বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষেত্রে ডিজেল সবচেয়ে ব্যয়বহুল জ্বালানি হিসেবে পরিচিত। প্রতি ইউনিটে জ্বালানি খরচ পড়ছে ২০ টাকার উপরে। অন্যান্য খরচ মিলিয়ে ৪০ টাকায় দাঁড়াচ্ছে বলে জানিয়েছেন বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ।
যে কারণে ডিজেল ভিত্তিক ১০ বিদ্যুৎ কেন্দ্র ১৯ জুলাই থেকে বন্ধ রাখার সিন্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এতে করে বিদ্যুতের মোট উৎপাদন থেকে ৬.০১ শতাংশ কমে যাচ্ছে। ঘাটতি সামাল দিকে আপাতত দৈনিক ১ ঘণ্টা করে লোডশেডিং করা হবে। সামাল দেওয়া না গেলে দুই ঘণ্টায় গড়াবে লোডশেডিং। তবে ফার্নেস অয়েল ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালু থাকছে
ডিজেল ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র বন্ধে কত টাকা সাশ্রয় হবে
বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) সুত্র জানিয়েছে, যদি ৫০ শতাংশ প্লান্ট ফ্যাক্টরে চালানো হয়, তাহলে দৈনিক প্রায় ২৩ কোটি টাকার মতো জ্বালানি খরচ হয়। বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো বন্ধ রাখলে এই টাকা সাশ্রয় হবে। তবে বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো খুব কম সময়েই ৫০ শতাংশ হারে চালানোর নজীর রয়েছে। পিডিবির তথ্য মতে গড়ে ১৫ থেকে ২০ শতাংশ হারে চালানোর রেকর্ড রয়েছে। এ হিসেবে দৈনিক সাশ্রয় হবে ৯ কোটি ২০ লাখ টাকা।
যদিও কয়েকদিন আগে থেকেই ডিজেল দিয়ে বিদ্যুতের উৎপাদন কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ (পিজিসিবি) এর পরিসংখ্যান অনুযায়ী ১০টি ডিজেল ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের উৎপাদন সক্ষমতা রয়েছে ১ হাজার ৬১ মেগাওয়াট। গত ১৭ জুলাই ডে-পিকে মাত্র ১২২ মেগাওয়াট ও সান্ধ্যাকালীন পিকে ৪৯২ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়েছে।
মেরিট অর্ডার (সাশ্রয়ী) অনুযায়ী সবশেষে ডিজেল ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো চালানোর হয়। অর্থাৎ প্রথম সাশ্রয়ী বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো চালানো হয়, সেখান থেকে যদি চাহিদা মেটানো না যায়, তখন ধাপে ধাপে ব্যায়বহুল বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো চালু করা হয়।
পিডিবির খরচ সাশ্রয়ের পাশাপাশি আরেকটি অংক রয়েছে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি)। পিডিবি যে হিসেব দিচ্ছে সেখানে ডিজেলের আমদানি পর্যায়ে ভর্তুকি বিবেচনায় নেওয়া হয় নি। বিপিসির গত জুন মাসের হিসেব অনুযায়ী প্রতি লিটার ডিজেলের আমদানি খরচ পড়ছে ৮৮.৩৯ টাকা। ডিউটি ও অন্যান্য চার্জ যোগ করলে লিটার প্রতি দাম দাঁড়াচ্ছে ১২৩.৪৫ টাকা। সেখানে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য পিডিবিকে দেওয়া হচ্ছে ৭৭.৫০ টাকা লিটারে।
