দায় কি শুধু রাষ্ট্রের?

, যুক্তিতর্ক

শাহজাহান মোল্লা | 2023-08-27 06:43:21

পুরো বিশ্ব এখন করোনা ঝড়ে লণ্ডভণ্ড। বিশ্বের ক্ষমতাশালী প্রভাবশালী যাই বলিনা কেনো, কোনো দেশই বাদ যাচ্ছে না করোনাভাইরাসের প্রভাব থেকে। সব বয়সী মানুষের মাঝে এখন একটাই আলোচনা 'করোনা'। এ থেকে পরিত্রাণের কোনো তত্ব বা ওষুধ এখনো বের হয়নি। যতটুক প্রতিরোধ সেটা শুধু 'সেলফ প্রটেকশন' বা নিজেকে সুরক্ষা। চীনের উহান রাজ্য থেকে সৃষ্ট ভাইরাস এখন পুরো বিশ্ব কাঁপিয়ে বেড়াচ্ছে। বাদ যাচ্ছে না আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশও।

বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত ১৮ জনের শরীরে করোনাভাইরাস বা কোভিড-১৯ শনাক্ত হয়েছে। তাদের মধ্যে একজন মারা গেছেন। ১৬ কোটি মানুষের দেশ এখনো ব্যাপকভাবে ছড়ায়নি। তবে ছড়াতে কতক্ষণ? আমাদের দেশের ঐতিহ্য হচ্ছে মানুষে মানুষে ভ্রাতৃত্ব, সঙ্গবন্ধ হয়ে গল্প আড্ডা। কোনো একটি উপলক্ষ্যেকে ঘিরে একত্রিত হওয়া এটা বাঙালির চিরায়ত অভ্যেস। চাইলেও সহজে রোধ করা দুষ্কর।

করোনাভাইরাস এক দেশ থেকে অন্য দেশে ছড়িয়ে পড়ছে মানুষের মাধ্যমেই। বিশেষ করে যারা প্রবাসী আসছেন বা বিভিন্ন দেশে যাচ্ছেন তাদের শরীর থেকেই ছড়িয়ে পড়ছে মারাত্মক এই ভাইরাসটি। তাই বিশ্বের বিভিন্ন দেশ অন্য দেশের সঙ্গে ফ্লাইট বাতিল করে চলাচলে বিধি-নিষেধ আরোপ করেছে। কানাডাসহ অনেক দেশেই হোম কোয়ারেন্টাই বা সঙ্গরোধ নিশ্চিত করতে সরকারি নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

আমাদের দেশেও বিষয়টি বার বার বলা হচ্ছে যারা বিদেশ থেকে আসছেন তারা নিজের ও পরিবারের তথা দেশের মানুষের কথা চিন্তা করে সঙ্গরোধে থাকুন। এই কথা মানছেন কয়জন? আবার যারা মানছেন তাদেরও পড়তে হচ্ছে এক ধরনের বিড়ম্বনায়। দেশের কিছু অতি উৎসাহী জনগণ সেই হোম কোয়ারেন্টাই বা সঙ্গরোধ দেখতে ভিড় করছেন। অনেকে বলছেন বাঙালি পারেও বটে।

এবার আসা যাক করোনাভাইরাস ও আমাদের দেশের বাস্তবতা। যেহেতু ভাইরাসটি প্রতিরোধে কোনো ওষুধ বা ভ্যাকসিন নেই। তাই সচেতনতাই সর্বোত্তম পন্থা। এই করোনা ইস্যুতে বিভিন্ন মহল থেকে দাবি উঠেছে লক ডাউন করে দেওয়া হোক। সরকারের বিভিন্ন দায়িত্বশীল ব্যক্তিরাও বলেছেন যখন যেখানে প্রয়োজন লক ডাউন করা হবে। এই একটা কথায় আমরা ‍হুজুকে বাঙালি পরিমরি করে নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস মজুদ করা শুরু করলাম।

কিন্তু এই সমাজে যে লাখো মানুষ আছে যাদের দিনে কাজ করে দিনে খেতে হয় অর্থাৎ দিন মজুর। এই ঢাকা শহরে রাস্তায় বের হলে এখনো অনেক ভিক্ষুককে ভিক্ষা করতে দেখা যায়। সারাদিন রোদ বৃষ্টিকে উপেক্ষা করে রিকশা চালক রিকশা চালায়। ইট ভাঙা শ্রমিক ইট ভাঙে। তাদের প্রত্যেকের পরিবার আছে। সারাদিন কাজ করার পর যখন সন্ধ্যায় টাকা হাতে পায় তখন বাজার নিয়ে ঘরে ফেরে তার ঘরের বাচ্চা চেয়ে থাকে কখন বাবা আসবে, স্ত্রী অপেক্ষায় থাকে বাজারের। এরপর ডাল ভাত রান্না করে পেটে ভাত যায়। এই শ্রেণির মানুষ নেহায়েত কম নয়?

