এলপি গ্যাস সমন্বিত নীতিমালা-২০২১ ‘র খসড়া বিইআরসি আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। বিইআরসির ক্ষমতাকে খর্ব করার অপপ্রয়াস চলছে বলে মন্তব্য করেছে ক্যাব (কনজুমারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ)।
ক্যাব মনে করছে এতে দ্বৈত রেগুলেটর প্রতিষ্ঠা হবে। একাধিক জায়গা থেকে লাইসেন্স নিতে গিয়ে হয়রানি ও ঘুষ দুর্নীতির পরিমাণ বাড়বে। যার প্রভাব পড়বে পণ্যের উপর, পণ্যের মূল্য বেড়ে যাবে, ভোক্তাকে মাশুল গুণতে হবে। বিইআরসি আইন অনুযায়ী তাকেই রেগুলেটরের ভূমিকায় থাকতে দেওয়া উচিত।
ক্যাবের এই মতকে বিইআরসি আইনও সমর্থন করে। এলপিজি অপারেটররাও চান একক রেগুলেটর। কিন্তু জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ প্রথম থেকেই বিষয়টি তাদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে মরিয়া। অনেক আপত্তি অনেক বিতর্কের পরও এলপিজি লাইসেন্সিং ক্ষমতা হারাতে নারাজ।
ক্যাব তার লিখিত প্রস্তাবে বলেছে, ২০০৩ সালে করা বিইআরসি আইনের আলোকে পেট্রোলিয়ামজাত পদার্থের খুচরা ট্যারিফ প্রবিধানমালা-২০১২ ও পেট্রোলিয়ামজাত পদার্থ পরিবহন ট্যারিফ প্রবিধানমালা-২০১২ প্রণয়ন করে বিইআরসি। প্রবিধানমালা আইনমন্ত্রণালয়ে ভেটিংয়ের জন্য জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগে প্রেরণ করা হয়।
জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ সেই প্রবিধানমালা আটকে রেখে এলপিজি অপরেশনাল লাইসেন্সিং নীতিমালা-২০১৭ প্রণয়ন করে। এই নীতিমালায় এলপিজি মূল্যহার নির্ধারণ পদ্ধতি ও লাইসেন্সিং অবৈধভাবে নিজের হাতে রেখে দেয়। যে কারণে এতোদিন এলপি গ্যাসের মূল্য নির্ধারণ করতে পারেনি বিইআরসি। বিইআরসি আইনের সঙ্গে নীতিমালা সাংঘর্ষিক হওয়ার বিইআরসির পক্ষ থেকেও আপত্তি তোলা হয়। কিন্তু মন্ত্রণালয় তাতে কোনো কর্ণপাত না করে নিজের হাতে রেখে দেওয়ার পথে হাটে।
এভাবে কেটে গেছে কয়েক বছর। এখন এলপি গ্যাস সমন্বিত নীতিমালা-২০২১ প্রণয়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এতে সংশ্লিষ্ট সকলের মতামত চাওয়া হয়েছে। এতেও বিইআরসির কর্তৃত্ব খর্ব করা হয়েছে। ক্যাবের পক্ষ থেকে স্পষ্ট করে জানিয়ে দেওয়া হযেছে নীতিমালা আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
উল্লেখ্য বর্তমানে শুধু বিদ্যুৎ পাইকারি ও খুচরা মূল্য ও গ্যাসের শুধুমাত্র খুচরা মূল্য নির্ধারণ করছে বিইআরসি। জ্বালানি তেলের মূল্য বিইআরসি করার কথা থাকলেও বরাবরেই নির্বাহী আদেশে হয়ে আসছে।
ক্যাবের সুপারিশে বলা হয়েছে, রেগুলেটর একক প্রতিষ্ঠান হওয়া উচিত। ওয়ান স্টপ সার্ভিস থাকা উচিত। দুই জায়গা থেকে লাইসেন্স নিতে হচ্ছে, হয়রানি বেড়ে গেছে। আইনের সঙ্গে নীতিমালা সাংঘর্ষিক হলে আইন কার্যকর হবে। অনেক আপত্তির পরও মন্ত্রণালয়ের একরোখা মনোভাব দেখা যাচ্ছে। বিপিসি একদিকে ব্যবসা করছে, একই সঙ্গে নিজে রেগুলেট করতে চাইছে। এটি আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
আইন অনুযায়ী এলপিজির দর নির্ধারণের এখতিয়ার বিইআরসির হাতে থাকা উচিত। একইসঙ্গে সংঘার্তপুর্ণ কর্মকাণ্ড থেকে মন্ত্রণালয়কে বিরত থাকার সুপারিশ দিয়েছে ক্যাব।
প্রস্তাবিত নীতিমালার বেশ কিছু অনুচ্ছেদ (৬.২, ৬.৬, ৭(ক)(৬), ৭(ক)(৯), ৭(ক)(১১), ১০.১) বিইআরসি আইনের সঙ্গে অসামঞ্জস্যপুর্ণ ও পরষ্পর বিরোধী। বিইআরসি চিঠিতে নীতিমালা ও আইনের সঙ্গে অসামঞ্জস্যপুর্ণ হওয়ার বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছে। এলপিজির দর নির্ধারণ সংক্রান্ত হাইকোর্টের রিট মামলার ভিত্তিতে দর নির্ধারণ প্রক্রিয়া চলমান রেখেছে বিইআরসি। ওইসব সাংঘর্ষিক অনুচ্ছেদ নীতিমালায় গৃহীত হলে বিভিন্ন সময়ে দেওয়া হাইকোর্টের আদেশের বর্ত্যয় ঘটতে পারে শঙ্কা প্রকাশ করেছে বিইআরসি।
