চার মাস গত হলেও পেট্রোলিয়াম প্রবিধানমালা সংশোধন করতে পারেনি বিইআরসি (বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন)। কমিশনের এই ঢিলেমির সুযোগে আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে দাম সমন্বয়ের ফর্মুলা নিজেরাই করছে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি)।
অথচ আন্তঃমন্ত্রণালয় সভায় (১৪ ডিসেম্বর ২০২২) সিদ্ধান্ত হয়েছিল তেলের দাম নির্ধারণ করবে বিইআরসি। ওই সভায় এক দশক ঝুলে থাকা বিইআরসির প্রবিধানমালা সংশোধন সাপেক্ষে দ্রুত অনুমোদন করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
ওই সভায় তৎকালীন জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের সিনিয়র সচিব আন্তর্জাতিক বাজারের দাম অনুসারে তেল-গ্যাসের দাম নির্ধারণের বিষয়ে অভিমত দেন। সভার কার্যপত্রে দেখা গেছে, সচিবের অভিমতের পরেই বিইআরসি কর্তৃক প্রতিমাসে এলপি গ্যাসের দর নির্ধারণের মডেলটি সামনে আনা হয়। একই মডেল অনুসারে তেল-গ্যাসের দর নির্ধারণের বিষয়ে আলোচনা হয়। সম্ভব হলে প্রতি ৩ মাস পর পর দর পুনঃনির্ধারণের বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়। এ জন্য খসড়া প্রবিধানমালাগুলো পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরা হয়।
বিইআরসি আইন অনুযায়ী সকল ধরণের জ্বালানির দাম নির্ধারণ করার কথা বিইআরসির। বিদ্যুৎ ও গ্যাসের ক্ষেত্রে দাম নির্ধারণ করলেও পেট্রোলিয়াম বিধিমালা চূড়ান্ত না হওয়ায় নির্বাহী আদেশে দাম নির্ধারিত হয়ে আসছে। বিইআরসি পেট্রোলিয়ামজাত পদার্থের খুচরা ট্যারিফ প্রবিধানমালা, ২০১২, পেট্রোলিয়ামজাত পদার্থ মজুদকরণ বিপণন ও বিতরণ প্রবিধানমালা, ২০১২, এবং পেট্রোলিয়ামজাত পদার্থ পরিবহন ট্যারিফ প্রবিধানমালা ২০১২ অনুমোদন জমা দিলেও এক দশক ধরে ঝুলে রাখে মন্ত্রণালয়। আন্তঃমন্ত্রণালয় সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী প্রবিধানমালা সংশোধনীসহ উত্থাপনের জন্য বিইআরসিতে ফেরত পাঠানো হয় গত জানুয়ারি মাসে।
বিইআরসিতে যখন প্রেরণ করা হয়, তখন আব্দুল জলিল কমিশনের মেয়াদ শেষ দিকে। জলিল কমিশন কাজটিতে হাত না দিয়ে নতুন কমিশনের জন্য রেখে দেয়। নতুন কমিশন এলেও তাতে খুব একটা মনযোগ দেখা যাচ্ছে না। অনেকটা হিমঘরে পড়ে রয়েছে প্রবিধানমালা। কমিশন সূত্র জানিয়েছে, উপ-পরিচালক (ট্যারিফ) কামরুজ্জামানকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, তিনি এখনও খসড়া রেডি করতে পারেননি।
বিইআরসির বিলম্বের সুযোগ নিয়ে বিপিসির তৎপরতা প্রসঙ্গে বিইআরসির সদস্য (প্রশাসন, অর্থ ও আইন) ড. মুহাম্মদ ইয়ামিন চৌধুরীর দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়। তিনি বার্তা২৪.কমকে বলেন, দর যে কোন প্রতিষ্ঠান করলেই চলে। এখানে বিপিসি করলো নাকি আমরা করলাম সেটি বড় বিষয় নয়।
বিইআরসির চেয়ারম্যান মো. নুরুল আমিন বার্তা২৪.কম-কে বলেছেন, আমি যোগদান করার পর মন্ত্রণালয়ের কার্যপত্রের আলোকে প্রবিধানমালা প্রস্তুত করার নির্দেশ দিয়েছি। কিন্তু এখন পর্যন্ত উপস্থাপন করা হয়নি। কবে নাগাদ চূড়ান্ত হতে পারে এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমরা মে মাসের মধ্যেই মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করতে চাই।
জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ সূত্র জানিয়েছে, আগামী সেপ্টেম্বর মাস থেকে আন্তর্জাতিক বাজার দরে জ্বালানি তেল বেচা-কেনা হবে। আন্তর্জাতিক বাজারে বেড়ে গেলে বাড়বে, আর কমে গেলে কমবে। দুই অথবা তিন মাস পর পর সমন্বয় করা হবে। বিষয়টি শুধু এখন সরকারের বিষয়, আইএমএফ’র ঋণের শর্তের মধ্যে রয়েছে ভর্তুকি প্রত্যাহার করার বিষয়টি তাই সরকার বেশ তৎপর রয়েছে।