তাদের কাছে তো পর্যাপ্ত টাকা থাকার কথা নয় যে দাম বাড়বে বলে এক বস্তা চাল, ৫ কেজি ডাল, আলু, কিনে রাখবে। তারা তো প্রতিদিনের বাজারের খরিদদার। আমাদের দেশে বহুল প্রচলিত হুজুকে বাঙালী। এই যে লক ডাউন করা হবে বলার সঙ্গে সঙ্গে আমরা ভেবে নিলাম সব বুঝে বন্ধ হয়ে যাবে। কিছুই পাওয়া যাবে না। সবাই লাইন ধরে বাজারে হুড়মুড়িয়ে কেনাকাটা শুরু করলাম। মজুদ করলাম কিন্তু ওই যে একই আকাশের নিচে বসবাস করা দিনমজুর রিকশা চালক তাদের কথা একবারো ভাবলাম না। কেউ যদি বের না হয় রিকসা চালক ভাড়া পাবে কোথায়? ইট ভাঙা শ্রমিক কাজ পাবে কোথায়?

আর একটা কথা বেশ প্রচলিত কারো পৌষ মাস কারো সর্বনাশ। এই যে লক ডাউন এর কারণে আমাদের সভ্য ব্যবসায়ী সমাজ দাম বাড়িয়ে দিলেন। প্রতিটি ডিমের দাম দুই টাকা করে বাড়িয়ে দিলেন। আলুর দাম কেজিতে ৫ টাকা বৃদ্ধি। চালের দাম বৃদ্ধি। পেয়াজ ৪০ টাকা থেকে হঠাৎ ৮০ টাকা। এটা ঠেকাবে কে?

বলা হচ্ছে লক ডাউন করে মানুষের প্রয়োজনীয় জিনিস সরকার থেকে সরবরাহ করা। কানাডার প্রধানমন্ত্রীর উদাহরণ টেনে আনছেন অনেকে? তাদের কাছে আমার প্রশ্ন আমরা কি সেই সক্ষমতা অর্জন করেছি। ১৬ কোটি মানুষকে ঘরে বসিয়ে খাওয়াতে পারবো। এখানে ধরে নিলাম ১৬ কোটির সবাই অভাবী না। কিন্তু তাদের মধ্যে থেকে যদি ৫ কোটিও হয় তাদের কি খাদ্যের জোগান দেওয়া সম্ভব? আর ধরে নিলাম সরকার ব্যবস্থা করল। কিন্তু আমাদের অতীত রেকর্ড কি বলে, সরকারের সেই সহায়তা কি প্রকৃত অভাবীর কাছে পৌঁছাবে? সেই নিশ্চয়তা কে দেবে। দেখা যাবে যার আছে সেই বেশি করে মজুদ করেছেন। তার নিকট আত্মীয়র ঘরে যাচ্ছে। বলা হবে আপনি বাঁচলে বাপের নাম। তো তাহলে কেনো এই লক ডাউন।

বলতেই পারেন তাই বলে কি সবাই মরবে? আমরা একটু খেয়াল করি না। এই ভাইরাসটি যেহেতু প্রবাসীদের মাধ্যমে ছড়াচ্ছে তাই সকলেই যার যার অবস্থান থেকে সচেতন থাকি তাদের বোঝানোর চেষ্টা করি বিদেশ থেকে আসলে অন্তত ১৪ দিন সঙ্গরোধে থাকুন। নিজে বাঁচুন পরিবারকে বাঁচান তথা দেশকে রক্ষা করেন। বিভিন্ন দেশ থেকে আসা ফ্লাইটের দিকে নজর দিন। যার পরিবারের লোক আসছে আর যিনি আসছেন তিনি সর্তক না হলে সরকার কি করবে? তাই বলবো এখানে দায় কি শুধুই রাষ্ট্রের। আপনি যদি সর্তক না হোন তাহলে আপনার প্রিয়জন ঝুঁকিতে পড়বে আগে। তারপর অন্য প্রতিবেশী। তাই এখন সিদ্ধান্ত নিতে হবে আমরা প্রিয়জনদের রক্ষা করব না মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেবো। অযথা সরকারের দায় দিয়ে কেউ পার পাবেন না। আগে নিজে বাঁচুন পরে না হয় সরকার বা অন্যদের দোষ খোঁজা যাবে।

 

শাহজাহান মোল্লা: সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম

এ সম্পর্কিত আরও খবর