বহুমুখী লোকসান ঠেকাতে বিদ্যুৎ বিভাগ যখন ক্যাপটিভ বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে বের হওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। ঠিক সে সময়েও নতুন নতুন ক্যাপটিভ বিদ্যুৎ কেন্দ্রে গ্যাস সংযোগ অব্যাহত রেখেছে সবচেয়ে বড় প্রতিষ্ঠান তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন এন্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি।
আর এসব ক্যাপটিভ সংযোগের পেছনে কোটি কোটি টাকার বাণিজ্যের ব্যাপক জনশ্রুতি রয়েছে। টাকা ছাড়া তিতাসে গ্যাসের সংযোগ মেলেনা এ কথা অনেকটাই ওপেন সিক্রেট। বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের গণশুনানিতে একাধিক শিল্পপতি প্রকাশ্যেই অভিযোগ করেছেন ঘুষ গ্রহণের বিষয়ে। অতীতে এসব বাণিজ্য রাখঢাক থাকলেও চুক্তিতে নিয়োগ পাওয়া তিতাস গ্যাসের বর্তমান ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী হারুনুর রশীদ মোল্লাহ এর সময়ে মুখোশ খসে পড়েছে। তিতাস গ্যাসের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের আস্থাভাজন কয়েকজন ঠিকাদারদের একটি সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করছে। যারা সংযোগের অপেক্ষায় থাকা কোম্পানির দূয়ারে গিয়ে সংযোগ করে দেওয়া গোপন চুক্তি সমাধা করেন। তাদের হাতে কমিশন গুজে দিলেই মিলছে গ্যাসের সংযোগ, আর না দিলে সেই ফাইল আর আলোর মুখ দেখতে পাচ্ছে না।
এমনও দেখা গেছে ২০১৭ সালে আবেদন করে বসে রয়েছে কোন কোন কোম্পানি। তাদের সংযোগ দেওয়া হয় নি, আবার সিন্ডিকেটের হাতে কমিশন গুঁজে দিয়ে এক বছরেই সংযোগ পেয়ে গেছেন। গত ২১ জুলাই তারিখে একটি বোর্ডসভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় দু’টি কোম্পানির ক্যাপটিভ লোড বৃদ্ধি করা হয়। ভালুকার জামিরদিয়া এলাকায় অবস্থিত মেসার্স স্কয়ার এ্যাপারেলস লিমিটেড (গ্রাহক সংকেত নম্বর-৩৭৯/৮৭৯০১২৬) এর ক্যাপটিভ রানে ৪৭ হাজার ৮৮৯ ঘনফুট (ঘণ্টা প্রতি) লোড বৃদ্ধি করা হয়। একই বোর্ডে মেসার্স বি. জে. বেড উইভিং লিমিটেড (গ্রাহক সংকেত নম্বর ৩২২/৮৩২-০০০৯৮০) ক্যাপটিভের লোড বাড়ানো হয়। শুধু লোড বৃদ্ধি নয় গত ২৬ এপ্রিলে বোর্ডে সাভারে অবস্থিত বাংলাদেশ এক্সপোর্ট ইমপোর্ট কো. লিমিটেড ও মেসার্স সাচ্ছান কোম্পানির (বিডি) নতুন ক্যাপটিভ সংযোগ অনুমোদন দেওয়া হয়। এর আগে ৯ এপ্রিল ৮৮১ তম বোর্ডসভায় প্রায় ১৬টি ক্যাপটিভ সংযোগ পুনঃবিন্যাস করা হয়। শুধু এসব বোর্ডে নয়, প্রত্যেক মাসেই ক্যাপটিভে গ্যাস সংযোগ দিয়ে নতুন নজির গড়েছেন বর্তমান এমডি।
