ভর্তুকি ছাড়া ইউনিট প্রতি বিদ্যুতের উৎপাদন খরচ দাঁড়াবে প্রায় ৮ টাকার ওপরে। এই টাকার সঙ্গে ভর্তুকির অর্থ সমন্বয় করে দর ঘোষণার প্রস্তুতি নিচ্ছে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)।
বিইআরসি সূত্র জানিয়েছে, ইতিমধ্যে ভর্তুকির পরিমাণ জানতে একাধিক চিঠি দেওয়া হয়েছে বিদ্যুৎ বিভাগে। সেই চিঠির আনুষ্ঠানিক কোন জবাবে মেলেনি, তবে বিইআরসির এক কর্মকর্তার সঙ্গে সচিবের দ্বি-পাক্ষিক আলোচনায় ভর্তুকি ১৭ হাজার কোটি টাকার কথা জানা গেছে। গত অর্থবছরে বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকির পরিমাণ ছিল ১২ হাজার ৮০০ কোটি টাকা।
বিইআরসি জানিয়েছে, প্রতি ১ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকিতে ইউনিট প্রতি খরচ কমবে ১২ পয়সার মতো। সে হিসেবে বর্তমান পাইকারি দর (ইউনিট প্রতি) ৫.১৭ টাকা থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ৬ টাকার মতো হতে পারে। বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিপিডিবি) বর্তমান দর ইউনিট প্রতি ৫.১৭ টাকা থেকে ৬৬ শতাংশ বাড়িয়ে ৮.৫৮ টাকা করার আবেদন করে। বিইআরসি টেকনিক্যাল কমিটি ভর্তুকি ছাড়া ৮.১৬ টাকা করার মতামত দেয়। সর্বশেষ ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বিদ্যুতের পাইকারি দর ইউনিট প্রতি ৫.১৭ টাকা নির্ধারণ করা হয়।
তবে বিইআরসির ওই হিসেবের সঙ্গে একমত হতে পারছে না ভোক্তাদের সংগঠন কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)। ক্যাবের সিনিয়র সহ-সভাপতি জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক শামসুল আলম বার্তা২৪.কম-কে বলেছেন, বিইআরসির হিসেবে গোঁজামিল রয়েছে, কোনভাবেই উৎপাদন খরচ ৮ টাকা হওয়ার সুযোগ নেই। আমরা গণশুনানিতে অংশ নিয়ে প্রমাণ করে দিয়েছি তাদের হিসাবে ভুল রয়েছে।
বিদ্যুৎ উৎপাদনের যে প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে, তাও সঠিক হয়নি। ইতিমধ্যে বিদ্যুতের উৎপাদন ১৮ শতাংশ কমানো হয়েছে। বিপিডিবি চলতি অর্থবছরে ৮.৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধির আবেদন করেছে। আর বিইআরসি বিবেচনায় নিয়েছে ৬.৫ শতাংশ। প্রত্যেকবার দাম বৃদ্ধির সময় তারা উচ্চ প্রবৃদ্ধির অংক কষে দাম বাড়িয়ে নেয়, বাস্তবে তার প্রতিফলন ঘটে না।
তিনি বলেন, বিপিডিবির যে প্রস্তাবের মূল্যায়ন করে দাম বৃদ্ধির প্রস্তাব বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে। সেই প্রেক্ষাপট সম্পূর্ণ বদলে গেছে, সুতরাং সেই প্রস্তাবের আর কোন ভিত্তি নেই। আর ভিত্তিহীন প্রস্তাবের ওপর ভিত্তি করে দাম বৃদ্ধির কোন যৌক্তিকতা নেই। উচ্চমূল্যের ডিজেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বসিয়ে রাখা হয়েছে। স্পর্ট মার্কেট থেকে তারপরও কেনো উৎপাদন খরচ বাড়বে।
ড. শামসুল আলম বলেন, সরকার স্পর্ট মার্কেট থেকে এলএনজি আমদানির কথা বলে দাম বাড়িয়ে নিয়ে গেছে। ভর্তুকির কথা বলা হলেও সেই পরিমাণ গ্যাস আমদানি করেনি। অর্থাৎ প্রকৃত অর্থে ভর্তুকি দেয়নি। তেমনি বিদ্যুতে ভর্তুকির কথা বলা হলেও, কম উৎপাদন করে ভর্তুকির টাকা ফিরিয়ে নিয়ে যাবে।
শুধু প্রবৃদ্ধির হিসেবে নয় বিইআরসির গোঁজামিল দেখা গেছে খরচ সাশ্রয়ী কম্বাইন্ড সাইকেল বিদ্যুৎ কেন্দ্র পরিচালনার ক্ষেত্রেও। বিপিডিবি যে প্রাক্কলন দেখিয়েছে তাতে কম্বাইন্ড সাইকেল বিদ্যুৎ কেন্দ্র ৩৮ শতাংশ প্লান্ট ফ্যাক্টরে চালানোর কথা বলা হয়েছে। বিইআরসি টেকনিক্যাল কমিটি প্রশ্ন তোলার কথা থাকলেও তারা প্রায় হুবহু ক্যালকুলেট করে হিসাব দাঁড় করিয়েছে। অথচ সহজেই ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ প্লান্ট ফ্যাক্টরে বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো চালানোর সুযোগ রয়েছে। আর এমনটি করা গেলে বিদ্যুতের উৎপাদন খরচ কমে আসে অনেক।
