ঋণ খেলাপি-কর খেলাপি ও দেশ থেকে টাকা পাচারকারীদের আইনের প্রাতিষ্ঠানিক আওতায় নিয়ে একটা সিগন্যাল দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও বেসরকারি খাতের গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেছেন, অর্থনীতি যখন চাপের মধ্যে তখন এসব খেলাপিদের বিরুদ্ধে শূন্যসহিষ্ণুতা প্রয়োগের এখনই সময়।
বার্তা২৪.কম-কে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে এই মন্তব্য করেছেন তিনি। কথা বলেছেন পরিকল্পনা সম্পাদক আশরাফুল ইসলাম।
বার্তা২৪.কম: সার্বিকভাবে দেশের অর্থনীতির গতি-প্রকৃতি কোন দিকে যাচ্ছে?
অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান: অবশ্যই সামষ্টিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা একটা ঝুঁকির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। একটা অনিশ্চয়তার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশের বিভিন্ন আর্থসামাজিক সূচক আছে, সেসবের মধ্যে তার একটা প্রতিফলন আমরা দেখছি। সেটা আমাদের মূল্যস্ফীতি, রিজার্ভের সিচুয়েশনস, টাকার মূল্যমানের প্রবণতা, বিদেশি বিনিয়োগ, ঋণ প্রবাহ কিংবা রিজার্ভের কারণে আমদানি ও রফতানির ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা; সামষ্টিক অর্থনৈতিক পরিচালনার ক্ষেত্রে অক্টোবরে তো নেগেটিভ হয়ে গেছে, নভেম্বরেও সুবিধার না। সব ধরনের সূচকই একটা চাপের মধ্যে আছে। সুতরাং সেদিক থেকে অবশ্যই এসবের অভিঘাত পড়ছে জীবনযাত্রার মান, কর্মসংস্থান, প্রবৃদ্ধি-এগুলোর উপরে তার একটা নেতিবাচক প্রভাব তো পড়ছেই। সুতরাং সামষ্টিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা একটা ঝুঁকির মধ্যে আছে।
বার্তা২৪.কম: বিদ্যমান পরিস্থিতিতে আর্থিক খাতের অংশীজন ও সরকার কিংবা সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগকে আপনি কিভাবে দেখেন-
অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান: কিছু কিছৃ পদক্ষেপ তারা নিচ্ছে। প্রথম কথা হলো সংকটের কারণটাকে যদি কেবলমাত্র কোভিড পরবর্তী উত্তরণ এবং ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বলা হয় যে এটি বাহির থেকে আসছে আমার মনে হয়; তাহলে সম্পূর্ণ গল্পটা বলা হবে না। আমাদের নিজেদের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার দুর্বলতার কারণে এই বাইরের ফ্যাক্টরগুলি আরও জেঁকে বসেছে। আমরা অনেকদিন ধরে বলছি, আমাদের টাকা অতিমূল্যায়িত আছে, এটাকে গ্রাজুয়্যাললি অবমূল্যায়িত করেন; তখন বলা হলো-মূল্যস্ফীতির চাপ বাড়বে। আমরা বললাম যে আমাদের রেমিটেন্স এবং রফতানি সক্ষমতা বাড়বে, প্রতিযোগিতার সক্ষমতা এবং তার ফলে এটা অর্থনীতির জন্য ভালো হবে। আমদানিকৃত মূল্যস্ফীতিকে আমাদের বাজার ব্যবস্থাপনা, শুল্ক ব্যবস্থাপনা ইত্যাদি দিয়ে সামাল দিতে হবে। কিন্তু ইতিমধ্যে আমরা অনেক বিলম্ব করেছি, ডলারের দাম ৮৬ টাকা অনেক দিন ধরে রেখেছি, এরপর এক লাফে এখানে ১১০-১১১ টাকা হয়েছে, যখন নাকি আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বেড়েছে। মূল্যস্ফীতি শেষ পর্যন্ত বাড়লই। এসব বিষয়গুলি যেমন আছে-তেমনি দেশ থেকে অনেক টাকা বিদেশে চলে যাচ্ছে; আমরা বলছি অনেকদিন ধরে, বিভিন্ন প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা দিয়ে এগুলো মোকাবেলা করুন। বাজারের মধ্যে একধরণের একচেটিয়াকরণ হচ্ছে-এগুলোকে মোকাবেলা করুন। বাজার ব্যবস্থাপনা, সুশাসন, সাশ্রয়ীভাবে সময়মতো প্রকল্প বাস্তবায়ন- এগুলোর ক্ষেত্রে আমাদের বিভিন্ন ধরণের দুর্বলতার কারণে আমরা ঝামেলার মধ্যে পড়ে গেছি। ঝুঁকির মধ্যে পড়ে গেছি, অনিশ্চয়তায় পড়ে গেছি। যেহেতু আমাদের সমস্যাটা ভেতরে, সেহেতু সমাধানটাও ভেতরেই খুঁজতে হবে-সেটাই হলো এখন মূল উদ্দেশ্য। এখন বাইরে জ্বালনি আর চিনি ছাড়া সবকিছুর দাম কমেছে। অভ্যন্তরীণ বাজারে তো বাড়ছেই। ইনফ্লেশন কমার তো কোনো লক্ষণ নেই। আর এখন ইনফ্লেশন যদি কিছু কমেও সেটি উপরের স্তরে; ১০০ টাকারটা ১০ শতাংশ বেড়ে ১১০ হয়েছে, তারপরে ইনফ্লয়েশন ১০ শতাংশ থেকে ৮ শতাংশ কমলো তার মানে ১১০ টাকারটা ১৮ হলো, তাতে তো আমার কোনো স্বস্তি নেই, ভিত্তি অলরেডি উপরে উঠে গেছে। সুতরাং এইখানে আমাদের এখন চেষ্টা করতে হবে যাতে ব্যালেন্স অব পেমেন্টটা আরেকটু বেটার করা যায়। রেমিট্যান্স ইনফরমাল চ্যানেলে চলে গেছে। একে ফরমাল চ্যানেলে আনতে হবে। ঋণ খেলাপি, কর খেলাপি, দেশ থেকে টাকা পাচারকারী-এদের সবাইকে আইনের প্রাতিষ্ঠানিক আওতায় নিয়ে একটা সিগন্যাল দেওয়ার সময় আসছে। শূন্য সহিষ্ণুতার কথা আমরা বলি, এই শূন্য সহিষ্ণুতা প্রয়োগের এখনই সময়, অর্থনীতি যখন একটা চাপের মধ্যে আছে। সবদিক থেকে আমার মনে হয়, অর্থনৈতিক চাপের উৎকর্ষতা, সুশাসন, শূন্য সহিষ্ণুতা, ঋণখেলাপি, করখেলাপি, হুন্ডি চ্যানেল নিয়ন্ত্রণ জরুরি হয়ে দেখা দিয়েছে, যাতে করে অনিশ্চয়তা কাটিয়ে বিনিয়োগ তার আগের জায়গায আসে। বিদেশি বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে আমাদের বিনিয়োগকারীরাও যাতে উৎসাহ পায় । একটা পেইনপুল প্রসেসের মধ্যে দিয়ে যেতে হবে আরেকটা ভারসাম্যে আসতে হলে। প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা প্রয়োগ করে আমাদের সংস্কার করা দরকার, বাংলাদেশব্যাংকের ফিন্যান্সিয়াল ইউনিটগুলোর মাধ্যমে বিদ্যমান যেসব আইন আছে তা প্রয়োগের মাধ্যমে স্বাধীনভাবে কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে। বিশেষ করে ভোক্তা অধিদপ্তর, কমপিটিশন অধিদপ্তর স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারলে পেইনপুল প্রসেসের মধ্য দিয়ে আমরা আরেকটা ভারসাম্যে পৌঁছে যাবো।
বার্তা২৪.কম: স্ব-শাসিত প্রতিষ্ঠান হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংক সক্ষমতার জায়গাটি কতটা দেখাতে পারছেন?
অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান: বাংলাদেশ ব্যাংক বেশ কিছু পদক্ষেপ নিচ্ছে রাইট ডাইরেকশনে-তা অস্বীকার করার উপায় নেই। কিন্তু আমরা দেখেছি ধারাবাহিকভাবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উপরে বিভিন্নভাবে (তাদের) স্বাধীনতা খর্ব করা হয়েছে, তাদের দিয়ে বিভিন্ন কাজ করানো হয়েছে। নতুন আইন পাস হলো পার্লামেন্টের শেষ মূহুর্তে, তাতে দেখলাম পরিচালক পদে নয় বছরের জায়গায় ১২ বছর থাকার সুযোগ রাখা হয়েছে। সেন্ট্রাল ব্যাংককে তো স্বাধীনভাবে কাজ করতে দিতে হবে । মুদ্রানীতি, মূল্যস্ফীতি নীতির জন্য যেটা করার দরকার, বিশেষ করে ঋণখেলাপির বিরুদ্ধে-এসবের বিরুদ্ধে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দিতে হবে। কিছু দরকারি পদক্ষেপ তারা নিচ্ছেন কিন্তু সেটা আরও শক্তিশালী করতে হবে। রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকেও বুঝতে হবে যে স্বাধীনভাবে যেসব সংস্থাকে কাজ করতে দিলে সেখানে তার জন্য ভালো হবে। তাদের নিজেদের স্বার্থে এটা করা উচিত। কারণ যদি ন্যায্যতার ভিত্তিতে আমরা যদি অন্তর্ভূক্তিমূলক উন্নয়ন করতে চাই তাহলে বিভিন্ন সংস্থাগুলোকে স্বাধীনভাবে নিজ নিজ কর্তব্য পালন করতে দিতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংক কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে সেগুলো ভালো কিন্তু আমার মনে হয় আরও একটু দ্রুততার সঙ্গে নিতে হবে। এক্সচেঞ্জ রেট-ইন্টারেস্ট রেটকে দ্রুততার সঙ্গে সমন্বয় করতে হবে।
বার্তা২৪.কম: আমরা জ্ঞান ও তথ্য ভিত্তিক সমাজের কথা বলি সেখানে অর্থনীতির সংকট নিয়ে যেসব গণমূখি গবেষণা হয়, সেসব গবেষণাকে সরকার বা সংশ্লিষ্টরা কতখানি অগ্রাধিকার দেন-
অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান: আমার মনে হয়, বাংলাদেশের অর্থনীতি ৪৬০ বিলিয়ন ডলারের অর্থনীতি এটা পারচেজিং পাওয়ার প্যারিটিতে ১ ট্রিলিয়ন ডলারের অর্থনীতি হয়ে গেছে-ক্রয় ক্ষমতার নিরিখে; এরকম একটা অর্থনীতি চালাতে গেলে অবশ্যই একটা জ্ঞানভিত্তিক ব্যবস্থাপনার প্রয়োজন। কিন্তু সেখানে আমার মনে হয় না সেটার অনুধাবনটা আছে। অনেকক্ষেত্রে দেখা যায় যে, জ্ঞানভিত্তিক কথাবার্তা বললে আবার অনেকের পছন্দ হয় না। যারা এগুলো নিয়ে চর্চা করেন, যাদের বুদ্ধিমত্তা-মেধা আছে সেটা দিয়ে তারা পরামর্শ দেওয়ার চেষ্টা করেন কিন্তু দেখা যায় এসব পরামর্শকে অনেক সময় নেতিবাচকভাবে নেওয়া হয়। আমার মনে হয় এটা ভালো কোনো লক্ষণ না। সমাজের যত জ্ঞানভিত্তিক আলাপ-আলোচনা হবে, শেষ পর্যন্ত রাজনৈতিক ব্যক্তিরাই সিদ্ধান্তটা গ্রহণ করবেন; সেটা তো তাদের ম্যান্ডেট, কিন্তু গঠনমূলক আলোচনা-সমালোচনার স্পেস থাকতে হবে। তখন সেখান থেকে তারা বেছে নিতে পারবেন, কোনটা তাদের জন্য সবচেয়ে ভালো। কা্রণ রাজনৈতিক বিচার বিবেচনা করেই তাদের সিদ্ধান্ত নিতে হয়, সেটা কি আমরা বুঝি না? কিন্তু গঠনমূল সমালোচনার প্রতিও শ্রদ্ধা থাকা উচিত বলে আমার মনে হয়।