যার বিরুদ্ধে রয়েছে ঘুষ-দুর্নীতির বিস্তর অভিযোগ, মানি লন্ডারিংসহ নানাবিধ অভিযোগে খোদ দুদক যার তদন্তে নেমেছে। পেট্রোবাংলার সেই পরিচালক (অপারেশন অ্যান্ড মাইন্স) আলী মো. আল মামুনকে প্রাইজ পোস্টিং (চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ) দিতে উঠে পড়ে লেগেছে একটি মহল।
দুর্নীতিবাজ ওই কর্মকর্তা চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পেতে যাচ্ছে এমন খবরে অসন্তোষ দেখা দিয়েছে পেট্রোবাংলার কর্মকর্তাদের মধ্যে। তারপরও পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান একক সিদ্ধান্তে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দিতে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগে প্রস্তাব পাঠিয়েছেন বলে সূত্র নিশ্চিত করেছে। পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যানের এমন রহস্যজনক আচরণে অনেকে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। তারা বলেছেন, এমন দুর্নীতিবাজরা যদি প্রাইস পোস্টিং পান তাহলে সৎ কর্মকর্তারা কাজের আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। একইসঙ্গে সৎ অফিসাররা সৎপথে থাকার উৎসাহ হারিয়ে ফেলতে পারেন। এতে খারাপ নজির তৈরি হয়।
স্বৈরশাসক এরশাদ সরকারের সময়ে বাখরাবাদ গ্যাস সিস্টেম লিমিটেডে যোগদান করেন আল মামুন। চাকরি জীবনের যখন যে সরকার ক্ষমতায় থেকেছে রঙ বদলে সব সরকারের বিশেষ অনুকূল্য পেয়ে এসেছেন। গ্যাস ট্রান্সমিশন কোম্পানির (জিটিসিএল, বড়পুকুরিয়া কোল মাইনিং কোম্পানি, কর্নফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি ও তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি) শীর্ষপদে থেকেছেন লম্বা সময় ধরে। এখন ছড়ি ঘোরাচ্ছেন পেট্রোবাংলায় সবচেয়ে গুরুত্বপুর্ণ পদে বসে। যদিও তার সমন্বয়হীনতার কারণে গ্যাস সেক্টরে নানামুখী সংকট চলমান। চড়াদরে স্পর্টমার্কেট থেকে এলএনজি আমদানি করতে বাধ্য হচ্ছে সরকার। যার ফলে দফায় দফায় গ্যাসের দাম বাড়ানোর পরও স্বস্তিতে থাকতে পারছে না জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ।
রশিদপুর গ্যাস ফিল্ডের ৯ নম্বর কূপটি গ্যাস রিজার্ভ নিয়ে বসে আছে ২০১৭ সাল থেকে। কূপটি থেকে আড়াই কিলোমিটার দূরে ৭ নম্বর কূপের পাইপের সঙ্গে হুকিং করলেই গ্যাস সরবরাহ করা সম্ভব। অভিযোগ রয়েছে কৃত্রিম সংকট তৈরির জন্য নতুন পাইপলাইনের প্রকল্প হাতে নিয়ে কাজ বিলম্বিত করা হচ্ছে। এখাতের সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, এলএনজি সরবরাহকারীদের সঙ্গে গোপন আতাত থাকতে পারে। যাতে তারা চড়াদামে সরবরাহ দিলে বসে বসে কমিশন পেতে পারে। রশিদপুর ৯ নম্বর কূপ থেকে প্রায় দৈনিক প্রায় ১৯ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উত্তোলন করা সম্ভব। স্পর্ট মার্কেট থেকে আনা এলএনজির মূল্যের সঙ্গে তুলনা করলে বছরে বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হতো ১ হাজার ৮৭২ কোটি টাকার উপরে। এতো সংকট চলছে তারপরও কূপটিকে বসিয়ে রাখার দায় আলী মো. আল মামুন এড়াতে পারেন না বলে মন্তব্য করেছেন জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা।
আলী মো. আল মামুন যখন তিতাস গ্যাসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ছিলেন তার অনেক আগে থেকেই আবাসিকে গ্যাস সংযোগ বন্ধ ছিল। অথচ তার সময়ে বাড্ডা জোনাল অফিস এলাকায় ভুয়া কাগজ তৈরির মাধ্যমে বেশকিছু সংযোগ দেওয়ার ঘটনা ধরা পড়ে। সংযোগ দিতে ভুয়া ডিমান্ড নোট, কমিশনিং কার্ড ও ভুয়া বই ইস্যুর মাধ্যমে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয়। সম্পূর্ণ বেআইনিভাবে মোছা. রাবেয়া খাতুন (ডিআইটি প্রজেক্ট) গ্রাহক সংকেত (১৪২৪৩৬০/০১), ডিমান্ড ছাড়া সব কাগজপত্র জাল করে ফিরোজ মিয়াকে সংযোগ দেওয়া হয়। তিতাসের তদন্তে বেরিয়ে এসেছে জামাল উদ্দিন নামের একজনকে কমিশনিং কার্ড জালিয়াতির মাধ্যমে সংযোগ দেওয়া হয়।
গ্যাস ট্রান্সমিশন কোম্পানির (জিটিসিএল) ব্যবস্থাপনা পরিচালক থাকার সময় তার বিরুদ্ধে টেন্ডারবাজির বিস্তর অভিযোগ রয়েছে। তার ইশারায় উচ্চমূল্যে কাজ পেতো ত্রয়ী এন্টারপ্রাইজ। কথিত রয়েছে ত্রয়ী এন্টারপ্রাইজের গোপন মালিকানায় রযেছেন আলী মো. আল মামুন। কাগজে কলমে অন্যজন থাকলেও প্রকৃত মালিক তিনি। সিরাজগঞ্জে তার নিজের এলাকায় জনৈক ব্যক্তিকে দিয়ে পরিচালনা করে আসছে। বিয়ানীবাজার-কৈলাশটিলা গ্যাস সঞ্চালন পাইপলাইন প্রকল্প, ঢাকা ক্লিন ফুয়েল পাইপলাইন প্রকল্প, হাটিকুমরুল-ইশ্বরদী-ভেড়ামারা গ্যাস সঞ্চালন পাইপলাইন প্রকল্প, ভেড়ামারা-খুলনা গ্যাস সঞ্চালন পাইপলাইন প্রকল্পে ত্রয়ী এন্টারপ্রাইজের ছিল জয়জয়কার। এছাড়া আলী মো. আল মামুনের চাচা আব্দুর রহমান ও শ্যালকের দাপটের কথা ছিল সবার মুখে মূখে। জিটিসিএল থেকে সরে গেলেও পেট্রোবাংলায় বসেও এখন তিনি কলকাঠি নেড়ে যাচ্ছেন।
টার্ন-কি পদ্ধতিতে আশুগঞ্জ কমপ্রেসর স্টেশন নির্মাণ করেন কোরিয়ান এইচইসি। চুক্তির আওতায় নির্মাণ পরবর্তী দুই বছর স্টেশনটি পরিচালনা, রক্ষণাবেক্ষণ ও স্পেয়ার পার্টস সরবরাহের দায়িত্ব ছিল কোরিয়ান কোম্পানির। কিন্তু রহস্যজনক কারণে চীনা প্রতিষ্ঠান সেপকো ইলেকট্রিক পাওয়ার কনস্ট্রাকশন করপোরেশনের ১ বছর মেয়াদি চুক্তি করা হয়। এতে জিটিসিএল’র লোকসান হয় প্রায় ৩৬ কোটি টাকা। এছাড়া কোরিয়ান কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি আওতায় দেশীয় প্রকৌশলীদের দক্ষ ও প্রশিক্ষিত করে তোলার জন্য তাদের সঙ্গে থেকে কাজ করার সুযোগ ছিল। তা না করে ৫ বছর মেয়াদি পৃথক রক্ষণাবেক্ষণ চুক্তি করা হয়।
