বিদ্যুৎ পেয়েছে লেটার, ফেলের খাতায় গ্যাস, ঝরে পড়েছে কয়লা

বিদ্যুৎ-জ্বালানী, অর্থনীতি

সেরাজুল ইসলাম সিরাজ, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম | 2023-09-01 16:58:35

স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর শুভক্ষণে মুজিব শতবর্ষ উৎসবের মাত্রাকে বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। যে রাখাল রাজাকে নিয়ে এতো আয়োজন এতো উন্মাদনা বাংলাদেশ কি তার জ্বালানি নীতি যথাযথভাবে অনুসরণ করেছে বা করছে।

বিশেষ করে তার কন্যা এবং তারই হাতে গড়া দল আওয়ামী লীগ যখন ক্ষমতাসীন, তখন চাহিদার পারদটা একটু চড়া থাকবে এটাই স্বাভাবিক। প্রত্যাশার সেই পারদের বিপরীতে পরিসংখ্যান কি স্বস্তিদায়ক। উত্তর হচ্ছে বিদ্যুৎ খাত লেটার মার্ক নিয়ে উত্তীর্ণ হয়েছে, গ্যাস সেক্টর টেনে-টুনে পাস, আর কালোমানিক (কয়লা) প্রাথমিকের ঝরে পড়া ছাত্রদের মতো। দুই দশক আগে বিদ্যালয় থেকে ঝরে পড়েছে। এখন অনেকেই স্বীকার করতে বাধ্য হচ্ছেন বঙ্গবন্ধুর অনুসৃত জ্বালানি নীতি ও পথ হারিয়ে ফেলেছে বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধুর দর্শন ছিল দেশীয় সম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহার, আর বাংলাদেশ এখন হাটছে আমদানি নির্ভরতার পথে। একে চরমঝূঁকিপুর্ণ মনে করা হচ্ছে। বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের সদস্য মকবুল ই ইলাহী চৌধুরী বলেছেন, আমরা এখন যেভাবে আমদানি নির্ভরতার দিকে যাচ্ছি ২০৩০ সালে ২৫-৩০ বিলিয়ন ডলার ব্যয় হবে জ্বালানি আমদানিতে। ফরেন রিজার্ভের সিংহভাগ যদি জ্বালানি ব্যয় করি তাহলে উন্নত দেশে যাওয়া কঠিন হয়ে পড়বে।

সুবর্ণজয়ন্তীতে বিদ্যুৎ খাত

বিদ্যুতের অর্জন আকাশচুম্বি, প্রায় সবার ঘরে ঘরে আলোক ঝলমলে যা এক দশক আগেও অনেকের কল্পনাতেও ছিল না। ২০০৮ সালে নির্বাচনী ইশতেহারে যখন সবার ঘরে ঘরে বিদ্যুতের কথা বলা হলো, অনেক বিশেষজ্ঞ তখন নাক সিটকে ছিলেন। তারা ইনিয়ে বিনিয়ে বলেছিলেন, এটি হচ্ছে নির্বাচনী স্ট্যান্ডবাজি। একযুগ পরে এসে বাংলাদেশের বিদ্যুৎ খাত অনন্য উচ্চতায় আসীন হয়েছে। সুবর্ণজয়ন্তীর এই পথচলায় বিদ্যুৎ খাতের এই পথচলা মোটেও কোমল ছিলনা। বলা চলে থমকে ছিল এর অগ্রযাত্রা। যা দৃশ্যমান সবটাই বলা চলে বিগত এক যুগের অর্জন।

১৯০১ সালের ৭ ডিসেম্বর আহসান মঞ্জিলে জেনারেটরের সহায়তায় বিদ্যুৎ সরবরাহের মাধ্যমে এই অঞ্চলে বিদ্যুতের যাত্রা শুরু হয়। ১৯৩০ সালে বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় প্রথম বিদ্যুৎ বিতরণ ব্যবস্থা চালু হয়। পরবর্তী দুই দশকে ১৭ টি প্রাদেশিক জেলায় শুধুমাত্র রাতের বেলায় সীমিত সময়ে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হতো। ১৯৪৮ সালে, বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থাপনা, পরিকল্পনা ও উন্নয়নের লক্ষ্যে সরকারি পর্যায়ে বিদ্যুৎ অধিদপ্তর স্থাপন করা হয়। ১৯৫৯ সালে পানি ও বিদ্যুৎ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (ওয়াপদা) গঠন করা হয়। ওই সময়ে সিদ্ধিরগঞ্জ, খুলনা ও চট্টগ্রামে অপেক্ষাকৃত বৃহৎ আকারের বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করা হয়। ওই সময়ে স্থাপিত কাপ্তাই ৪০ মেগাওয়াট ক্ষমতার বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি বৃহৎ কেন্দ্র হিসেবে বিবেচিত ছিল। ১৯৬২ সালে (ঢাকা-চট্টগ্রাম ১৩২ কেভি) প্রথম ট্রান্সমিশন লাইন চালু করা হয়। স্বাধীনতার পর জাতির জনক বঙ্গবন্ধু ওয়াপদাকে দুই ভাগে বিভক্ত করে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিউবো) এবং বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড গঠন করেন। এরপরও প্রায় সাড়ে তিন দশক বক্ররেখার চলেছে দেশের বিদ্যুৎ খাত।

বিদ্যুৎ খাতের ঘুরে দাঁড়ানো

২০০৯ হতে বর্তমান সময় পর্যন্ত ১৮,৫৬৬ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হয়েছে। ফলে বিদ্যুতের স্থাপিত ক্ষমতা ক্যাপটিভসহ ২৪,৯৮২ মেগাওয়াটে উন্নীত হয়েছে এবং বিদ্যুতের সুবিধাভোগী জনসংখ্যা ৪৭ হতে ৯৯ ভাগে উন্নীত হয়েছে। ১৪ হাজার ১১৫ মেগাওয়াট ক্ষমতার ৩৮টি বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণাধীন, ২ হাজার ৯৬১ মেগাওয়াট ক্ষমতার ২০টি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের চুক্তি স্বাক্ষর প্রক্রিয়াধীন (LOI এবং NOA প্রদান করা হয়েছে)। ৬৫০ মেগাওয়াট ক্ষমতার ৬টি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের দরপত্র প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। অদূর ভবিষ্যতে আরো ১৫ হাজার ১৯ মেগাওয়াট ক্ষমতার ৩৩ বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে।

বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিআইডিএস) এর এক সমীক্ষায় বলেছে, বাংলাদেশে প্রতি মিলিয়ন কিলো-ওয়াট-আওয়ার বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধি পেলে সামষ্টিক অর্থনীতিতে উাৎপাদন বৃদ্ধি পায় প্রায় ৪৬ মিলিয়ন টাকা হতে ১০৭ মিলিয়ন টাকা (১৯৯৫/৯৬ এর মূল্যকে স্থির ধরে)। আমেরিকান একটি সংস্থার সমীক্ষায় বলছে গ্রামে বিদ্যুতায়নের করাণে বাংলাদেশের শিশুদের গড় উচ্চতা বেড়ে গেছে। বিদ্যুৎ খাত যখন ভূয়সী প্রশংসার জোয়ারে ভাসছে, তখন জ্বালানি খাত ধুকছে বলা চলে। উন্নয়ন হলেও সেটি বিদ্যুৎ খাতের গতির সঙ্গে একেবারেই বেমানান।

বাংলাদেশের জ্বালানি খাত

এই খাতের অর্জনকে উদারপন্থীরা বলছেন টেনেটুনে পাস, কেউ বলছেন পাস মার্ক দেওয়া যায় না। বলা চলে আমদানি নির্ভরতার এখন মূখ্য হয়ে উঠেছে। যে কারণে এলএনজি আমদানির দিকে ঝুঁকতে হয়েছে বাংলাদেশকে। গ্যাস সংকট সামাল দিতে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানি করতে হচ্ছে। কক্সবাজারের মহেশখালিতে প্রতিটি ৫০০ এমএমসিএফডি ক্ষমতাসম্পন্ন দু’টি ভাসমান এলএনজি টার্মিনাল (এফএসআরইউ) স্থাপন করা হয়েছে। দৈনিক ৫০০ থেকে ৭০০ এমএমসিএফডি আরএলএনজি জাতীয় গ্যাস গ্রিডে আরএলএনজি সরবরাহ করা হচ্ছে। এতে সামাল দিতে না পারায় কক্সবাজারের মাতারবাড়িতে দৈনিক ১০০০ মিলিয়ন ঘনফুট রি-গ্যাসিফিকেশন ক্ষমতার একটি স্থলভিত্তিক এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। চড়া দরে এলএনজি আমদানি ব্যায় মেটাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। ভিন্ন চিত্র হতে পারতো যদি গ্যাস অনুসন্ধ্যান ও উন্নয়ন কার্যয়ক্রম জোরদার করা যেতো।

যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে গ্যাস নেটওয়ার্ক বৃদ্ধি ও অনুসন্ধ্যানের উদ্যোগ নেন বঙ্গবন্ধু। ব্রিটিশ তেল কোম্পানি শেল অয়েল পাইপলাইন নেটওয়ার্ক বাড়ানোর নির্দেশ দেন। তখন শেল অস্বীকৃতি জানালে ১৯৭৫ সালের ৯ আগস্ট শেলের নিকট থেকে তিতাস, হবিগঞ্জ, রশিদপুর, কৈলাশটিলা ও বাখরাবাদ-এ ৫টি গ্যাসক্ষেত্র ৪.৫ মিলিয়ন পাউন্ড স্টার্লিং মূল্যে কিনে নেন। উল্লিখিত ৫টি গ্যাসক্ষেত্রের Gas Initially in Place (GIIP) মজুদ ২০.৭৯ ট্রিলিয়ন ঘনফুট। সেসময়ে ৫টি গ্যাসক্ষেত্রের উত্তোলনযোগ্য গ্যাস মজুদের পরিমাণ ছিল ১৫.৪৪ ট্রিলিয়ন ঘনফুট, যার বর্তমান সমন্বিত গড় বিক্রয়মূল্য মোট প্রায় ৪৯.৮৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার অর্থাৎ ৪,২৪,০৯৬ কোটি টাকা।

স্বাধীনতার পূর্বে অনুসন্ধান ও উন্নয়ন কূপের সংখ্যা ছিলো যথাক্রমে  ২৫টি ও ১৫টি। স্বাধীনতার পর ৫০ বছরে অনুসন্ধান কূপ ৪৩টি এবং উন্নয়ন কূপ ১২১টি খনন করা হয়েছে। অর্থাৎ বছরে একটির কম অনুসন্ধ্যান কূপ খনন করেছে বাংলাদেশ। স্বাধীনতার পর অনশোরে ৯টি (বাপেক্স) এবং অফশোরে ২টি (আইওসি) গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কারের মাধ্যমে অনশোর ও অফশোরে গ্যাসক্ষেত্রের মোট সংখ্যা দাড়িয়েছে যথাক্রমে ১৭টি ও ২টি । স্বাধীনতার পূর্বে উৎপাদনরত কূপের সংখ্যা ছিলো ৮টি, স্বাধীনতার পর বর্তমানে এ সংখ্যা দাড়িয়েছে ১১১ টিতে। গ্যাসের গড় উৎপাদন ছিল দৈনিক ২৮ এমএমএসসিএফ, যা বর্তমানে দৈনিক ২,৫০০ এমএমসিএফ।

অথচ বাংলাদেশের গড় আবিষ্কারের হার অনেক উচ্চ। শুধুমাত্র যথাযথ উদ্যোগের অভাবে যেমন স্থলভাবে সেভাবে অগ্রগতি সাধিত হয়নি। তেমনি গভীর সাগরে বিশাল এলাকা জয় করেও অনেকটা হাত গুটিয়ে বসে রয়েছে।

ঝরে পড়েছে কয়লা

কয়লার ভবিষ্যত এর রঙের মতোই অন্ধকার। দেশের উত্তরাঞ্চলে ৫টি ফিল্ডে বিশাল মজুদ থাকলেও শুধুমাত্র বড়ুপুকুরিয়া থেকে সীমিত আকারে উত্তোলন করা হচ্ছে। অন্যগুলোর বিষয়ে মুখে কূলুপ এটে রয়েছে বিগত ৪টি সরকার। ফুলবাড়িতে থেকে বিএনপি সরকার জোর করে কয়লা তুলতে গিয়ে লঙ্কাকাণ্ড ঘটিয়ে ফেলে। এরপর থেকে কয়লা ক্ষেত্রগুলোর ফাইল সিল্ড করে রাখা হয়েছে। এটাকে বিদ্যালয় থেকে ঝরে পড়া ছাত্রের সঙ্গে তুলনা করেছেন অনেকে।

অথচ বলা হচ্ছে কয়লা উত্তোলনের এটাই শেষ সময়। বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান প্রকৌশলী বেলায়েত হোসেন বলেন, সারাবিশ্ব উন্নত হয়েছে কয়লা দিয়ে। এমন একটি দেশ দেখাতে পারবে না, কয়লা ছাড়া উন্নয়ন হয়েছে। বলা হয় গ্যাস দিয়ে বিদ্যুতের উৎপাদন খরচ কম। দেশের গ্যাস কমদামে পাই বলে। এলএনজির দাম যদি বিবেচনায় নেওয়া হয় তাহলে কি করে বলবো, গ্যাসের খরচ কম। আমাদের বিকল্প ফুয়েল রাখতে হবে। গ্যাসের উৎপাদন বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া উচিত ছিল। সেদিকে সেভাবে দৃষ্টি দেওয়া হচেছ না। দেশিয় জ্বালানির বিকল্প হতে পারে না। অবশ্যই বিকল্প রাখা উচিত। আর কয়লা হতে পারে উত্তম বিকল্প।

তিনি বলেন. বঙ্গবন্ধু যেটুকু করে গিয়েছিলেন সেটার সুবিধা ভোগ করছি। আমরা তার নীতি, পথও অনেকটা হারিয়ে ফেলেছি। আমাদের অনসোর ও অফসোরে সমানভাবে তেল-গ্যাস অনুসন্ধ্যান করে যেতে হবে।

এ সম্পর্কিত আরও খবর