গ্যাসের সিস্টেম লস ১০ শতাংশ থেকে ২ শতাংশে নামিয়ে এনে প্রতিদিন ২৫০-৩০০ মিলিয়ন গ্যাস সাশ্রয় করা সম্ভব। পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করা গেলে ছয় মাস থেকে এক বছরের মধ্যে সিস্টেম লস কমানো সম্ভব বলে মন্তব্য করেছেন জ্বালানি বিশেষজ্ঞর।
রোববার (১৮ সেপ্টেম্বর) বাংলাদেশ এনার্জি সোসাইটির (বিইএস) আয়োজিত বৈশ্বিক জ্বালানি সংকটে বাংলাদেশের করণীয় শীর্ষক ওয়েবিনারে বিশেষজ্ঞরা এমন মতামত তুলে ধরেন।
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, সিস্টেম লস কমানো গেলে স্পটবাজার থেকে এলএনজি কেনার বিকল্প হবে, শিল্পে আরও বেশি গ্যাস সরবরাহ করা যাবে। উল্লেখ্য গত বছরে গড়ে ৯৯ এমএমসিএফডি গ্যাস স্পর্ট মার্কেট থেকে আমদানি করা হয়েছে। যার তিনগুণ পরিমাণে সিস্টেম লসের নামে চুরি হয়ে যাচ্ছে।
পেট্রোবাংলার পরিকল্পনামাফিক ২০২৫ সালের মধ্যে ৬১৮ এমএমসিএফডি গ্যাস যুক্ত করার পরিকল্পনা অতি আশাবাদী। ফলে এই সময়কালে গ্যাস সংকট আরও বৃদ্ধি পাবে। অন্যদিকে দীর্ঘমেয়াদি কর্মসূচির আওতায় দেশের তেল, গ্যাস ও কয়লা অনুসন্ধান এবং উত্তোলনের পাশাপাশি এলএনজি আমদানিতে অবকাঠামো নির্মাণ ও দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির আওতায় এলএনজি কেনার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রীর বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিষয়ক উপদেষ্টা ড. তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী বলেন, চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বিশ্বব্যাপী প্রায় সকল খাতেই ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে, যা এই অস্থিতিশীল ও সংকটময় অবস্থা সৃষ্টি করেছে বাংলাদেশও এর বাইরে নয়। তাই কীভাবে বর্তমান সংকট কাটিয়ে ওঠা যায় এবং ভবিষ্যতে এরূপ পরিস্থিতি সামাল দেওয়া যায় আমরা সে চেষ্টাই করছি।
নিজস্ব গ্যাসসম্পদ অনুসন্ধান প্রসঙ্গে তিনি বলেন, গত ১০ বছর সময়কালে ৫০টি কূপ খনন করার পরও বড় কোনো সাফল্য পাওয়া যায়নি। তারপরও স্থলভাগে চেষ্টা অব্যাহত আছে। সাগরে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের জন্যও প্রস্তুতি চলছে। কিন্তু সাফল্য কতটা পাওয়া যাবে এবং পরিবর্তিত বিশ্ব প্রেক্ষাপটে আন্তর্জাতিক তেল কোম্পানিকে আকর্ষণ করা যাবে কি না তা নিয়ে সংশয় আছে। ফলে অর্থনীতির চাকা চালু রাখতে এলএনজি আমদানি অবকাঠামো স্থাপনের কাজ চলমান আছে। ফসিল জ্বালানির ওপর চাপ কমাতে পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের কাজ চলছে। আগামী বছর তার প্রথম ইউনিট উৎপাদনে আসবে। আবার সোলার, উইন্ড নিয়েও আমরা পিছিয়ে নেই। কিন্তু স্টোরেজ ছাড়া ২৪/৭ বিদ্যুৎ নবায়নযোগ্য উৎস থেকে পাওয়ার কোনো সুযোগ নেই।
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে প্রফেসর ম. তামিম বলেন, বাংলাদেশ আমদানিকৃত এবং নিজস্ব উভয় জ্বালানিই ব্যবহার করে। তবে চলমান সংকট মোকাবিলায় আমাদের আরও গুরুত্বের সঙ্গে নিজস্ব জ্বালানির উৎপাদন বৃদ্ধিতে মনোযোগী হতে হবে। বিশেষ করে নবায়নযোগ্য শক্তি ও জ্বালানির দক্ষ ব্যবহারের দিকে আমাদের বাড়তি নজর দিতে হবে। নিজস্ব গ্যাস ও কয়লা দিয়ে জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে না। এলএনজি আমদানি করতেই হবে। তবে কয়লা আমদানির ওপর চাপ কমাতে নিজেদের কয়লা কীভাবে ব্যবহার করা যায় তা নিয়ে এখনই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। অন্যদিকে সাগরে সার্ভে করে ডাটা প্যাকেজ তৈরির আগে অপশোর বিডিংয়ে গেলে আমাদের নেগোসিয়েশন সক্ষমতা কমে যাবে।
তিনি মনে করেন, বিশ্ববাজারে জ্বালানির দামের অস্থিরতা স্থায়ী হবে না। তাই সতর্কতার সঙ্গে বাংলাদেশকে দীর্ঘমেয়াদে জ্বালানি জোগান পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে।
বাংলাদেশ এনার্জি সোসাইটির সভাপতি মো. আবুল কালাম আজাদ তার বক্তব্যে বলেন, বাংলাদেশ জ্বালানি আমদানি-নির্ভর দেশ হলেও নিজস্ব জ্বালানি উৎপাদনে আমরা সক্ষম এবং বিগত বছরগুলোয় আমরা তা দেখেছি। বর্তমানে বিশ্ববাজার অস্থিতিশীল হওয়ায় সবকিছুর দামই ঊর্ধ্বমুখী, যার প্রভাব জ্বালানিতেও পড়েছে।
সর্বপ্রথম কার্যকরী পরিকল্পনা গঠন করে তা বাস্তবায়নে সকলকে নিজ-নিজ অবস্থান থেকে এগিয়ে আসতে হবে। আমাদের নিজস্ব কয়লা উৎপাদন বৃদ্ধির ব্যবস্থা করতে হবে। লিকেজ কমানোর ব্যবস্থা করতে হবে।
খন্দকার আবদুস সালেক বলেন, গ্যাসের সিস্টেম লস বর্তমান পর্যায় থেকে ২ শতাংশ নামিয়ে আনলে ২৫০-৩০০ এমএমসিএফডি গ্যাস সাশ্রয় করা সম্ভব। যা দিয়ে শিল্পে বাড়তি গ্যাসের জোগান দেওয়ার মাধ্যমে উৎপাদন গতিশীল করা সম্ভব।
বিইএস-এর সহসভাপতি ও বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান এএসএম আলমগীর কবিরের সভাপতিত্বে ওয়েবিনারের মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বিইএস-এর সভাপতি ও সাবেক মুখ্য সচিব মো. আবুল কালাম আজাদ। বক্তব্য রাখেন জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (অপারেশন) এস এম জাকির হোসেন, এফবিসিসিআই-এর এনার্জি স্ট্যান্ডিং কমিটির চেয়ারম্যান ও এনার্জিপ্যাক পাওয়ার জেনারেশন লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হুমায়ুন রশিদ, বাংলাদেশ ইন্ডিপেন্ডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ইমরান করিম, সামিট গ্রুপ-এর পরিচালক মোহাম্মদ ফয়সাল করিম খান।