পিছিয়ে গেছে সেপ্টেম্বর মাসের এলপি গ্যাসের দর ঘোষণা আয়োজন। ডলারের দরসহ বেশ কিছু ইস্যুতে বিইআরসি (বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের) লোয়াব (এলপিজি অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ) ঐক্যমত না হওয়ায় পিছিয়ে দেওয়া হয়েছে।
আনুষ্ঠানিক দর ঘোষণা আগামী ৭ সেপ্টেম্বর আসতে পারে বলে জানিয়েছেন কমিশনের সদস্য মকবুল ই-এলাহী চৌধুরী।
কমিশনের ওই সদস্য বার্তা২৪.কম-কে বলেছেন, ব্যবসায়ীরা দাবি করেছেন তারা সরকারি ব্যাংকের দর অনুযায়ী ডলার পাচ্ছে না। তাদেরকে বেসরকারি ব্যাংক থেকে বাড়তি দরে ডলার কিনতে হচ্ছে। সেই বাড়তি দর অনুযায়ী ডলারের ধর নির্ধারণের দাবি জানিয়েছে। বেসরকারি একেক ব্যাংক একেক দরে বিক্রি করছে। এখানে আইনগত কিছু বিধি নিষেধ থাকায় বেসরকারি ব্যাংকের ডলার রেট অনুসরণ করা কঠিন।
বিইআরসি সূত্র জানিয়েছে, ডলারের দর ছাড়াও জ্বালানি তেলের দাম বেড়ে যাওয়ায় লোয়াব পরিবহন খরচ বৃদ্ধির দাবি জানিয়েছে। ১১টি কোম্পানি ইতিমধ্যে গণশুনানির জন্য আবেদন দিয়েছে। আমরা তাদের প্রস্তাবগুলো পর্যালোচনা করছি। পরিবহন খরচ যে বেড়েছে তা প্রমাণের জন্য প্রয়োজনীয় কাগজ দিতে বলা হয়েছে। এক্ষেত্রে কয়েকটি কোম্পানি কাগজ দিলেও বেশিরভাগ কোম্পানি সহযোগিতা করছে না।
অভিযোগ রয়েছে, বিইআরসির আদেশকে তোয়াক্কাই করছে না এলপি গ্যাস আমদানিকারকরা। তাদের যখন সুবিধা হয়েছে মেনে নিয়েছে যখনই মুনাফা কমে গেছে তখনই নিজেদের ইচ্ছায় চলছে।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, আজম জে চৌধুরীর ইস্ট-কোস্ট গ্রুপ (ওমেরা এলপিজি), সালমান এফ রহমানের বেক্সিমকো গ্রুপ (বেক্সিমকো এলপিজি), মোস্তফা কামালের মেঘনা গ্রুপসহ (ফ্রেশ এলপিজি) এ খাতের ব্যবসায়ীদের হাতের পুতুল হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে বিইআরসি। আর সরকারও নিজেকে সপে দিয়ে বসে রয়েছে। তারা যা খুশি তাই করছেন, যেনো কারো কিছু করার নেই, কেউ কিছু করারও সাহস দেখাচ্ছে না। বিইআরসি কিছুটা উদ্যোগী হলেও পিছু হটেছে বাধ্য হয়ে। সরকারের পক্ষ থেকে যে সার্পোট পাওয়ার কথা তা কখনই পাচ্ছে না।
২০২১ সালের ১২ এপ্রিল প্রথমবারের মতো এলপি গ্যাসের দর ঘোষণা করে বিইআরসি। বিইআরসির আদেশে বলা হয়েছিল সৌদি রাষ্ট্রীয় কোম্পানি আরামকো ঘোষিত দরকে প্রতি মাসের ভিত্তি মূল্য বিবেচিত হবে। সৌদির দর উঠা-নামা করলে এলপিজির মূল্য উঠা-নামা করবে। আমদানিকারকের অন্যান্য কমিশন ও খরচ অপরিবর্তিত থাকবে।
১২ এপ্রিল দর ঘোষণার দিনেই আমদানিকারকদের পক্ষ থেকে আপত্তি তোলা হয়। তারা দাবি করে দর বেশি হওয়া উচিত ছিল। ঘোষিত দরে তাদের ব্যবসা চালিয়ে নেওয়া সম্ভব না। এরপর থেকে বিইআরসির সঙ্গে টানাপোড়েন শুরু হয় লোয়াবের। তারা প্রতিমাসের দর ঘোষণাও বর্জন করে। নিজেদের ইচ্ছামতো দরে বেচাকেনা করতে থাকে। অন্যদিকে বিভিন্নভাবে বিইআরসির ওপর চাপ তৈরি করে, এলপিজি আমদানি বন্ধ করার হুমকি দেন লোয়াব সভাপতি আজম জে চৌধুরী। এক পর্যায়ে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ অনেকটা ব্যবসায়ীদের সুরেই কথা বলতে থাকেন।
লোয়াবের চাপে বিইআরসি অনেকটা বাধ্য হয়েই (৫ মাসের মাথায় ১৩ সেপ্টেম্বর) ফের শুনানি নিয়ে কমিশন বাড়িয়ে দেয়। এপ্রিলে ঘোষিত দরে এলপিজির আমদানিকারক, ডিলার ও খুচরা বিক্রেতার জন্য ১২ কেজির সিলিন্ডারে মোট ৩৫৯ দশমিক ৪০ টাকা কমিশন নির্ধারণ করা হয়েছিল। পরের দফায় সেই চার্জ বাড়িযে ৪৪১ টাকা করা হয়। অর্থাৎ ১২ কেজি সিলিন্ডারে কমিশন বাড়ানো হয়েছে ৮১ দশমিক ৬ টাকা। ডিলার এবং খুচরা বিক্রেতার কমিশন বাড়িয়ে যথাক্রমে ৩৪ ও ৩৮ টাকা করা হয়েছে।
দর যখন নিম্নগামী তখন মাইনাস ওয়ান (আগের মাসের) ফর্মুলায় তাদের কোন আপত্তি ছিল না। আমদানিকৃত গ্যাস সিস্টেমে আসতে ১৫ থেকে ২০ দিন সময় লেগে যায় সে কারণে দ্বি-পাক্ষিক আলোচনার ভিত্তিতেই মাইনাস ওয়ান ফর্মুলা নির্ধারণ করা হয়। অর্থাৎ আগের মাসের দর অনুযায়ী পরের মাসে গ্যাসের দর নির্ধারিত হতে থাকল। কয়েক মাস পরে যখন বাজারে ঊর্ধ্বগতি শুরু হলো, তখনেই বাগড়া দিয়ে বসে এলপিজি আমদানিকারকরা। তারা বলা শুরু করে, মাইনাস ওয়ার্ন ফর্মুলায় তারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন, বর্তমান মাসের দর অনুযায়ী মূল্য নির্ধারণ করতে হবে। বিইআরসি দর ঘোষণার আগেই দাম বাড়িয়ে দেয়। বিইআরসিও তাদের কথায় বাধ্য হয়ে মাইনাস ওয়ান বাতিল করে ।
লোয়াব দাবি করে আসছে তাদের বিদেশ থেকে আনতে জাহাজ ভাড়া যথাযথভাবে আমলে নেওয়া হয়নি। জবাবে বিইআরসি তাদের কমার্শিয়াল এনভয়েস দাখিল করতে বললেও দাখিল থেকে অনেকেই বিরত থেকেছে। যারা ছোট ছোট জাহাজে এলপিজি আনছে তাদের কয়েকটি এনভয়েস দাখিল করে। লোয়াব বরাবরই দাবি করে আসছে টন প্রতি তাদের পরিবহন খরচ পড়ছে ১১০ ডলার থেকে ১৩০ ডলার পর্যন্ত। লোয়াব যখন এই দাবি করেছে সেই সময়ে মোংলা বন্দর থেকে টিকে গ্রুপের একটি এনভয়েসে সংগ্রহ করে তাতে টন প্রতি মাত্র ৬৫ ডলার জাহাজ ভাড়া দেখা গেছে। বিষয়টি বিইআরসি জানলেও চাপের মুখেই পরিবহন খরচ ৯৫ ডলার করে দেয়। যদিও তাদের এপ্রিলের আদেশে বলা হয়েছিল জাহাজ ভাড়া কমিয়ে আনতে হবে। দরকার হলে কয়েকজন মিলে গ্রুপ করে বড় জাহাজে আমদানি করে পশ্চিমবঙ্গের মতো জাহাজ ভাড়া কমাতে হবে।
লোয়াব নতুন করে ডিজেলের দাম বৃদ্ধির কথা বলে আবার কমিশন বাড়ানোর দাবি তুলেছে । অবাক করার হচ্ছে ইতিমধ্যেই তারা বাজারে দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। আগস্টে ১২ কেজি সিলিন্ডারের খুচরা মূল্য ১২১৯ টাকা করা হলেও তারা ১২৮০ টাকা পাইকারি দরে বিক্রি করছে। বিস্ময়কর হচ্ছে কোম্পানিগুলো প্রকাশ্য বলছে বিইআরসি নির্ধারিত দরে বিক্রি করা সম্ভব নয়। তাদের সেই বক্তব্যের পর লাইসেন্স বাতিল হওয়ার কথা, কিন্তু বিইআরসি হাত গুটিয়ে বসে রয়েছে। পরিবহন খরচ বৃদ্ধির জন্য যে আবেদন করেছে এবারও কমার্শিয়াল এনভয়েস জমা দেননি অনেকেই। বিইআরসি তাদের আবেদনের সত্যতা যাচাইয়ে এনবিআর থেকে তথ্য সংগ্রহ করতে পারতো। বিইআরসিরও অনীহার কারণে প্রকৃত সত্য থেকে যাচ্ছে আড়ালে।
২০০৮-০৯ অর্থবছরে দেশে এলপিজি ব্যবহৃত হয়েছে ৪৪ হাজার ৯৭৪ মেট্রিক টন। কয়েক বছরে চাহিদা বেড়ে ১২ লাখ টনে উন্নীত হয়েছে। জাইকার এক সমীক্ষায় বলা হয়েছে, ২০২৫ সালে ৩০ লাখ টন ও ২০৪১ সালে চাহিদা হবে ৬০ লাখ টন। দেশে ব্যবহৃত এলপিজির সাড়ে ৯৮ ভাগ আমদানি নির্ভর। সরকারি (বাংলাদেশ এলপি গ্যাস কোম্পানি লিমিটেড) কোম্পানির মার্কেট শেয়ার মাত্র দেড় শতাংশের মতো। সরকার এখন পর্যন্ত ৫৬টি কোম্পানি অনুমোদন দিয়েছে। এরমধ্যে ২৮ টির মতো মার্কেটে রয়েছে বেশকিছু কোম্পানি প্রস্তুতি পর্যায়ে রয়েছে।