আপদমস্তক দুর্নীতিতে ডুবিয়ে থাকা কর্মকর্তার নাম আইয়ুব খান চৌধুরী, (পেট্রোবাংলার পরিচালক) যার নিজের যোগদানটাই বয়স গোপন করে জালিয়াতির মাধ্যমে। আবার নিজের দুই ছেলেকে নিয়োগ দিয়েছেন মহাজালিয়াতি করে।
যার পুরো চাকরির জীবনে নানা দুর্নীতি অনিয়মে ঠাসা, রয়েছে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ। অনেক অভিযোগ উঠলেও পুরো চাকরি জীবন দাপটের সঙ্গে কাটিয়ে এসেছেন, তাকে অনেকে খুটির সঙ্গে তুলনা করেছেন, যতো তলিয়ে যান (সমালোচিত হন) তার ভিত ততো মজবুত হয়েছে। কোনো অভিযোগ তাকে স্পর্শ করতে পারেনি। খোদ দুর্নীতি দমন কমিশনের তদন্তে উঠে এসেছে নানাবিধ দুর্নীতি।
চাকরির মেয়াদ শেষ হতে চলছে তাকেই আবার চুক্তি ভিত্তিক নিয়োগ দেওয়ার গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়েছে। এই ধরণের অসৎ অফিসারদের চুক্তি ভিত্তিক নিয়োগ সৎ অফিসারদের চরম হতাশ করে। তারা কাজের প্রতি আগ্রহ সৎ থাকার স্পৃহা হারিয়ে ফেলেন। প্রমোশন এবং শীর্ষপদের জন্য যোগ্যতা, দক্ষতার পাশাপাশি সততাকে মাপকাঠি বিবেচনা করা হয়। কিন্তু চিহ্নিত কিছু কর্মকর্তার ক্ষেত্রে তা ব্যতিক্রম লক্ষ্যণীয়। বড় বড় কেলেঙ্কারির হোতারা ভালো পোস্টিং বাগিয়ে নিচ্ছেন। এসব অসৎ অফিসাররা সিন্ডিকেট মেইনটেইন করেন, আবার উপরের দিকে থাকা কর্মকর্তারাও মাসোহারায় আশায় তাদের মদদ দিয়ে যান। কারণ সৎ অফিসাররা পদায়ন হলে তাদের অনেক আদেশ প্রতিপালন করবেন না এবং বিশেষ সুবিধা পাওয়ার কোনো সুযোগ থাকে না।
আইয়ুব খান চৌধুরী জীবন শুরু করেন (১৯৮৭ সালে) ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকে চাকরির মাধ্যমে। চেক জালিয়াতির কারণে বরখাস্ত হন (স্মারক নং ৩৬৩০/৯২) অর্থ আদায়ে তার নামে মামলা (চট্টগ্রাম কোতয়ালী থানার মামলা নম্বর ১১ তারিখ ৬ মার্চ ১৯৯১) দায়ের করে ইউসিবিএল। পরে জালিয়াতির টাকা ফেরত দিয়ে আপোষ করেন।
দুদকের তদন্তে এসেছে, আইয়ুব খান চৌধুরী পেট্রোবাংলার সহকারি ব্যবস্থাপক (প্রশাসন) পদে ভুয়া জন্ম তারিখ দিয়ে নিয়োগ পান। ওই পদে বয়সসীমা ছিল ২৭ বছর (নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দৈনিক দিনকাল ২ সেপ্টেম্বর ১৯৯১)। ১৯৯১ সালের ২১ সেপ্টেম্বর আবেদনের শেষ তারিখে তার বয়স ছিল (জন্ম তারিখ ৪ আগস্ট ১৯৬২) ছিল ২৯ বছর ১ মাস ৭দিন।
২০১৪ সালের ১ অক্টোবর কর্ণফূলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির এমডি হিসেবে নিয়োগ পান। সেখানে তার দুই ছেলেকে (আশেক উল্লা চৌধুরী ও মহিউদ্দিন চৌধুরী) নিয়োগ দিতে হেন অপকর্ম নেই সে করেন নি। বড় ছেলে আশেক উল্লা চৌধুরীকে নিয়োগ দিতে বোর্ডের সিদ্ধান্তকে বাইপাস করেন। বোর্ডে সিদ্ধান্ত ছিল বুয়েটের মাধ্যমে পরীক্ষা নেওয়া, কিন্তু তা না করে নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য পেট্রোবাংলার মাধ্যমে পরীক্ষা নেন বিধি বর্হিভূতভাবে। উপ-ব্যবস্থাপক (কারিগরি) পদের জন্য ৫ বছরের অভিজ্ঞতা বাধ্যতামুলক হলেও জব্দ করা আশেক উল্লা চৌধুরীর ব্যক্তিগত নথিতে অভিজ্ঞতার সনদ খুজে পায় নি দুদক। এমনকি দুদকের জিজ্ঞাসাবাদেও অভিজ্ঞতার সনদ দেখাতে ব্যর্থ হয়েছেন।
এমনকি ছেলে এবং আরেক প্রার্থীর অভিজ্ঞতা পুর্ণ করার জন্য বিধি বর্হিভূতভাবে ৫ মাস ১৮দিন (২২/১২/২০১৪-১০/৬/২০১৫) নিয়োগ ফাইল আটকে রেখেছিলেন আইয়ুব খান। তারপর নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। অথচ তখন তাদের জনবল সংকটে কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছিল। একই নিয়োগে কামরুল ইসলাম নামের একজন বিভাগীয় প্রার্থী (সহকারি প্রকৌশলী) লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষায় মেধা তালিকায় পঞ্চম স্থান অধিকার করেন। মোট ৮জনকে নিয়োগ দেওয়া হলেও তাকে নিয়োগ দেওয়া হয়নি। নিয়োগ দাবী করলে তাকে উল্টো সাময়িক বহিস্কার করেন আইয়ুব খান চৌধুরী (শ্রম আদালতের মামলা ২০/২০১৭)। দুদকের তদন্তে ওই নিয়োগে বিশাল কেলেঙ্কারির ঘটনা সামনে ওঠে আসে।
