পাস না করেও তিতাসে চাকরি, বহাল তবিয়তে বয়োবৃদ্ধরাও

বিদ্যুৎ-জ্বালানী, অর্থনীতি

সেরাজুল ইসলাম সিরাজ, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম | 2023-09-01 21:38:05

 

চাকরির জন্য ন্যূনতম এসএসসি পাসের বাধ্যবাধকতা থাকলেও তিতাস গ্যাস কোম্পানিতে ৭১ জন চাকরি করছেন অষ্টম শ্রেণি পাস। সর্বোচ্চ বয়সসীমা ৬০ অতিক্রম করার পরও চাকরিতে বহাল রয়েছেন ৮ জন।

এ ক্ষেত্রে মাসোহারার বিষয়টি ওপেন সিক্রেট বলে মন্তব্য করেছেন অনেকেই। তারা বলেছেন, যদি তাই না হবে তাহলে সবকিছু জানার পরও কেনো ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করছেন তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন এন্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী হারুনুর রশীদ মোল্লাহ।

তিতাস সূত্র জানিয়েছে, প্যানথার সিকিউরিটিজ সার্ভিস লিমিটেডের মাধ্যমে বিভিন্ন পদে ৩০০ লোক নেওয়া হয়। অযোগ্য লোকদের নিয়োগ দেওয়ার বিষয়ে তখনেই আপত্তি উঠলেও রহস্যজনক কারণে সবকিছু ধামাচাপা পড়ে যায়। এসব কর্মীর মধ্যে গাড়ির ড্রাইভারও রয়েছে। যাদের চাকরির জন্য আউটসোর্সিং বিধিমালায় এসএসসি পাস বাধ্যতামুলক হলেও তিতাস তোয়াক্কাই করছে না।

চলতি বছরের মার্চে মেয়াদ শেষ হয়ে যায় প্যানথার সিকিউরিটিজের। দরপত্রের মাধ্যমে নতুনভাবে কাজ পায় কৃষ্ণা সিকিউরিটি সার্ভিসেস লিমিটেড। নতুন প্রতিষ্ঠানকে শর্ত জুড়ে দেওয়া হয়, পুর্বের নিয়োগ প্রাপ্ত ৩০০ জন বহালসহ ৪০৮ লোকবল নেওয়ার। সে অনুযায়ী গত ২৯ মার্চ তিতাস গ্যাসের সঙ্গে চুক্তি করে কৃষ্ণা সিকিউরিটি সার্ভিসেস লিমিটেড।

আউটসোর্সিং প্রতিষ্ঠান কৃষ্ণা সিকিউরিটি সার্ভিসেস লিমিটেড ডাটাবেজ তৈরি করতে গিয়ে ব্যাপক অনিয়মের তথ্য প্রমাণ পায়। তারা ৭৯ জনের বিষয়ে আপত্তি দিয়েছে। এতে বলা হয়েছে আপনাদের (তিতাস গ্যাস) তালিকায় বর্ণিত ৩০০ জনের মধ্যে ৭৯ জনের কাগজপত্রাদি সম্পাদিত চুক্তির ৬.২ অনুচ্ছেদের শর্ত পূরণ করে না। আউটসোর্সিং নীতিমালায় যাদের চাকরির ক্ষেত্রে ন্যূনতম শিক্ষাগত যোগ্যতা হবে এসএসসি পাস। সেখানে অনেকেই রয়েছে যারা অষ্টম শ্রেণি পাস। আর বয়সসীমা ১৮ থেকে ৬০ বছর থাকার কথা থাকলেও বেশ কয়েকজন রয়েছে যাদের বয়সসীমা অতিক্রম করেছে।

৭১ জন কাজ করছেন যারা অনেকেই প্রাথমিকের গণ্ডি পার হননি। অনেকেই অষ্টম শ্রেণি পাসের কাগজ জমা দিয়েছেন ঘষামাজা। আর তাদের মধ্যে থেকেই কেউ কেউ কম্পিউটার পরিচালনার মতো স্পর্শকাতর কাজে যুক্ত। 

অথচ তিতাসেই গভীর রাতে সার্ভারে ঢুকে অবৈধ গ্রাহককে বৈধ করার চাঞ্চল্যকর ঘটনা ঘটেছে। রাতের আধারে কোম্পানির সার্ভারে এন্ট্রি দিয়ে বৈধ করার অভিযোগে ৮ কর্মকর্তা-কর্মচারীর নামে মামলা করতে বাধ্য হয় তিতাস। প্রাথমিকভাবে এক রাতেই ১ হাজার ২৪৭টি সংযোগ বৈধ করে দেওয়ার অভিযোগে রাজধানীর ভাটারা থানায় মামলা (৭ সেপ্টেম্বর ২০২০) দায়ের করা হয়। ওই মামলায় আসামী করা হয় উপ-মহাব্যবস্থাপক প্রকৌশলী রতন চন্দ্র দে, ব্যবস্থাপক রকিব উদ্দিন সরকার, উপ-ব্যবস্থাপক রজব আলি, মো. রেজাউল করিম খান, উপ-সহকারী প্রকৌশলী মহিউদ্দিন জাবেদ, সিনিয়র নিরাপত্তা প্রহরী মো. মাসুদ রানা, আবুল কালাম আজাদ ও মাকসুদুল হককে।

সশ্লিষ্টরা অভিযোগ করেছিলেন, ওই রাতের ঘটনাটি প্রতীকী, সামনে আসায় ধরা পড়েছে। এ রকম লাখ লাখ অবৈধ সংযোগ রয়ে গেছে সার্ভারে। যা সামনে আসেনি বলে থেকে গেছে লোকচক্ষুর অন্তরালে।

তিতাস গ্যাসের সূত্র জানিয়েছে, স্পর্শকাতর পদেও অযোগ্যদের বহাল রাখতে তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছেন ব্যবস্থাপনা পরিচালক। সবকিছু জানার পরও ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন। জনশ্রুতি রয়েছে নগদ অর্থ লেনদেনের বিষয়ে। নতুন করে লোক নিয়োগের ক্ষেত্রেও জালিয়াতির অভিযোগ উঠেছে তিতাস এমডির বিরুদ্ধে।

তিতাসের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন, আউটসোর্সিং কোম্পানি লোকবল দেওয়ার কথা থাকলেও নতুন নিয়োগ পাওয়া ২৫ জনের মধ্যে ২০ জনকে নিয়োগ দিয়েছেন তিতাস এমডি। যার মধ্যে ১৮ জনেই তার নিজ এলাকা কেরানীগঞ্জের বাসিন্দা। অবশিষ্ট লোকবলও তিনি নিয়োগ দেওয়ার ফরমান জারি করেছেন। এ নিয়ে কৃষ্ণার পক্ষ থেকে আপত্তি তোলা হলেও তারা পাত্তা পাচ্ছেন না।

কৃষ্ণা সিকিউরিটি সার্ভিসেস লিমিটেড এর চেয়ারম্যান এল কে রায় সুমন বার্তা২৪.কমকে বলেছেন, আমি এখনই বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে চাচ্ছি না। সপ্তাহ খানেক পরে এ বিষয়ে কথা বলতে চাই। শিক্ষাগত যোগ্যতার ঘাটতির বিষয়ে তার দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে বলেন, আমি আসলে এখনই কিছু বলতে চাইনা, আমাকে কয়েকটা দিন সময় দেন।

তিতাস এমডির এসব অপকর্মে ঘনিষ্ঠ সহযোগি হিসেবে কাজ করেছেন সদ্য বিদায়ী ইয়াকুব খাঁন। যাকে একাধারে জিএম (প্রশাসন) ও কোম্পানি সচিব পদে বসিয়ে রেখেছিলেন।  কুখ্যাত রাজাকার মোনায়েম খাঁনের নাতি ইয়াকুব খাঁন ছিলেন গত ৩১ আগস্ট অবসরে গেছেন। তিনি ও এমডি মিলে ১৫ আগস্টের দোয়া মাহফিলে মিস্টি বিতরণ করে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েছিলেন।

তিতাস গ্যাসের ব্যাবস্থাপনা পরিচালক হারুনুর রশীদ মোল্লাহকে ফোন দেওয়া হলেও তিনি রিসিভ করেন নি।

তিতাস গ্যাসে চুক্তি ভিত্তিক নিয়োগ পাওয়ার পর থেকে বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন। আইনের তোয়াক্কা না করে নিজের খেয়ালখুশিতে চলছেন। বিইআরসির আদেশ ছাড়াই প্রি-পেইড মিটারের মাসিক ভাড়া ৬০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১০০টাকা করেছেন। ৫ থেকে ১০ হাজার টাকা মূল্যে যে  প্রি-পেইড মিটার পাওয়া যায়, সেই মিটার কিনেছেন ২৩ হাজার টাকা করে।

তিতাস গ্যাস এখন দুর্নীতির স্বর্গরাজ্য হয়ে উঠেছে। ক্যাপটিভ পাওয়ারে গ্যাস সংযোগ বন্ধে সরকারি নির্দেশনা থাকলেও তা মানা হচ্ছে না। কোটি কোটি টাকা লেনদেনের মাধ্যমে ক্যাপটিভে গ্যাস সংযোগ দেওয়া হরদম। পুর্বের দেওয়া সংযোগে ঢালাওভাবে লোড বৃদ্ধি করা হচ্ছে। ১০ মেগাওয়াটের অধিক ক্ষমতার ক্যাপটিভ হলে বিদ্যুৎ বিভাগের পূর্বানুমতি আবশ্যক রয়েছে। সেখানেও জালিয়াতি করার তথ্য প্রমাণ পাওয়া গেছে। দেখা গেলে একই কোম্পানির নামে ভিন্ন ভিন্ন  ফাইল তুলে ১৫ থেকে ২৫ মেগাওয়াট পর‌্যন্ত লাইন দেওয়া হয়েছে। তিতাসের অর্থলোভি মানসিকতার কাছে বিঘ্নিত হচ্ছে জাতীয় স্বার্থ।

এতে করে রাষ্ট্র দুই দিক থেকেই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, এক গ্যাস ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো বসিয়ে রেখে ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হচ্ছে, দ্বিতীয়ত হচ্ছে গ্যাসের অপচয়। ক্যাপটিভে ১ মিলিয়ন গ্যাস দিয়ে ৪ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয়। একই পরিমাণ গ্যাস কম্বাইন্ড সাইকেল বিদ্যুৎ কেন্দ্রে সরবরাহ করা গেলে ৬ মেগাওয়ার্ট বিদ্যুৎ পাওয়া সম্ভব। তিতাসের কারসাজিতে গত বছর মাত্র ৪০ শতাংশ চলেছে গ্যাস ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো, আর ৬০ শতাংশ সময় ছিল অলস বসে।

গ্রাহকরা অভিযোগ করেছেন, বর্তমান এমডি হারুনুর রশীদ মোল্লাহ দুর্নীতিকে প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ করেছেন। ঘুষ না দিলে সেবা মেলে না তিতাসে। অনেক সময় অন্যায় আবদার মেনে না নিলে নেমে এসেছে হয়রানীর খড়গ। দেখা গেছে সবকিছু ঠিক রয়েছে তবুও সিস্টেম আপগ্রেডেশনের নাম কোটি কোটি টাকার বিল চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে।

সম্প্রতি কাজ দেখাতে অবৈধ সংযোগ বিচ্ছিন্ন অভিযানে নামে কাড়ি কাড়ি টাকা খরচ করছেন। প্রত্যেকটি অভিযানে ১ লাখ ২০ হাজার টাকার মতো বিল কষা হচ্ছে। সেই উচ্ছেদ অভিযানেও রয়েছে শুভঙ্করের ফাঁকি। অল্প পরিমাণে উচ্ছেদ করলেও বেশি পরিমাণে প্রচার করা হচ্ছে। আবার এমন সব এলাকার নাম লেখা হয়েছে যেখানে কখনও গ্যাসের লাইনই ছিল না। বকেয়া আদায়েও তার ব্যর্থতার পাল্লা ভারি। আগের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের সময়ের তুলনায় তার সময়ে পুঞ্জিভূত বকেয়ার পরিমাণ অনেক বেশি। বিএনপি নেতা গয়েশ্বর চন্দ্রের বাসার সংযোগ ৩০ মাস পর বিচ্ছিন্ন করে বাহবা নিতে চেয়েছেন। অথচ আইন অনুযায়ী তৃতীয় মাসেই তার সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার কথা।

এ সম্পর্কিত আরও খবর