জিটিসিএল এমডি থাকার সময় রাষ্ট্রের অপচয়ে ছিলেন সিদ্ধহস্ত। নিয়ম রযেছে নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ করতে না পারলে এলডি (লিকুডিটেড ড্যামেজ) কর্তৃন করা হবে। ধনুয়া-এলেঙ্গা এবং বঙ্গবন্ধু সেতুর পশ্চিমপাড় পর্যন্ত সঞ্চালন লাইনের ঠিকাদারে নির্ধারিত সময়ে কাজ করতে না পারলে ৫ কোটি ৭৪ লাখ ৭৮ হাজার টাকা এলডি হয়। কিন্তু রহস্যজনক কারণে তা মওকুফ করা হয়। এখানে ব্যক্তি আল মামুন সুবিধা নিয়েছেন বলে কথিত রয়েছে। আনোয়ার-ফৌজদার হাট প্রকল্পের এলডি, কর্নফুলীর উত্তরপাড় হতে দক্ষিণ হালিশহর প্রকল্পের এলডি, সিইপিজেড-আর্টিলারী স্কুল পাইপলাইন প্রকল্পের এলডি, উত্তর হালিশহর-ফৌজদারহাট সাঙ্গু প্লান্ট পাইপলাইন প্রকল্পসহ অনেকগুলো প্রকল্প যথা সময়ে কাজ শেষ করতে ব্যর্থ হয়। এতে করে নানাভাবে ক্ষতির স্বীকার হয় বাংলাদেশ। প্রকল্পের সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারের এলডি কর্তন করার কথা থাকলেও তার রহস্যজনক ভূমিকার কারণে ঢালাওভাবে কোটি কোটি টাকা এলডি মুওকুফ করা হয়।
বড়পুকুরিয়া কোল মাইনিং কোম্পানি লিমিটেডের (বিসিএমসিএল) সঙ্গে উৎপাদন ব্যবস্থাপনা, রক্ষণাবেক্ষণ এবং প্রোভিশনিং সার্ভিসেস চুক্তি হয় সিএমসি কনসোটিয়ামের। চুক্তি শেষ হওয়ায় সিএসমি তাদের রিটেনশন মানি ও অন্যান্য বিল বাবদ ১৮০ কোটি টাকা দাবি করে। বিলটি যাচাই-বাছাই করার জন্য জিএসবির সাবেক মহাপরিচালক নেহাল উদ্দিনের নেতৃত্ব একটি কমিটি গঠন করা হয়। নেহাল উদ্দিন কমিটি বিল প্রদানের বিপক্ষে মতামত দেয়। তারপরও বিসিএমসিএল’র বোর্ডের সিদ্ধান্তকে পাশ কাটিয়ে ১৮০ কোটি টাকা প্রদানে মূখ্য ভূমিকা পালন করেন পরিচালক আল মামুন। তদন্ত রিপোর্টে দেখা গেছে সিএমসির যে মেশিন ব্যবহার করেছে, সেই মেশিনের যে উত্তোলন ক্ষমতা তার চেয়ে অনেক বেশি কয়লা উত্তোলন দেখিয়েছে কারচুপির মাধ্যমে।
আলী মো. আল মামুনের বিষয়ে ঘুষ লেনদেনের বিষয়ে ২০২০ সালের ৫ সেপ্টেম্বর তদন্ত কর্মকর্তা নিয়োগে করে দুদক। তদন্তের দায়িত্ব পান উপ-পরিচালক (বিশেষ অনুসন্ধান ও তদন্ত-১) মো. সালাউদ্দিন।
এ বিষয়ে কথা বলার জন্য জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের সিনিয়র সচিব মাহবুব হোসেনকে ফোন দিলে রিসিভ করেননি। এসএমএস দিলেও সাড়া দেননি তিনি। (চলবে)