ছোট ছেলে মহিউদ্দিন চৌধুরীকেও কেজিডিসিএল’এ নিয়োগ নিতে নানান অনিয়মের অশ্রয় নেন। ছেলেটিও যেনো পিতার চেয়ে এক কাঠি সরেস। উপ-ব্যবস্থাপক (সাধারণ) পদে নিয়োগ পেতে বাবার মতোই বয়স জালিয়াতির আশ্রয় নিয়েছেন। মহিউদ্দিন চৌধুরী ২০১১ সালের ৩ জানুয়ারি আবেদন করেন। ২০১১ সালে ৩১ মে দাখিল করা প্রভিশনাল সনদটি সত্যায়িত করা হয়েছে ১০ মাস ২৩ দিন পরের তারিখে(২৪/৪/২০১২)। আবেদন পত্রে পাসের বছর লেখা ২০১০ সাল, আর সনদে লেখা ৩১ মে ২০১১। অর্থাৎ ইনার্টশীপের আগেই যোগসাজশে নিয়োগ পেয়েছেন। ওই নিয়োগ পরীক্ষা নেওয়া হয় বিআইএম’র অধীনে। সেই পরীক্ষার ২৫২ জনের মেধা তালিকায় মহিউদ্দিন চৌধুরীর নাম পায়নি দুদক। তৎকালীন পরিচালক এএইচ মোস্তফা কামাল কর্তৃক প্রেরিত ২৫২ জনের মেধাক্রমের নথিতে সহকারি ব্যবস্থাপক (সাধারণ) পদে নিয়োগ প্রাপ্ত ৩৮ জনের মধ্যে ৭ জন ছাড়া অবশিষ্ট ৩১ জনের কারোরই নাম মেধা তালিকায় নেই বলে দুদকের তদন্তে উঠে এসেছে।
আবার দুই ছেলের পদোন্নতি নিশ্চিত করার জন্য একজনকে টার্মিনেট করা এবং নিয়োগ প্রক্রিয়া ঝুলে রাখা, জনবল কাঠামো লঙ্ঘন করা প্রমান পেয়েছে দুদক। তার সময় অবৈধ গ্যাস সংযোগসহ নানা রকম অনিয়মের ঘটনা ঘটে। এসব অবৈধ সংযোগ থেকে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার সঙ্গে আইয়ুব খান চৌধুরীর বিরুদ্ধে যোগসাজস উঠে এসেছে।
বহুল সমালোচিত কেজিডিসিএল’র এমডি পদের পর তাকে পেট্রোবাংলার পরিচালক (প্লানিং) পদে পোস্টিং দেওয়া হয়। এখানে বসে বিদেশী কোম্পানির স্বার্থ সুরক্ষা করছেন বলেন অভিযোগ রয়েছে। কারণ যে কাজ দেশীয় কোম্পানি ৫০ কোটি টাকা খরচে করতে পারে, সেই কাজ বিদেশি কোম্পানি দিয়ে করানো হচ্ছে ২০০ কোটি টাকা দিয়ে। এতে অপব্যায়ে ঋণের ভারে ন্যুজ হচ্ছে রাষ্ট্রীয় কোম্পানি বাপেক্স।
দুদকের অনুসন্ধ্যানে দুই ছেলেসহ আইয়ুব খান চৌধুরীর নিয়োগে অনিয়মের বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে বার্তা২৪.কমকে বলেন “আপনি অনেক জ্ঞানী মানুষ আপনারা অনুসন্ধ্যান করে দেখেন, এ বিষয়ে আমার কোনো বক্তব্য নেই”। অন্যান্য দুর্নীতির বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তাতেও কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
জ্বালানি বিভাগের সিনিয়র সচিব আনিসুর রহমান বার্তা২৪.কমকে বলেন, আইয়ুব খান চৌধুরী দুর্নীতির বিষয়ে দুদক থেকে একটি চিঠি এসেছিল। আমরা সেটি তদন্ত করে রিপোর্ট দেওয়ার জন্য বলেছি। একটি রিপোর্ট এসেছিল সেটি অসম্পূর্ণ কারণে ফেরৎ দিয়েছি। এরপর আর আসেনি।
মেয়াদ শেষে চুক্তি ভিত্তিক নিয়োগের তোড়জোড় চলার গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়েছে। এমন প্রশ্নের জবাবে সিনিয়র সচিব বলেন, ওনি (আইয়ুব খান চৌধুরী) সম্ভবত জুলাইয়ের দিকে অবসরে যাবেন। সেটি তখনকরা বিষয়। এখন এ বিষয়ে ভাবা হচ্ছে না।
কোনো অসৎ অফিসার ভালো পোস্টিং, পদোন্নতি কিংবা চুক্তি ভিত্তিক নিয়োগ পেলে সৎ অফিসারদের মধ্যে কোনো প্রতিক্রিয়া হয় কিনা, এমন প্রশ্নের জবাবে সিনিয়র সচিব বলেন, সৎ অফিসাররাতো ডিমোরাইজড হয়েই। এতে ভিন্ন রকম বার্তা পৌঁছায়, শঙ্কার কোনো কারণ নেই নিশ্চয় যেটি যুক্তিসঙ্গত সেটাই হবে।