চট্টগ্রাম থেকে ফিরে: কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির (কেজিডিসিএল) মহাব্যবস্থাপক (বিপণন দক্ষিণ) আমিনুর রহমানের বিরুদ্ধে ঘুষ দুর্নীতির তথ্য প্রমাণ পাওয়া গেছে। গ্যাসের বিল বকেয়ার ফাইল কোম্পানি থেকে গায়েব করার সঙ্গে তার নাম উঠে এসেছে।
পেট্রোবাংলা গঠিত তদন্ত কমিটির রিপোর্টে এমন ভয়াবহ তথ্য প্রমাণ বের হয়ে এসেছে। কেজিডিসিএল’র দুর্নীতির বিষয়ে সর্বশেষ কমিটি গঠন (২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২২) করা হয় পরিচালক (পরিকল্পনা) আলী ইকবাল মোঃ নুরুল্লাহ এর নেতৃত্বে। ৪ সদস্যের ওই কমিটি গঠনই করা হয় পরিচালকের (অপারেশন এন্ড মাইন্স) নেতৃত্বে গঠিত কমিটির রিপোর্টের উপর ভিত্তি করে। আলী ইকবাল মোঃ নুরুল্লাহ কমিটিকে দায়িত্ব দেওয়া হয় আগের কমিটির রিপোর্টের অধিকতর তদন্তের জন্য।
আলী ইকবাল মোঃ নুরুল্লাহ কমিটি তদন্তে অসংখ্য অনিয়মের পাশাপাশি কেজিডিসিএল’এ একটি সিন্ডিকেটের প্রমাণ পেয়েছেন। কমিটি স্পষ্ট করেই উল্লেখ করেছে সিন্ডিকেট সংশ্লিষ্টদের নাম ও অপকর্মের ফিরিস্তি। এমন এমন সব অনিয়মের প্রমাণ বের হয়ে এসেছে যা দেখে গ্যাস সেক্টরের লোকজনের চোখ কপালে ওঠার মতো অবস্থা।
মহাব্যবস্থাপক (বিপণন দক্ষিণ) আমিনুর রহমান ওই সিন্ডিকেটের অন্যতম সদস্য। মেসার্স জিন্স এক্সপ্রেস লিমিটেড’র শিল্প ও ক্যাপটিভ সংযোগের ক্ষেত্রে বিশাল জালিয়াতির ঘটনায় নেতৃত্ব দিয়েছেন তিনি। বকেয়ার দায়ে কোম্পানিটির গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্ন থাকা অবস্থায় গ্যাস ব্যবহারের সুযোগ করে দিতে মূখ্য ভূমিকা পালন করেছেন। তদন্ত কমিটি মনে করছে শর্টপিছ ব্যবহার করে চোরাইভাবে গ্যাস ব্যবহার করেছে কোম্পানিটি।
মেসার্স জিন্স এক্সপ্রেস লিমিটেড’র (গ্রাহক সংকেত-৬২৭৬) বকেয়ার দায়ে ২০১৭ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি শিল্প ও ক্যাপটিভ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়। বকেয়া ও অন্যান্য দায়সহ ক্যাপটিভ খাতে ২৬ লাখ ৫৩ হাজার এবং শিল্পরানে ২ লাখ ৯৮ হাজার টাকার চাহিদাপত্র ইস্যু করা হয়। চাহিদাপত্র ইস্যুর একমাস পরে ১৭ এপ্রিল বকেয়া পরিশোধ করে জিন্স এক্সপ্রেস। তবে রহস্যজনক কারণে তারা পুনঃসংযোগের আবেদন করা থেকে বিরত থাকে।
প্রায় ৩ বছর পরে ২০২০ সালের ২২ মার্চে পুনঃসংযোগের আবেদন করে। এরপর নথি উপস্থাপন করা হয়, এতে বলা হয় গ্যাস বিপণন নীতিমালা ২০১৪ অনুযায়ী সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার পর ১ বছরের মধ্যে পুনঃসংযোগের আবেদন না করলে সংযোগটি স্থায়ীভাবে বিচ্ছিন্ন বলে বিবেচিত হবে। নীতিমালার ৮.২.১ ধারায় রয়েছে বিচ্ছিন্নকৃত গ্রাহক বিলুপ্ত গ্রাহক হিসেবে গণ্য হবেন। তবে দায় দেনা পরিশোধ সাপেক্ষে নতুন গ্রাহক হিসেবে সংযোগ দেওয়ার সুযোগ রয়েছে। বর্তমানে শিল্পে নতুন সংযোগ প্রদান চালু রয়েছে। পরিচালনা পর্ষদের অনুমোদন সাপেক্ষে নতুন সংযোগ প্রদান করা যেতে পারে।
