রাজশাহীতে মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষের প্রিয় আটাশ ও স্বর্ণা জাতের চালের দাম বাড়ায় ভোক্তাদের মধ্যে অসন্তোষ দেখা দিয়েছে। রাজশাহীতে এক সপ্তাহের ব্যবধানে এই চালের দাম বস্তাপ্রতি ১০০ থেকে ১৫০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। নতুন ধান আসার অপেক্ষায় থাকলেও বর্তমান পরিস্থিতিতে মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো চরম ভোগান্তিতে পড়েছে।
এদিকে দেশের চালের বাজারে অস্থিরতার জন্য মিল মালিক ও ব্যবসায়ীদের মধ্যে দোষারোপের পালা অব্যাহত রয়েছে। ব্যবসায়ীর অভিযোগ, মিল মালিকরা কৃত্রিম সংকট তৈরি করে মজুদের ঘাটতির অজুহাতে চালের দাম বাড়াচ্ছে। পর্যাপ্ত মজুদ থাকার পরও এই কারসাজি ভোক্তাদের জীবনযাত্রার ব্যয় আরও বাড়িয়ে তুলছে।
অন্যদিকে মিল মালিকরা বলছেন, ধানের বাজারে মূল্য বৃদ্ধি এবং উৎপাদন খরচ বেশি হওয়ার কারণে চালের দাম বাড়ানো হয়েছে। ধানের সরবরাহ কম থাকায় মিল পর্যায়ে চাহিদা মেটানো কঠিন হয়ে পড়েছে। নতুন ধান ওঠার আগে এই অস্থিরতা স্বাভাবিক ঘটনা। ধানের উৎপাদন খরচ এবং পরিবহন খরচ বেড়ে যাওয়ার বিষয়টিও চালের মূল্য বৃদ্ধির কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন তারা।
ক্রেতারা বলছেন, সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগ থাকা সত্ত্বেও চালের বাজারে অস্থিরতা কাটছে না। প্রতিদিনই দাম বাড়ছে বিভিন্ন ধরনের চালের। গত এক মাসের মধ্যে চালের দাম সর্বোচ্চ ৮ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। পাইকারি থেকে খুচরা পর্যায়ে চালের এই দাম বাড়ানোর জন্য ব্যবসায়ীরা একে অপরকে দোষারোপ করছেন।
রাজশাহীর সাহেব বাজার, নিউ মার্কেটের পূর্ব পার্শ্বে চালের আড়তসহ বিভিন্ন খুচরা ও পাইকারি বাজারে গিয়ে দেখা গেছে, সব ধরনের চালের দামই বেড়ে গেছে। আটাশ ও স্বর্ণা জাতের চালের দাম বৃদ্ধির হার সবচেয়ে বেশি।
মেসার্স সুশীল চাল ভান্ডারের বিক্রেতা মো. রাজু আহমেদ জানান, গত সপ্তাহে ৫০ কেজির আটাশ চালের বস্তা বিক্রি হয়েছে তিন হাজার ২০০ থেকে তিন হাজার ৬০০ টাকায়। অথচ এক সপ্তাহ আগেও এই চাল বিক্রি হয়েছে দুই হাজার ৯০০ থেকে তিন হাজার টাকায়। ধাপে ধাপে দাম বাড়ায় ক্রেতারাও বিপদে পড়ছেন। আমরা নিজেরাও লাভ করছি না, কারণ পাইকাররা বেশি দামে আমাদের চাল দিচ্ছে।
মেসার্স এ পি চাউল ভান্ডারের ব্যবস্থাপক অশোক প্রসাদ জানান, মধ্যবিত্তরা সাধারণত আটাশ ও স্বর্ণা চাল বেশি কেনেন। কিন্তু বর্তমানে এই চালের মজুদ কম থাকায় দাম বেড়ে গেছে। অশোক প্রসাদ আশাবাদী, নভেম্বরের শেষ দিকে নতুন ধান বাজারে আসলে এই দুই জাতের চালের দাম কমতে পারে।
ভাই ভাই রাইস এজেন্সির স্বত্বাধিকারী মামুন হোসেন বলেন, মোটা চালের পাইকারি দামও প্রতি বস্তায় ৮০ থেকে ১২০ টাকা বেড়েছে। মিল মালিকরা সরবরাহ সংকটের অজুহাত দেখিয়ে আমাদের কাছ থেকে বেশি দাম নিচ্ছে। আসলে তাদের কাছে পর্যাপ্ত মজুদ রয়েছে। তারা কৃত্রিম সংকট তৈরি করে চালের দাম বাড়াচ্ছে।
মা রাইস এজেন্সির ব্যবস্থাপক নুরুল আমিন বলেন, চালের দাম বাড়ার পেছনে ধানের দাম বেড়ে যাওয়া একটি বড় কারণ। মিল মালিকরা নতুন মৌসুম শুরুর আগে মজুদ করা চাল বেশি দামে বিক্রি করছে। এর ফলে চালের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখা যাচ্ছে না।
এদিকে মিনিকেট ও নাজিরশাইল জাতের চালের দামও বেড়েছে। মানভেদে প্রতি বস্তায় ৫০ থেকে ১০০ টাকা বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে। মিনিকেট চাল প্রতি বস্তায় তিন হাজার ৩০০ থেকে তিন হাজার ৮০০ টাকায় এবং নাজিরশাইল চাল তিন হাজার ৩৫০ থেকে তিন হাজার ৯০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
খুচরা পর্যায়ে চালের এই দাম বৃদ্ধির ফলে ভোক্তাদের ওপর চাপ আরও বাড়ছে। টিকা পাড়ার বাসিন্দা ইসমাইল হোসেন বলেন, এক সপ্তাহ আগে আটাশ চাল ৬২ টাকা কেজি দরে কিনেছি, আর আজ দোকানদার চাইছে ৬৫ টাকা। তিন মাস আগেও এই চালের দাম ছিল ৫৫ টাকা। গত তিন মাসে পাঁচ থেকে ছয়বার দাম বেড়েছে।
সাহেব বাজারে বাজার করতে আসা গৃহবধূ ইসরাত জাহান বলেন, আমাদের ছয় জনের পরিবার। খুব কষ্ট করে সংসার চালাতে হয়। চাল ৬৫ টাকা, আলু ৭০ টাকা—এভাবে চললে আমরা খাব কী? আমাদের আয়ের তুলনায় খরচ অনেক বেশি হয়ে যাচ্ছে।
রাজশাহী জেলা ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের সহকারী পরিচালক মাসুম আলী বলেন, আমাদের কাজ হচ্ছে বাজারে কোথাও কোনো ব্যবসায়ী মজুদদারি বা সিন্ডিকেট করছে কি না তা তদারকি করা। যদি প্রমাণ পাই, আমরা অভিযানে গিয়ে ব্যবস্থা নেব। তবে বাজারে পণ্যের দাম নির্ধারণ করা আমাদের দায়িত্ব নয়। ব্যবসায়ীরা যদি দাম নিয়ে কারসাজি করে, আমরা সেটার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেব।