কেনো কোটি কোটি টাকা ঘুষ দিয়ে হলেও ক্যাপটিভ বিদ্যুৎকেন্দ্রে গ্যাস সংযোগ পেতে তোড়জোড় চলছে। ৮ মেগাওয়াটের একটি ক্যাপটিভ বিদ্যুৎকেন্দ্রে দিনে (২৪ ঘণ্টা) ১ লাখ ৯২ হাজার ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদন করছে। ইউনিট প্রতি যদি ১ টাকা ব্যবধান হয় তাহলে খরচ কমে ১ লাখ ৯২ হাজার টাকা।
ব্যবসায়ীদের এই দুর্বলতার জায়গাকেই টার্গেড করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে তিতাস গ্যাসের সিন্ডিকেট। ক্যাপটিভে গ্যাস সংযোগ বন্ধ থাকলে বেশকিছু নতুন সংযোগ প্রদান ও পুরাতন সংযোগের লোড বৃদ্ধির প্রমাণে পাওয়া গেছে তিতাসের গ্যাসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হারুনুর রশীদ মোল্লাহ এর বিরুদ্ধে।
১ এমএমসিএফ (মিলিয়ন ঘনফুট) গ্যাস দিয়ে কমবেশি ৪ মেগাওয়াটের (৪ হাজার ইউনিট) মতো বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব। ৮ মেগাওয়াটের বিদ্যুৎকেন্দ্র চালাতে ঘণ্টায় গ্যাসের প্রয়োজন পড়ে ২ এমএমসিএফ। গ্যাসের বর্তমান দর অনুযায়ী ১ এমএমসিএফ গ্যাসের বর্তমান দর (১৬ টাকা ঘনমিটার) ৪ লাখ ৫৩ হাজার ৫৬ টাকা। এতে করে ক্যাপটিভে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের খরচ পড়ছে ৮.৮২ টাকা। শিল্পের জন্য একই পরিমাণ বিদ্যুৎ কিনতে হলে (পিক আওয়ারে) গুণতে হচ্ছে ১০.৬৯ টাকা।
অর্থাৎ ইউনিট প্রতি দরে প্রায় ১.৮৭ টাকার মতো হেরফের হচ্ছে। একটি ৮ মেগাওয়াট ক্যাপটিভ বিদ্যুৎকেন্দ্র ঘন্টায় ৮ হাজার ইউনিট বিদ্যুৎ জেনারেট করছে। ২৪ ঘণ্টা চালালে এর যোগফল দাঁড়াচ্ছে ১ লাখ ৯২ হাজার ইউনিট। ইউনিট প্রতি ১.৮৭ টাকা হারে সাশ্রয় হলে দিনে দাঁড়াচ্ছে ৩ লাখ ৫৯ হাজার টাকার মতো। এভাবে যদি মাস ও বছর হিসেব করা যায় তাহলে সহজেই অনুমান করা যায় ক্যাপটিভের অর্থনৈতিক গুরুত্ব। বছর বছর ধরে মুনাফা করতে দুই-এক মাসের মুনাফা ছেড়ে দিতে অনাগ্রহী হওয়ার কথা না।
ক্যাপটিভ পেতে নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুতের ধুয়া তোলা হলেও এটাই প্রকৃত রহস্য অংক। যদি তাই না হবে তাহলে সরকার নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ দিতে চাইলেও ব্যবসায়ীরা আগ্রহ দেখাচ্ছে না কেনো। বিদ্যুৎ বিভাগের উন্নয়ন ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক মোহম্মদ হোসাইন বার্তা২৪.কম-কে বলেছেন, আমরা নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ দিতে প্রস্তুত আছি। আমরা এমনও বলেছি, চুক্তি থাকবে বিতরণ কোম্পানি যদি নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ দিতে ব্যর্থ হয় তাহলে তারা জরিমানা দেবে। তারপরও তারা আগ্রহ দেখাচ্ছে না।
তিনি বলেন, ক্যাপটিভ বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো এখনই বন্ধ করা দরকার এগুলোতে গ্যাসের অপচয় হচ্ছে। ক্যাপটিভের গ্যাস বিদ্যুৎকেন্দ্রে দিলে বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব। এতে সামগ্রিক বিদ্যুতের উৎপাদন খরচ কমে আসে।
পাওয়ার সেল’র মহাপরিচালকের এই বক্তব্য গত ২৯ আগস্টের। যখন বিদ্যুতের হাহাকার ঠিক সেই সময়েও (২০১২ সালে) শিল্পে নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহের উদ্যোগ নিয়েছিল সরকার। ২০১২ সালের ২৮ মে শিল্পে নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য কিউ শ্রেণি ঘোষণা করা হয়। ওই শ্রেণিভুক্ত গ্রাহকদের বিশেষ লাইনের মাধ্যমে নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ দেওয়ার কথা বলা হয়। তাদের জন্য শ্রেণিভেদে ইউনিট প্রতি ১৩.৮৮ থেকে ১৪ .৯৯ টাকা নির্ধারণ করা হয়। ১৩২ কেভিতে ১৩.৮৮ টাকা, ৩৩ কেভিতে ১৪.৪৫ টাকা, ১১ কেভিতে ১৪.৯৯ টাকা দর ঘোষণা দেয় বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন। নতুন ওই শ্রেণিতে শ্রমঘন ও রফতানিমুখী শিল্পকে অনুমোদন করা হয়। ওই সময়ে শিল্পে ১১ কেভিতে পিক সময়ে ৮.০৮ টাকা ও অফ-পিকে ৫.১৬ টাকা ছিল।
আরও পড়ুন: বিদ্যুতের আপত্তির পরও তিতাসে ক্যাপটিভ সংযোগ বাণিজ্য
ব্যবসায়ীদের আকুতি মিনতির পর বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) প্রস্তাবে নতুন ওই শ্রেণি ঘোষণা আসে। বিইআরসির ওই ঘোষণার পর একজন শিল্পপতিও আবেদন নিয়ে আসেনি। এমনকি যারা মায়াকান্না করেছিলেন কিউ শ্রেণির জন্য তারাও আর আগ্রহ দেখালেন না। সে কারণে পরে কিউ শ্রেণি বিলুপ্ত করা হয় বলে পিডিবি দাবি করেছে।
বিইআরসিতে দায়েরকৃত পিডিবির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ক্যাপটিভ পাওয়ারে গ্যাস সরবরাহ করতে গিয়ে বিতরণ কোম্পানির অবহেলার শিকার হচ্ছে দক্ষ কম্বাইন্ড সাইকেল বিদ্যুৎকেন্দ্র। এতে একদিকে বিদ্যুৎকেন্দ্র অলস বসে থাকছে, অপরদিকে সরকারের ভর্তুকির গ্যাস ক্যাপটিভ পাওয়ার প্ল্যান্টে অপচয় হচ্ছে ।
ক্যাপটিভের জন্য যারা নানান যুক্তি দেখান তাদের উদ্দেশ্য এখন অনেকটাই পরিষ্কার হয়েছে। তাদের মুখোশ খুলে পড়েছে বলে জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা মন্তব্য করেছেন। তারা বলেছেন, মুনাফার জন্য অনেক কিছুই করতে পারেন কেউ কেউ। কিন্তু এতে যে রাষ্ট্র ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এতে তাদের কোন যায় আসে না।
আরও পড়ুন: অভিনব দুর্নীতির আবিষ্কারক তিতাস গ্যাস!
ক্যাপটিভের কারণে শিল্পে এক ধরনের অসম প্রতিযোগিতার সৃষ্টি হয়েছে। যাদের ক্যাপটিভ নেই তারা প্রতিযোগিতার বাজারে টিকতে পারছে না। অনেক দিন ধরেই এমন অভিযোগ করে আসছে ব্যবসায়ীরা। তাদের দাবি হয় সবাইকে ক্যাপটিভ দেওয়া হোক, না হলে তাদের বিদ্যুতের দাম কমিয়ে লেভেল প্লেইং ফিল্ড তৈরি করা হোক।
সরকার অবশ্য ক্যাপটিভ বন্ধে অনেকদিন ধরেই সোচ্চার। ২০১৫ সালে আগস্টে ক্যাপটিভ পাওয়ার প্লান্টে (শিল্প কারখানায় স্থাপিত বিদ্যুৎ উৎপাদন জেনারেটর) নতুন করে আর গ্যাস সংযোগ না দেওয়ার আদেশ প্রদান করে। জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের সহকারী সচিব শিরীন সুলতানা স্বাক্ষরিত (১০ আগস্ট) অফিস আদেশ বলা হয় ‘ক্যাপটিভ পাওয়ার প্লান্টের জন্য পুনরাদেশ না দেওয়া পর্যন্ত গ্যাস সংযোগ প্রদান না করার বিষয়ে সরকার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। অর্থাৎ এখন থেকে নতুন আর কোন শিল্প উদ্যোক্তা ক্যাপটিভ পাওয়ার প্লান্টে গ্যাস সংযোগ পাবে না।
তারপরও নানা সময়ে নানাভাবে সংযোগ দেওয়ার তথ্য প্রমাণ পাওয়া গেছে। কয়েক বছর ধরে গ্যাস সংযোগে কড়াকড়ির মধ্যে শিল্প ও ক্যাপটিভে গ্যাস সংযোগ নিয়ে সবেচেয়ে বেশি অভিযোগের তীর ড. তৌফিক ই ইলাহী চৌধুরীর বিরুদ্ধে। কয়েক বছর ধরে তার নেতৃত্বে একটি কমিটি ছিল, যে কমিটির সুপারিশ ছাড়া কোন রকম গ্যাস সংযোগ প্রদানে বিধিনিষেধ ছিল। সেই সময়েও ব্যাপক বাণিজ্যের অভিযোগ রয়েছে। তিনি টাকা নিয়েছেন এমন প্রমাণ না পেলেও তারা নাম ভাঙিয়ে তিতাস গ্যাসের একটি চক্র আঙুল ফুলে কলাগাছ বনে গেছেন। যার দায় তিনি এড়াতে পারেন না বলে অভিযোগ ভুক্তভোগীর।
বিদ্যুৎ বিভাগের ক্যাপটিভ বন্ধের আহ্বান ব্যর্থ হলে বিকল্প পথে হাটতে শুরু করেছিল। সম্প্রতি গ্যাসের দাম বৃদ্ধির গণশুনানিতে বিদ্যুৎ বিভাগ থেকে ক্যাপটিভের গ্যাসের দর বাড়িয়ে দেওয়ার সুপারিশ দেওয়া হয়েছিল। ভোক্তাদের পক্ষ থেকেও লেভেল প্লেইং ফিল্ড তৈরির জন্য ক্যাপটিভে গ্যাসের দর বৃদ্ধির দাবি তোলা হয়। বলা হয় ক্যাপটিভে গ্যাসের দর এমন করা উচিত যাতে লাইনের বিদ্যুতের সমান উৎপাদন খরচ পড়ে। বিইআরসি সে অনুযায়ী ক্যাপটিভে প্রতি ইউনিটের জন্য ২৮ টাকা দর চূড়ান্ত করে এনেছিল।
দর ঘোষণার মাত্র ৩ দিন আগে বিষয়টি প্রধানমন্ত্রীর বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিষয়ক উপদেষ্টা ড.তৌফিক ই ইলাহী চৌধুরীর কানে চলে যায়। গ্যাসের দর ঘোষণা করা হয় ৫ জুন (২০২২) ৩ দিন আগে ২ জুন বিইআরসিতে হাজির হন ড.তৌফিক ই ইলাহী চৌধুরী। প্রথা ভেঙে এদিন লম্বা সময় বিইআরসিতে অবস্থান করেন। তিনি ক্যাপটিভে গ্যাসের দর কমিয়ে ১৬ টাকা নির্ধারণের আদেশ দেন। আদিষ্ট হয়ে নাকি কারো দ্বারা প্রভাবিত হয়ে কাজটি করেছেন সে বিষয়ে প্রশ্ন রয়েছে বিস্তর।
