখম নিয়ে এলেন একজন রোগী। জরুরি বিভাগে দায়িত্বরত ডা. আসিফ বাকি ডাক্তারদের ডেকে নিদান দিলেন। এক্স-রে মেশিন না থাকায় রোগীর সর্বশেষ পরিস্থিতি জানা সম্ভব না হওয়ায় স্যালাইন ও ইনজেকশন দিয়ে রংপুরে রেফার করলেন। ওয়ার্ডবয় ইব্রাহিম (৫২) জানান, ২০১০ সালের দিকে এক্স-রে মেশিন আনার কিছু দিনের মধ্যেই নষ্ট হয়ে যায়। সেই থেকে অকেজো হয়ে পড়ে আছে। আল্ট্রা সনোগ্রামও এত বড় হাসপাতালে হয় না মেশিনের অভাবে। রাষ্ট্রীয় সম্পদের কি নিদারুণ অপচয়।

ডা. মোস্তারি বেগম জানান, ২ জনের ল্যাব-টেকনিশিয়ানের পদ থাকলেও আছেন মাত্র ১ জন। তিনি রক্ত-মল-মূত্র-কফ সব পরীক্ষা করেন। জরুরি বিভাগ তো জরুরি বিভাগই। এখানে একজন রোগী প্রথমে আসবেন, তারপর তার কোন চিকিৎসা দরকার, তা ডাক্তারগণ ঠিক করবেন। কিন্তু জরুরি বিভাগে ডাক্তারের পদ আছে মাত্র ১টি।

অপারেশন থিয়েটার আছে। কিন্তু অপারেশন হয় না। যন্ত্রপাতিগুলো এমনি পড়ে আছে। অথচ পাশের ক্লিনিকে অপারেশনের জমজমাট ব্যবসা চলছে। কেন অপারেশন এখানে হয় না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, যে ১১ জন ডাক্তার আমরা আছি সবাই মেডিকেল অফিসার। অপারেশন করেন কনসালটেন্টগণ। কিন্তু তাঁদেরকে এখানে দেয়া হয়নি। আরও বলেন, এমনকি ইউনিসেফ ও সরকারের যৌথ প্রকল্প EMENও বাস্তবায়িত হচ্ছে না লোকবলের অভাবে।

২.

কাগজে-কলমে আছে ৫টি স্বাস্থ্য উপ-কেন্দ্র। কিন্তু বাস্তবে আছে একটি। তা জোড়গাছ হাটে অবস্থিত। এবার ৫ টির জায়গায় ৪ জনকে নিয়োগ দিয়েছেন সরকার। সেটি প্রায় গত ১০ বছর ধরে চালিয়ে আসছেন এমএলএসএস আ. জলিল সরকার। মাঝে বছরখানেক বা মাস কয়েকের জন্য ১/২ জন ডাক্তারে এসে গেছেন। তিনিই অফিস সহকারী, তিনিই ডাক্তার। ডা. মোস্তারি বেগম জানান, নতুন ডাক্তারদের মধ্য থেকে ১ জনকে সপ্তাহে ২ দিনের জন্য দায়িত্ব দেয়া হবে। তিনি হাটবারগুলোতে সেখানে বসবেন। বাকি উপ-স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলো কবে চালু হবে? অষ্টমীরচর, নয়ারহাট ও চিলমারী ইউনিয়নের বাসিন্দারা চিকিৎসা সেবা থেকে তাহলে বঞ্চিতই থাকবেন? সদর উপজেলাতেই ডাক্তাররা এসে থাকতে চান না, দুর্গম চরে তারা থাকবেন, এটা চাঁদে যাওয়ার মত কল্পনা বৈকি!

বাংলাদেশে ৫ বছরের কম বয়সী ৩৬ ভাগ শিশু খর্বকায়, ৩৩ভাগ শিশু কৃশকায়। পত্রিকায় প্রকাশ এই হারও চিলমারীতে সর্বাধিক। মাতৃমৃত্যুর হার প্রতি লাখে ১৯৬ জন, দুর্গম অষ্টমীর চর, নয়ারহাট ও চিলমারী ইউনিয়নে সেই হার তবে কত? যে প্রসূতি মার যন্ত্রণায় কাতরাতে কাতরাতে নৌকাতেই চলে যায় দুই ঘণ্টা। আর সেই প্রসব ব্যথা যদি রাতে ওঠে, সেই পরিস্থিতি তারাই জানেন যারা রাতে চর ও ব্রহ্মপুত্র পাড়ি দিয়েছেন।

যেসব রোগী এখানে ভর্তি করা হয়, তার তালিকা দিয়েছেন মিডওয়াইফ শাবানা নাজনীন(৩০)। সেগুলো হচ্ছে পেট ব্যথা, ডায়রিয়া, শ্বাসকষ্ট, নিউমোনিয়া, জ্বর, খিঁচুনি, নরমাল ডেলিভারি, প্রস্রাবের জ্বালা-পোড়া, আত্মহত্যা, মারামারি ও প্রেশার।

হাঁটছি। পথ-রাস্তা-সড়ক বলতে সাধারণত যা বোঝায় আমাদের সামনে তা নেই, যতদূর চোখ যায় শুধু বালুচর।...সকাল এগারোটার রোদে চারদিক যেন ঝলসে যাচ্ছে, পায়ের নিচে মোটাদানার বালু তেতে উঠেছে,কপালের ঘাম চুয়ে চুয়ে পড়ছে চোখে, জ্বালা করছে। একটা রুমালও নেই। সূর্যের তাপ থেকে সাময়িক রক্ষা পাবার জন্যে লুঙ্গি ও গামছা বের করে দুজনে মাথায় দিলাম। দুপুরে যে কী অবস্থা হবে কে জানে! আমরা কেবল চার-পাঁচ মাইল হেঁটে এসেছি, সামনে আরও দশ-এগারো মাইল। যাব আমরা মনতলা গ্রামে। ব্রহ্মপুত্র-পার্শ্ববর্তী এলাকার মানুষের জীবন ও জীবিকার ওপর কিছু তথ্য সংগ্রহ করব। (মোনাজাতউদ্দিন, মনতলা পথে, পথ থেকে পথে)। এই মনতলার ওপর এই প্রতিবেদনটা প্রকাশিত হয় ১৪ ডিসেম্বর '৮৯ সালে, দৈনিক খবরের কাগজে। চিকিৎসা ব্যবস্থায় সেই পরিস্থিতি এতটুকু কি বদলেছে? বদলেছে। সার, বিষ আর আর্সেনিকের কারণে নতুন অসংক্রামক রোগ এসেছে। চিকিৎসায় ফতুর হচ্ছে নতুন করে। বদলেছে এইটুকুই।


নাহিদ হাসান: রেল-নৌ, যোগাযোগ ও পরিবেশ উন্নয়ন গণকমিটির কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের সভাপতি।

এ সম্পর্কিত আরও খবর