ডিজেল ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো বন্ধ করে দেওয়া হলে বিপিসিরও লোকসান কমে যাবে। দেশে ব্যবহৃত ডিজেলের মধ্যে বিদ্যুৎ উৎপাদনে ১০ শতাংশ ব্যবহৃত হচ্ছে। সবেচেয়ে বেশি ব্যবহৃত যানবাহনে। ভর্তুকির পরিমাণ নিয়ন্ত্রণে রাখতে যানবাহনেও ব্যবহার কমানোর জোর দেওয়া হচ্ছে। সপ্তাহে একদিন পেট্রোলপাম্প বন্ধ রাখা, সরকারি কর্মকর্তাদের একক গাড়ি ব্যবহার কমিয়ে শেয়ারিং করার ভাবনার কথা জানিয়েছে সরকার।
বিকেলে সাংবাদিক সম্মেলনে বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদের কাছে প্রশ্ন ছিল ডিজেল ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র বন্ধ থাকলে কতটাকা সাশ্রয় হবে। জবাবে তিনি বলেন, আমরা বিপিসিকে হিসেব করতে বলেছি। ভালো পরিমাণ টাকাই সাশ্রয় হবে বলে আশা করছি।
পিডিবির তথ্য মতে ১৭ জুলাই দেশে কোন লোডশেডিং ছিল না। এদিন রাত ৯ টায় বিদ্যুতের সর্বোচ্চ চাহিদা উঠেছিল ১৩ হাজার ৭৬৫ মেগাওয়ার্ট। গ্যাস ঘাটতিসহ অন্যান্য সংকটের মধ্যেও সমপরিমাণ বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয়েছে। রাত ৯ টায় যখন সর্বোচ্চ চাহিদা ছিল তখন ডিজেল থেকে ৪৯২ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়। ১৯ জুলাই থেকে লোডশেডিং করার কথা জানিয়েছে বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী। ১৭ জুলাই সারাদিন গ্যাস দিয়ে ১৫৮ দশমিক ২৬৭ মিলিয়ন ইউনিট, কয়লা দিয়ে ২৮ দশমিক ২৩৩ মিলিয়ন ইউনিট, তেল দিয়ে ৮৬ দশমিক ৩০৩ মিলিয়ন ইউনিট, হাইড্রো থেকে ৩ দশমিক ০২৪ মিলিয়ন ইউনিট ও সৌর থেকে ১ দশমিক ৪১০ মিলিয়ন ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়েছে।
ডিজেলের দাম নিয়ে যখন সংকটের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। তার আগে থেকেই গ্যাসের চলমান রয়েছে। দেশীয় গ্যাস ফিল্ডগুলোর উৎপাদন দিন দিন কমে যাচ্ছে। এক সময় ২৭’শ এমএমসিএফডি গ্যাস উৎপাদিত হতো, এখন ২৩’শ এর নিচে নেমে এসেছে। ঘাটতি সামাল দিতে ৮’শ এমএমসিএফডি গ্যাস আমদানি করা হয় এলএনজি আকারে। ৮’শ এমএমসিএফডির মধ্যে ৫’শ দীর্ঘমেয়াদী চুক্তির আওতায়, আর ৩’শ স্পটমার্কেট (বর্তমান দর) থেকে। ইউক্রেন যুদ্ধের পর স্পর্ট মার্কেটে অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি হয়েছে। ১২ টাকার এলএনজি আনতে ৩৯ টাকা খরচ হচ্ছে। এরসঙ্গে ডিউটি যোগ করলে ইউনিট প্রতি ৫১ টাকার মতো খরচ পড়ছে। যে কারণে স্পর্ট মার্কেট থেকে এলএনজি আমদানি বন্ধ করা হয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই গ্যাসের সরবরাহ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় গ্যাস ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র বসিয়ে রাখতে হচ্ছে।
পিডিবির তথ্য অনুযায়ী বর্তমানে গ্যাস দিয়ে বিদ্যুতের উৎপাদন ক্ষমতা রয়েছে ৫০.৮৪ শতাংশ, এরপরেই রয়েছে ফার্নেস অয়েলে ২৭.৬৯ শতাংশ, কয়লায় ৭.৮৯ শতাংশ, চতুর্থ স্থানে থাকা ডিজেলের অনুপাত হচ্ছে ৬.০১ শতাংশ। আমদানি করা হচ্ছে ৫.৪২ শতাংশ, সোলার ও হাইড্রো থেকে আসছে ১.০৭ শতাংশ হারে।