তেলের দামের বিষয়টি নিয়ে বিইআরসি ও বিপিসির মধ্যে প্রথম থেকেই রশি টানাটানি রয়েছে। বিপিসি তথা মন্ত্রণালয় বিষয়টি হাতছাড়া করতে চায় না। যে কারণে প্রবিধানমালা ঝুলে রাখা হয়। এখন যখন সুযোগ সামনে চলে এসেছে বিইআরসির ঢিলেমির কারণে হাতছাড়া হতে যাচ্ছে।
ক্যাবের জ্বালানি বিষয়ক উপদেষ্টা সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান ড. শামসুল আলম বার্তা২৪.কমকে বলেন, প্রবিধানমালা ঝুলে রেখে এতোদিন বেআইনিভাবে তেলের দাম নির্ধারণ করেছে বিপিসি ও মন্ত্রণালয়। তারা এখনও সেটা ধরে রাখতে চায়। আর বিইআরসিতে যাদের দেওয়া হয়েছে তারা আইনি দায়িত্ব পালন করবে না। করতে চায় না, সরকারের আজ্ঞাবহ হয়ে কাজ করছে। জনস্বার্থকে খর্ব করা হচ্ছে, অসাধু ব্যবসায়ীদের স্বার্থ দেখছে, কোন কিছুই মানদণ্ড অনুযায়ী চলছে না। সরকার কোম্পানিগুলো থেকে ডিভিডেন্ট নেয়।
বিইআরসির একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বার্তা২৪.কম-কে বলেছেন, প্রবিধানমালা বেশি সংশোধনের প্রয়োজনীয় নেই। যেটুকু করার কথা, এটা মন্ত্রণালয়েই করতে পারতো, এখানে শুধু দুই কিংবা ৩ মাস পর পর দাম সমন্বয় করা যাবে এই একটি লাইন যুক্ত করলেই চলে। মুলত ২০১২ সালে জমা দেওয়া প্রবিধানমালা সামনে এলে মন্ত্রণালয় বিব্রত হবে তাই এই নাটকীয়তা।
গত জানুয়ারি মাসে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব খালেক মল্লিক বার্তা২৪.কমকে বলেছিলেন, বিইআরসির প্রবিধানমালায় কিছুটা সংযোজনী আনার সিদ্ধান্ত হয়েছে। জ্বালানি তেলের দামও বিইআরসি নির্ধারণ করবে। সেই আলোকে খসড়া প্রবিধানমালা সংশোধন করার সিদ্ধান্ত হয়েছে সভায়।
বিইআরসি প্রতিমাসে এলপিজির দর নির্ধারণ করে আসছে। গণশুনানির মাধ্যমে আমদানিকারকদের খরচ ও কমিশন চূড়ান্ত করা হয়েছে। এখন প্রতিমাসে শুধু গ্যাসের দর অংশ ওঠানামা করে। অর্থাৎ আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বেড়ে গেলে পণ্যমূল্য বেড়ে যায়, কমে গেলে সেই অংশটুকু কমে যায়। ডিজেল পেট্রোলের ক্ষেত্রেও এমন পদ্ধতি অনুসরণের কথা ভাবা হচ্ছে। জাহাজ ভাড়াসহ পরিচালন খরচ এবং আমদানি ব্যয় আলাদা করা হবে। পরিচালন খরচ অপরিবর্তিত থাকবে আর, ৩ মাস পর আন্তর্জাতিক বাজারের দরের সঙ্গে কমবেশি হবে দেশের জ্বালানি তেলের বাজারদর। বিইআরসি যাতে আইনি কাঠামোর মধ্যে থেকে কাজটি করতে পারে, সেজন্য ঝুলে থাকা বিইআরসি প্রবিধানমালার সংশোধনীসহ চূড়ান্ত করার সিদ্ধান্ত হয়েছে।
বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেছেন, আমরা জ্বালানি তেলের বাজার উন্মুক্ত করার কথা চিন্তা করছি। সরকারি কোম্পানির পাশাপাশি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানও থাকতে পারে। একটি পদ্ধতি বের করার চেষ্টা হচ্ছে, আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়লে দেশেও বাড়বে, আর কমে গেলে দেশেও কমে যাবে। সরকার জ্বালানি তেলে আর ভর্তুকি দিতে চায় না।
বিপিসির তথ্য অনুযায়ী, ২০২০-২১ অর্থ বছরে দেশে জ্বালানি তেলের চাহিদা ছিল ৬২ লাখ ৯৯ হাজার ৭৩০ মেট্টিক টন। খাত ভিত্তিক সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয়েছে পরিবহন খাতে, ওই অর্থ বছরে ৬২.৯২ শতাংশ সমান ৩৯ লাখ ৬৩ হাজার ৭২৫ মেট্টিক টন ব্যবহৃত হয়েছে। এরপরেই রয়েছে কৃষি খাতে ৯ লাখ ৭৫ হাজার ৬০৪ মেট্টিক টন, বিদ্যুৎ খাতে চাহিদা ছিল ৬ লাখ ৫২ হাজার ৬৬ মেট্টিক টন। শিল্পে ৪ লাখ ৫০ হাজার ৪৩৭ মেট্টিক টন. গৃহস্থালীতে ৯৭ হাজার ৬০০ টন এবং অন্যান্য খাতে ১ লাখ ৬০ হাজার ২৯৮ মেট্টিক টন।