ই-ফাইলে উপস্থাপিত নথিতে, মেসার্স জিন্স এক্সপ্রেস লিমিটেডের আউটলেট ভাল্বে স্থাপিত পেপারসিল ২টি ক্ষতিগ্রস্ত এবং সিএমএস এর ইনলেট ভাল্বে পেপারসিল না থাকার কথা উল্লেখ করা হয়। জিএম আমিনুর রহমান ফাইলটি পাওয়ার পর ই -ফাইলের পরিবর্তে হার্ড ফাইলে উপস্থাপনের নির্দেশ দিয়ে ফেরত পাঠান।
মহাব্যবস্থাপক আমিনুর রহমানের নির্দেশে এবার ফাইলটি বদলে যায়। বিপুল পরিমাণ টাকার বিনিময়ে বোর্ডের উপস্থাপন না করে নিজেই সংযোগ প্রদান করেন আমিনুর রহমান। তদন্ত কমিটি তার মতামতে উল্লেখ করেছে, নিয়ম অনুযায়ী ২০১৮ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারিতেই স্থায়ীভাবে আরএমএস অপসারণ সম্পন্ন করা উচিত ছিল। ই-নথিতে দেখা গেছে গ্রাহক ৩ বছর পর পুনঃসংযোগের আবেদন করেছেন। অন্যদিকে আউটলেট ভাল্বে স্থাপিত পেপারসিল ২টি ক্ষতিগ্রস্ত এবং সিএমএস এর ইনলেট ভাল্বে পেপারসিল না থাকায় ধারণা করা যায় গ্রাহক চুরির সঙ্গে জড়িত থাকতে পারে। মেসার্স জিন্স এক্সপ্রেস লিমিটেড আরএমএস মিটারের স্থানে শর্টপিছ লাগিয়ে অবৈধভাবে গ্যাস ব্যবহার করেছেন। পুনঃসংযোগের বিষয়ে বোর্ডে উপস্থাপন না করা, স্থায়ী বিচ্ছিন্ন না করে গ্রাহককে অবৈধভাবে গ্যাস ব্যবহারের সুযোগ সৃষ্টি করার জন্য আমিনুর রহমান দায়ী।
কেজিডিসিএল’র একাধিক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন, মূলত ওই সংযোগটি শর্টপিছ লাগিয়ে ব্যবহার করে এসেছে। আমিনুর রহমান সিন্ডিকেট বিষয়টি আগে থেকেই অবগত, যে কারণে তারা আরএমএস অপসারণ করেন নি। তারা কোম্পানির কাছ থেকে মাসোহারা নিয়ে চুপ করে ছিলেন। এ রকম অনেক ঘটনা রয়েছে কেজিডিসিএল এলাকায়। কাগজে কলমে সংযোগ নেই, তবে ঠিকই গ্যাস ব্যবহার করে যাচ্ছে। কোম্পানি বকেয়া পরিশোধ করেছে এরপর সংযোগ চাইবে, এটাই স্বাভাবিক। তা না করে ৩ বছর পরে এসেছে পুনঃসংযোগের জন্য। তারা যদি কারখানা চালু নাই করবে তাহলে ১ মাসের মধ্যে বকেয়া পরিশোধ করার কোন যুক্তি থাকতে পারে না। অধিকতর তদন্ত করলে বিষয়টি অবশ্যই বেরিয়ে আসবে। কিন্তু রাঘোব বোয়ালরা জড়িত, তাই হয়তো তদন্ত কমিটিও বিষয়েটি ভাসা ভাসা লিখে গেছে।
এ বিষয়ে কথা বলার জন্য আমিনুর রহমানকে বার্তা২৪.কমকে বলেন, আমি কোন দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত না। কেউ প্রমাণ দিতে পারলে চাকরি ছেড়ে দিবো। বকেয়ার দায়ে সংযোগ বিচ্ছিন্ন হলে আদায় সাপেক্ষে পুনঃসংযোগ প্রদান করা আমার দায়িত্ব।
তিনি বলেন, জিন্স এক্সপ্রেস লিমিটেড একটি রুগ্ন প্রতিষ্ঠান, ব্যাংকের দায় দেনার কারণে তালাবন্ধ ছিল। তারা এখনও চালু করতে পারেনি। গ্যাস ব্যবহার করার করার অভিযোগ সত্য হতে পারে না। কোম্পানি আগেই আবেদন করেছিল, ৩ বছর পরে আবেদন করার তথ্যও সঠিক নয়। কমিটি রিপোর্ট করেছে হাওয়ার উপরে। কমিটি ধারণা করবে কেনো, তারা তথ্য প্রমাণ দিয়ে কথা বলবে। কোম্পানিটি ভিজিট করলেই সব প্রমাণ পাওয়া যেতো। তদন্ত কমিটি সেখানে গেলেন না কেনো!