তিতাস তাদের বিদ্যমান গ্রাহকদের গ্যাস সরবরাহ দিতে হিমশিম খাচ্ছে। সিএনজি ফিলিং স্টেশন বন্ধসহ নানাভাবে রেশনিং করতে হচ্ছে। ঠিক সেই সময়ে নতুন নতুন ক্যাপটিভ সংযোগের নামে এই বাণিজ্য নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা।
ক্যাবের সিনিয়র ভাইস-প্রেসিডেন্ট জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ড. শামসুল আলম বলেন বার্তা২৪.কমকে বলেন, এখন আর অদক্ষ ক্যাপটিভ বিদ্যুৎ কেন্দ্রে গ্যাস সরবরাহ দেওয়া উচিত না। জাতীয় স্বার্থে এসব ক্যাপটিভে গ্যাস সংযোগ দেওয়া হচ্ছে। এখানে অসাধু ব্যক্তি স্বার্থ কাজ করছে। এতে করে কেউ কেউ বিশেষভাবে লাভবান হয়ে থাকার অভিযোগ অমূলক নয়।
তিতাস গ্যাসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী হারুনুর রশীদ মোল্লাহকে একাধিকবার ফোন দিলেও রিসিভ করেন নি।
বিদ্যুতের মহাসংকটের সময়ে আপোদকালীন ব্যবস্থা হিসেবে এক সময়ে দেওয়া হয় ক্যাপটিভ। সেটাই এখন বিদ্যুৎ বিভাগের গলার ফাঁস হয়ে দেখা দিয়েছে, আগের দেওয়া ক্যাপটিভ বন্ধ করতে গলদঘর্ম অবস্থা। নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুতের গ্যারান্টি দিয়েও ক্যাপটিভ বন্ধ করা যাচ্ছে।
বিদ্যুৎ বিভাগের উন্নয়ন ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান পাওয়ার সেল’র মহাপরিচালক মোহম্মদ হোসাইন বার্তা২৪.কমকে বলেছেন, ক্যাপটিভ বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো এখনই বন্ধ করা দরকার এগুলোতে গ্যাসের অপচয় হচ্ছে। ক্যাপটিভের গ্যাস বিদ্যুৎ কেন্দ্রে দিলে বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব।
তিনি বলেন, আমরা নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ দিতে প্রস্তুত আছি। আমরা এমনও বলেছি, চুক্তি থাকবে বিতরণ কোম্পানি যদি নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ দিতে ব্যর্থ হয় তাহলে তারা জরিমানে দেবে। তারপরও তারা আগ্রহ দেখাচ্ছে না। ক্যাপটিভের কারণে দ্বৈত বিনিয়োগ হচ্ছে। ক্যাপটিভ থেকে বের করে আনতে শিল্পে বিদ্যুতের দাম কমানোর চিন্তাভাবনাও চলছে।
একই পরিমাণ গ্যাস ক্যাপটিভে না দিয়ে বিদ্যুৎ কেন্দ্র সরবরাহ দিলে বেশি পরিমাণে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব। কম্বাইন্ড সাইকেল বিদ্যুৎ কেন্দ্রে ১ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস দিয়ে ৬ থেকে ৭ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব। একই গ্যাস দিয়ে ক্যাপটিভে সর্বোচ্চ ৪ মেগাওয়াটের মতো বিদ্যুৎ উৎপাদিত হচ্ছে। পুরাতন জেনারেটরে পরিমাণ আরও কম।
