সীমা এবং সীমালঙ্ঘন

, যুক্তিতর্ক

ড. মাহফুজ পারভেজ: অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম | 2023-08-26 18:29:49

বাকস্বাধীনতা নিয়ে একটি কথা অহরহ শুনি। তা হল 'তুমি যা বলছ, আমি তার চূড়ান্ত বিরোধী হতে পারি। কিন্তু তোমার সে কথা বলার অধিকার রক্ষার জন্য আমি শেষ পর্যন্ত লড়ব।'

যার নামে সাধারণত এই বিখ্যাত উক্তিটি চলে সেই মহান দার্শনিক হলেন ভলতেয়ার। ফরাসি এই চিন্তক সাম্য, মৈত্রী, স্বাধীনতার বিশ্বজনীন আবহে ১৭৮৯ সালে সম্পন্ন ফরাসি বিপ্লবের সঙ্গেও প্রাসঙ্গিক।

আরও পড়ুন: ভলতেয়ার: ফরাসি চিন্তার সৌরভ

ব্রিটিশ লেখিকা ইভলিন বিয়েট্রিস হল, যার ছদ্মনাম স্টিফেন জি ট্যালেনটায়ার, ১৯০৩ সালে লিখেছিলেন ভলতেয়ারের জীবনী ‘দ্যা লাইফ অব ভলতেয়ার’। এতে ভলতেয়ারের জীবন ও কর্মের পাশাপাশি অবিস্মরণীয় উক্তিসমূহও স্থান পেয়েছে এবং বাকস্বাধীনতার পক্ষে তার অবস্থানের বিষয়টিও সুস্পষ্টভাবে উপস্থাপিত হয়েছে।

লেখিকা ইভলিন ১৯০৬ সাল নাগাদ শেষ করেন আর একটি বই ‘দ্য ফ্রেন্ডস অব ভলতেয়ার’। গল্পের ছলে বলা এই জীবনীতে আছে দশ জন মানুষের কথা, যাদের জীবন শুধু পরস্পরের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পৃক্তই ছিল না, তারা ছিলেন ভলতেয়ারের সমসাময়িক এবং বন্ধুস্থানীয় এবং সকলেই সাম্য, মৈত্রী, স্বাধীনতা, বাক ও ব্যক্তি অধিকারের একনিষ্ঠ প্রচারক ছিলেন।

ফরাসি দেশে ভলতেয়ার ও তার বন্ধুদের মতো এমন বহু ব্যক্তি ও বন্ধুগোষ্ঠীর দেখা বিশ্বের নানা দেশেই পাওয়া সম্ভব, যারা গণতন্ত্র, মানবাধিকার, বাক-ব্যক্তি-সংবাদপত্রের স্বাধীনতার জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন। যে কারণে ইউরোপ ও আমেরিকার দেশগুলোতে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেয়েছে, বাকস্বাধীনতা নিশ্চিত হয়েছে, সংবাদপত্রের অধিকার বজায় রয়েছে।

কোনো দেশে এসব অধিকার আপনা আপনি আসেনি। এসেছে বুদ্ধিবৃত্তিক তৎপরতা ও সামাজিক-রাজনৈতিক আন্দোলনের মাধ্যমে, এটাই ঐতিহাসিক সত্য। আবার এটাও নির্মম সত্য যে, এসব অধিকার কেবল কাগজে-কলমে লিপিবদ্ধ থাকলেই বাস্তবে আসে না, জনগণের সর্বস্তরে সাংস্কৃতিক মান ও আইনের প্রতি শ্রদ্ধার মাধ্যমেই এসবকে বাস্তব জীবনে অর্থবহ করতে হয়েছে।

বিশ্বের প্রায়-সকল দেশই এখন (কয়েকটি রাজতন্ত্র ও স্বৈর-সামরিকতন্ত্র ব্যতীত) গণতন্ত্র, মানবাধিকার, বাক-ব্যক্তি-সংবাদপত্রের স্বাধীনতাকে আদর্শ রূপে গ্রহণ করেছে। কিন্তু কাগজ-কলমে বা আইনের বইয়ে এসব লিপিবদ্ধ থাকলেও বাস্তব ক্ষেত্রে এসব উচ্চ রাজনৈতিক মতাদর্শ প্রতিষ্ঠা পায়নি। ভঙ্গুর বা বিকৃতভাবে যতটুকু কার্যকর আছে, তাতে জনগণের কষ্টের লাঘব হয়নি। সংখ্যালঘু, প্রান্তিক, ভিন্নমতের সুরক্ষা আসেনি। জনদীর্ঘশ্বাস প্রায়শই রক্ত, মৃত্যু, নির্যাতনের সঙ্গে মিশে মিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে।

জন অধিকারের সঙ্গে সঙ্গে বাক-ব্যক্তি- সংবাদপত্রের স্বাধীনতাকে শক্তি, দম্ভ, হামলা, মামলা, মোকদ্দমার দ্বারা আক্রান্ত করা হলে তা সকলে মিলে প্রতিহত করার বিষয়। এমন অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি শুভ বোধসম্পন্ন, গণতান্ত্রিক, মানবিক সমাজের জন্য চরম ক্ষতিকর এবং সুশাসনের পরিপন্থী। এমন শক্তিমত্তার প্রদর্শন গণতন্ত্র ও বাকস্বাধীনতার মৌলিক চেতনাকে বিপদগ্রস্ত ও কালিমালিপ্ত করার জন্য যথেষ্ট।

এটা ঠিক যে, বাকস্বাধীনতা বা গণতন্ত্রের সুযোগ নিয়ে যথেচ্ছাচার করাও মোটেই সমীচীন নয়। ভুল তথ্য, গুজব, উদ্দেশ্যমূলক কু প্রচারণা, ব্যক্তির মানসম্ভ্রম হানিকর কিছু করা হলে তাকে বাকস্বাধীনতা বলা যাবেনা। এমনটি করা হলে, তার প্রতিবিধান রাখতে হবে। আহত বা ক্ষতির সম্মুখীনদের মতামত, বক্তব্য ও আত্মপক্ষ সমর্থনের উপযুক্ত সুযোগ ও ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। এমন ব্যবস্থা আইনেই আছে।

কিন্তু কথার জবাব কথায়, তথ্যের জবাব তথ্যে এবং লেখার জবাব লেখায় না দিয়ে আক্রমণ ও শক্তির পথ বেছে নেওয়া হলে তা হবে বিপজ্জনক। এমনটি গণতন্ত্রের সহনশীল ভাবাদর্শের বিপরীত অবস্থান। গণতান্ত্রিক সমাজ ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতার প্রতি আস্থাশীল প্রতিটি মানুষকে এজন্য সতর্ক ও সজাগ থাকতে হয়, যাতে কেউ বাকস্বাধীনতার সীমা নষ্ট করতে না পারে এবং কেউ যাতে বাকস্বাধীনতার সুযোগ ও সীমাকে লঙ্ঘন করতে না পারে।

মোদ্দা কথায়, গণতন্ত্রের সৌন্দর্যকে ফুটিয়ে তুলতে হলে সব ধরনের অধিকার চর্চার ক্ষেত্রে কঠোর দায়িত্বশীলতা অবলম্বনই কাম্য। যার যেমন দায়িত্বের সীমা তার মধ্যেই থাকা আবশ্যক। একে অপব্যবহার বা সীমালঙ্ঘন করে নয়, বরং সঠিকভাবে ব্যবহারের মাধ্যমেই প্রস্ফুটিত করা সম্ভব গণতন্ত্রের শত ফুল।

এ সম্পর্কিত আরও খবর