গত ৯ মে তারিখের এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে ২৫টি কম্বাইন্ড সাইকেল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মধ্যে মাত্র ৮টি পুরোপুরি চালানো হয়েছে। আর ১০টিতে আংশিক বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়েছে গ্যাস ঘাটতির কারণে। ২৫টি কম্বাইন্ড সাইকেল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মোট উৎপাদন ক্ষমতা হচ্ছে ৭ হাজার ২৪৯ মেগাওয়াট। ওই দিন ৫৭৮ এমএমসিএফডি গ্যাস সরবরাহ করে মাত্র ৪ হাজার ৪৭ মেগাওয়ার্ট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়।
সবগুলো বিদ্যুৎকেন্দ্র ২৪ ঘণ্টা সচল রাখতে মোট গ্যাসের প্রয়োজন পড়ে ১ হাজার ৩৫ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস। ২০২১ সালে জুন মাসে গড়ে ১ হাজার ১৫০ এমএমসিএফডি গ্যাস সরবারের তথ্য পাওয়া গেছে। সিম্পল সাইকেল বিদ্যুৎ কেন্দ্রে যে গ্যাস দিয়ে ১০০ মেগাওয়ার্ট বিদ্যুৎ পাওয়া যায়, একই পরিমাণ গ্যাস দিয়ে কম্বাইন্ড সাইকেল বিদ্যুৎ কেন্দ্রে ১৫০ মেগাওয়ার্ট বিদ্যুৎ পাওয়া সম্ভব।
কম্বাইন্ড সাইকেল বিদ্যুৎ কেন্দ্র পরিচালনার প্রসঙ্গ এলেই বিপিডিবি দোষারোপ করে কখনও পেট্রোবাংলাকে, কখনও পিজিসিবিকে। আর পেট্রোবাংলা দোষারোপ করে বিপিডিবিকে। তবে বিইআরসির চেয়ারম্যান একটি ভালো উদ্যোগ নিয়েছে। তারা ১৭ আগস্ট পেট্রোবাংলা-বিডিপিবিকে নিয়ে ত্রি-পক্ষীয় বৈঠক করেছে। সেখানে বসে চূড়ান্ত করা হয়েছে কম্বাইন্ড সাইকেল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের হিস্যা। পেট্রোবাংলা কম্বাইন্ড সাইকেল বিদ্যুৎ কেন্দ্রে দৈনিক ৯০০ এমএমসিএফ এর বেশি গ্যাস দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। কোন কেন্দ্রে দেওয়া হবে সেটিও চূড়ান্ত হয়েছে। ১০০ এমএমসিএফ গ্যাস দিয়ে ৬০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব। প্রায় সাড়ে ৫ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কম্বাইন্ড সাইকেল থেকে পাওয়া যাবে। এই বিষয়টি যথাযথভাবে অনুসরণ করা গেলে বিদ্যুতের উৎপাদন খরচ কমে আসবে।
বিইআরসি চেয়ারম্যান আব্দুল জলিল বার্তা২৪.কম-কে বলেছেন, কমিশন পেট্রোবাংলা ও বিপিডিবির সঙ্গে বসেছিল, আলোচনা ফলপ্রসূ হয়েছে। দাম নির্ধারণের ক্ষেত্রে বিষয়টি বিবেচনায় নেওয়া হবে।
বিইআরসি কবে আদেশ দিতে পারে এমন প্রশ্নের জবাবে বিইআরসি চেয়ারম্যান বলেন, তারিখ বলা সম্ভব না, সরকারের কিছু নীতি সিদ্ধান্তের ইস্যু রয়েছে। আমরা কাজ গুছিয়ে নিয়ে এসেছি।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, গ্যাসের পর জ্বালানি তেলের দাম আকাশচুম্বি বৃদ্ধির ফলে জনগণের নাভিশ্বাস উঠেছে। এখন বিদ্যুতের দাম বাড়ানো কোনভাবেই উচিত হবে না। ডিজেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ, কিছুদিনের মধ্যে কয়লাভিত্তিক রামপাল ও পায়রা দ্বিতীয় ইউনিট উৎপাদনে আসবে। এসব বিষয় বিবেচনায় নিলে দাম বাড়ানোর প্রয়োজন পড়ে না।
বিদ্যুতের একক পাইকারি বিক্রেতা বিপিডিবি। নিজস্ব উৎপাদনের পাশাপাশি বিদেশ থেকে আমদানি ও বেসরকারি মালিকানাধীন কেন্দ্রের কাছ থেকে কিনে ৫টি বিতরণ কোম্পানির কাছে পাইকারি দরে বিক্রি করে আসছে। বিপিডিবির পাইকারি দাম বৃদ্ধির প্রস্তাবে বলা হয়েছে, চাহিদা মতো গ্যাস সরবরাহ না পাওয়ায় তেল বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে গিয়ে খরচ বেড়ে গেছে। ২০১৯-২০ অর্থ বছরে বিদ্যুতে গড় উৎপাদন খরচ ছিল ২.১৩ টাকা, ২০২০-২১ অর্থ বছরে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩.১৬ টাকায়। জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি, কয়লার মুসক বৃদ্ধির কারণে ২০২২ সালে ইউনিট প্রতি উৎপাদন খরচ দাঁড়াবে ৪.২৪ টাকায়। এরসঙ্গে রয়েছে অন্যান্য খরচ। পাইকারি দাম না বাড়লে ২০২২ সালে ৩০ হাজার ২৫১ কোটি ৮০ লাখ টাকা লোকসান হবে বিপিডিবির।