অনেকেই মনে করে ক্যাপটিভের সংযোগ বাণিজ্য চালিয়ে যাওয়ার জন্য একটি গ্রুপ ভীষণ তৎপর। তিতাস গ্যাসের কিছু কর্মকর্তা ও ঠিকাদার রয়েছে গোপন আতাত। তারা মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে বছরের পর পর সংযোগ বাণিজ্য চালিয়ে যাচ্ছেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে অনেকেই কথা বললেও ভয়ে প্রকাশ্য মুখ খুলতে চান না। তাদের বক্তব্য হচ্ছে তিতাস কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে কথা বলা জলে বাস করে কুমিরের সঙ্গে যুদ্ধ করার শামিল।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক ব্যবসায়ী জানান, তিতাস গ্যাস কোন নিয়মের মধ্যে চলে না। এখানে সেবা বলতে কিছুই নেই। তারা যা বলবে তাই আইন। এমডিতো অনেক বড় কর্মকর্তা, একজন সহকারী ম্যানেজার যে কোন সময় আপনার লাইন বন্ধ করে দিতে পারে। ঢাকার একটি সিএনজি ফিলিং স্টেশন ঘুষ না দেওয়া যা হয়েছে তাকে রাহাজানি ছাড়া আর কিছু বলা যায় না। মিটারসহ সবকিছু ঠিকঠাক থাকলেও সিস্টেম আপগ্রেডেশনের নামে সাড়ে ৭ কোটি টাকার একটি বিল ধরিয়ে দেওয়া হয়। মাওনা এলাকায় অবস্থিত একটি স্পিনিং মিল বন্ধ থাকার পর সোয়া ২ কোটি টাকার বিল ধরিয়ে দেওয়া হয়। কোম্পানিটি মিটারে সমস্যা দেখলে ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তিতাস গ্যাসে লিখিতভাবে আবেদন করে। আর তিতাস গ্যাস সেখানে যায় ৪ মাস পরে। সেই মিটার পরীক্ষা করতে সময় নেয় আরও ৬ মাস। এই হচ্ছে তিতাস গ্যাসের বর্তমান সেবার নমুনা।
ক্যাপটিভে ব্যবসায়ীদের দুর্বলতার জায়গাটি তিতাস গ্যাস কর্তারা অবগত। এই দুর্বলতার সুযোগকে কাজে লাগিয়ে নিজেদের আখের গুছিয়ে নিচ্ছেন। অতীতে ব্যবস্থাপনা পরিচালকরা কিছুটা রাখঢাক করলেও এখন যেনো মুখোশ খুলে পড়েছে। ২ দিনের নোটিশেও কাউকে কাউকে গ্যাস সংযোগের অনুমোদন দেওয়া হচ্ছে। আর যারা তাদের সুর ধরতে পারছে না তাদের ফাইলে ধুলোর আস্তরণ জমছে। লোকাল অফিস থেকেই অনেক ফাইল হাওয়া হয়ে যাচ্ছে।
গত ২১ জুলাই বোর্ডসভায় দু’টি কোম্পানির ক্যাপটিভ লোড বৃদ্ধি করা হয়। ভালুকার জামিরদিয়া এলাকায় অবস্থিত মেসার্স স্কয়ার এ্যাপারেলস লিমিটেডের (গ্রাহক সংকেত নম্বর-৩৭৯/৮৭৯০১২৬) ক্যাপটিভ রানে ৪৭ হাজার ৮৮৯ ঘনফুট (ঘণ্টা প্রতি) লোড বৃদ্ধি করা হয়। একই বোর্ডে মেসার্স বি. জে. বেড উইভিং লিমিটেড (গ্রাহক সংকেত নম্বর ৩২২/৮৩২-০০০৯৮০) ক্যাপটিভের লোড বাড়ানো হয়। শুধু লোড বৃদ্ধি নয় গত ২৬ এপ্রিলে বোর্ডে সাভারে অবস্থিত বাংলাদেশ এক্সপোর্ট ইমপোর্ট কো. লিমিটেড ও মেসার্স সাচ্ছান কোম্পানির (বিডি) নতুন ক্যাপটিভ সংযোগ অনুমোদন দেওয়া হয়। এর আগে ৯ এপ্রিল ৮৮১তম বোর্ডসভায় প্রায় ১৬টি ক্যাপটিভ সংযোগ পুনঃবিন্যাস করা হয়। শুধু এসব বোর্ডে নয়, প্রত্যেক মাসেই ক্যাপটিভে গ্যাস সংযোগ দিয়ে নতুন নজির গড়েছেন বর্তমান এমডি।
একাধিক দফায় ফোন দিলেই রিসিভ করেননি তিতাস গ্যাসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী হারুনুর রশীদ মোল্লাহ।