এক সময় ভয়াবহ বিদ্যুৎ সংকটের কারণে শিল্প কারখানায় নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ নিশ্চিত করতে ক্যাপটিভ (শিল্প কারখানায় স্থাপিত বিদ্যুত উৎপাদন জেনারেটর) বিদ্যুৎ কেন্দ্র অনুমোদন দেওয়া হয়। এখন সেই চিত্র অনেকটাই বদলে গেছে, সরকার চাহিদার চেয়ে অনেক বেশি উৎপাদনে সক্ষমতা অর্জণ করেছে। বর্তমানে কমবেশি ১৫ হাজার মেগাওয়াটের বিপরীতে উৎপাদন ক্ষমতা ২৫ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। তারপরও নতুন নতুন ক্যাপটিভ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) সূত্র জানিয়েছে প্রায় ২৮০০ মেগাওয়াটের মতো ক্যাপটিভ বিদ্যুৎ রয়েছে। পেট্রোবাংলার ওয়েবসাইটের তথ্যমতে গত ২৮ আগস্ট তিতাস গ্যাস ৭৮.৪ এমএমসিএফডি গ্যাস সরবরাহ দিয়েছে ক্যাপটিভে। চটগ্রাম অঞ্চলে গ্যাস বিতরণ কোম্পানি (কেজিডিসিএল) ক্যাপটিভে সরবরাহ দিয়েছে ৬.৮ এমএমসিএফডি। একই দিনে বিদ্যুৎ কেন্দ্রে ২২৫২ এমএমসিএফডি চাহিদার বিপরীতে মাত্র ১১০৭ এমএমসিএফডি গ্যাস সরবরাহ করা হয়েছে। সরবরাহ ঘাটতি থাকায় বেশিরভাগ বিদ্যুৎ কেন্দ্র বন্ধ থেকেছে। কোথাও কোথাও আংশিক উৎপাদন হয়েছে।
ক্যাপটিভের আরেকটি ফাঁদ রয়েছে, এগুলো স্বল্প চাপেই চলতে পারে। লাইনে গ্যাসের সরবরাহ কমে গেলে এগুলো অব্যাহত থাকে। আর প্রথম ধাপেই বন্ধ হয়ে যায় গ্যাস ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র বন্ধ। এখানে বলে কয়ে বন্ধ রাখা ছাড়া আর কোন কৌশল খাটানোর সুযোগ নেই। এতে করে বিদ্যুৎ কেন্দ্র বসিয়ে থেকে গ্যাস চলে যাচ্ছে ক্যাপটিভে। একদিকে যেমন মূল্যবান গ্যাসের অপচয় হচ্ছে অন্যদিকে বিদ্যুৎ কেন্দ্র বসিয়ে রেখেও ক্যাপাসিটি চার্জ গুণতে হচ্ছে।
২০১৫ সালে আগস্টে ক্যাপটিভ পাওয়ার প্লান্টে (শিল্প কারখানায় স্থাপিত বিদ্যুৎ উৎপাদন জেনারেটর) নতুন করে আর গ্যাস সংযোগ না দেওয়ার আদেশ দেওয়া হয়। জ্বালানি এবং খনিজসম্পদ বিভাগের সহকারী সচিব শিরীন সুলতানা স্বাক্ষরিত ১০ আগস্টের অফিস আদেশ বলা হয় ‘ক্যাপটিভ পাওয়ার প্লান্টের জন্য পুনরাদেশ না দেয়া পর্যন্ত গ্যাস সংযোগ প্রদান না করার বিষয়ে সরকার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। অর্থাৎ এখন থেকে নতুন আর কোন শিল্প উদ্যোক্তা ক্যাপটিভ পাওয়ার প্লান্টে গ্যাস সংযোগ পাবে না। তারপরও নানা সময়ে নানাভাবে সংযোগ দেওয়ার তথ্য প্রমাণ পাওয়া গেছে। কয়েক বছর ধরে গ্যাস সংযোগে কড়াকড়ির মধ্যে শিল্প ও ক্যাপটিভে গ্যাস সংযোগ নিয়ে সবেচেয়ে বেশি অভিযোগের তীর ড. তৌফিক ই ইলাহী চৌধুরীর বিরুদ্ধে।
বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের সদস্য আবু ফারুক বার্তা২৪.কমকে বলেছেন, অনেকেই ক্যাপটিভের জন্য আবেদন নিয়ে আসছে। বিতরণ কোম্পানির সঙ্গে গ্যাস সরবরাহের চুক্তি থাকলে আমরা লাইসেন্স দিচ্ছি। তবে ক্যাপটিভ থেকে বের হয়ে আসা উচিত।