ক্যাবের জ্বালানি বিষয়ক উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. শামসুল আলম বার্তা২৪.কমকে বলেন, দুটো জিনিস মৌলিক, একটা সরকারের চিন্তা ভাবনা ভোক্তাবান্ধব হচ্ছে না। সরকারের মুল অবজেকটিভ হচ্ছে জনকল্যাণ করা ও জনগণের সুরক্ষা নিশ্চিত করা। এখন সবকিছুই হচ্ছে ব্যবসায়ীদের স্বার্থ সুরক্ষায়। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ চাই।
তিনি বলেন, মৌলিক জায়গাটা হচ্ছে, পেট্রোলিয়াম পণ্যের মূল্যটা সঠিকভাবে হতে হবে। ন্যূনতম ব্যয়ে সরবরাহে নিশ্চিত করা। জ্বালানি বিভাগকে পলিসি প্রণয়নে রেগুলেটর থাকতে হবে। বর্তমানে তারা সেই জায়গা থেকে নেমে প্রশাসনের কাজে নেমে। ইউটিলিটিগুলোতে নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে বিইআরসিকে অকার্যকর করে ফেলেছে। পেট্রোলিয়াম পণ্যের মূল্য প্রবিধান দ্বারা নির্ধারিত হতে হবে। কয়লা রিনিউয়েবল সম্পৃক্ত হতে হবে। গণশুনানির মাধ্যমে হতে হবে। মন্ত্রনালয় জোর করে বিইআরসি আইন অকারর্যকর করে রেখেছে।
এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, আমরা অনেক বিষয়ে উচ্চ আদালতে গিয়েছি। আমরা একটি প্রক্রিয়ায় গিয়েছি, প্রশাসনিক ভাবে সুরাহা না হলে আইনগতভাবে ব্যবস্থা নিতেই হবে। এটাতো থেমে থাকলে চলবে না।
জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের যুগ্ম সচিব ড. মহা. শের আলী বার্তা২৪.কমকে বলেন, খসড়া নীতিমালায় সংশ্লিষ্ট সকলের মতামত চাওয়া হয়েছে। কোনো অনুচ্ছেদ যদি আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হয় নিশ্চয় সেগুলো দেখা হবে।
তিনি আরও বলেন, লিখিত মতামত পাওয়া গেছে। এখন সকলের উপস্থিতিতে একটি সভা করে চূড়ান্ত করতে চায় মন্ত্রণালয়। আমরা চেয়েছিলাম এপ্রিলের মধ্যে চূড়ান্ত করতে, কিন্তু করোনার প্রকোপ বেড়ে যাওয়া ফিজিক্যাল মিটিং করা সম্ভব হচ্ছে না এখনই তাই কিছুটা বিলম্ব হতে পারে। আমরা চাচ্ছি বিষয়টি ফিজিক্যাল মিটিংয়ে চূড়ান্ত করতে।
এই খাতকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য এলপিজি বটলিং প্ল্যান্ট স্থাপন নীতিমালা-২০১৬, তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাস (অটোগ্যাস) রিফুয়েলিং স্টেশন ও রূপান্তর ওয়ার্কসপ স্থাপন, পরিচালনা এবং রক্ষণাবেক্ষণ নীতিমালা-২০১৬ এবং এলপি গ্যাস অপারেশনাল লাইসেন্সিং নীতিমালা-২০১৭ প্রণয়ন করা হয়। এই তিনটি নীতিমালাকে একত্র করে এলপি গ্যাস সমন্বিত নীতিমালা-২০২১ করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
এতোদিন পর্যন্ত এলপিজির দর ছিল কোম্পানিগুলোর ইচ্ছাধীন। দর নির্ধারণের বিষয়ে অনেকদিন ধরেই কথা হলেও জ্বালানি বিভাগ, বিইআরসি নাকি বিপিসি করবে সে নিয়ে ছিল রশি টানাটানি। সর্বশেষ ক্যাবের এক রিটের প্রেক্ষিতে হাইকোর্ট এলপিজির দর নির্ধারণ করার জন্য বিইআরসিকে শোকজ করে। সে মোতাবেক দর চূড়ান্ত করতে ১৪ জানুয়ারি গণশুনানি গ্রহণ করে বিইআরসি।
দ্রুতই জনপ্রিয় হয়ে উঠছে এই জ্বালানির ব্যবহার। ২০০৮-০৯ অর্থ বছরে দেশে এলপিজি ব্যবহৃত হয়েছে ৪৪ হাজার ৯৭৪ মেট্রিক টন। কয়েক বছরে চাহিদা বেড়ে ১২ লাখ টনে উন্নীত হয়েছে। জাইকার এক সমীক্ষায় বলা হয়েছে, ২০২৫ সালে ৩০ লাখ টন ও ২০৪১ সালে চাহিদা হবে ৬০ লাখ টন। সবচেয়ে বেশি হারে (৯২ শতাংশ) বেড়েছে ২০১৫-১৬ অর্থ বছরে। আমদানি নির্ভর এই জ্বালানির জন্য ৫৬টি কোম্পানিকে অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এরমধ্যে ২৮টি কোম্পানি মার্কেটে রয়েছে।