গ্যাসের দাম আড়াই গুণ বৃদ্ধি: যেসব সংকটের শঙ্কা উদ্যোক্তাদের

  • নিউজ ডেস্ক, বার্তা২৪.কম
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

গ্যাসের দাম আড়াই গুণ বৃদ্ধি, ছবি: বার্তা২৪.কম

গ্যাসের দাম আড়াই গুণ বৃদ্ধি, ছবি: বার্তা২৪.কম

এক ধাপে শিল্পে গ্যাসের দাম ১৫২ শতাংশ বা আড়াই গুণ বৃদ্ধির সরকারি নীতিগত সিদ্ধান্তকে দেশের উৎপাদন বন্ধের পদক্ষেপ বলেই মনে করছেন উদ্যোক্তারা। নানামুখি সংকটে আবর্তিত হওয়া দেশের শিল্প খাতে এ ধরণের পদক্ষেপ আত্মঘাতী বলেই বর্ণনা করছেন তারা।

পেট্রোবাংলার বিরুদ্ধে গ্যাসের লিকেজ ও বিপুল পরিমাণ অবৈধ সংযোগের মাধ্যমে বিদ্যমান সিস্টেম লস কমিয়ে ভর্তুকি সমন্বয়ের দিকে না গিয়ে আড়াই গুণ মূল্যবৃদ্ধি কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য নয় বলেও মনে করেন এখাতের বিশেষজ্ঞরা।

দীর্ঘদিন ধরে ডলার সংকট, সুদের উচ্চহার এবং শ্রমিক অসন্তোষসহ বিভিন্ন কারণে অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে শিল্পমালিকরা কঠিন সময় পার করছেন। শিল্পে গ্যাসের দাম নতুন করে ১৫২ শতাংশ বা আড়াই গুণ পর্যন্ত বৃদ্ধির উদ্যোগ যেন ‘মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা’।

বিজ্ঞাপন

শিল্পমালিকদের অভিযোগ, তাঁরা বাড়তি দাম দিয়েও কারখানায় নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস পাচ্ছেন না। এ অবস্থায় নতুন করে আবারও গ্যাসের দাম বৃদ্ধির সিদ্ধান্তে অনেকে ব্যবসা গুটিয়ে নেওয়ার চিন্তাও করছেন। কেউ কেউ বলছেন, শিল্প স্থাপন করে বিপদে পড়ার চেয়ে ট্রেডিং ব্যবসা অনেক ভালো।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জ্বালানি খাতে এত উচ্চমূল্যে নতুন শিল্পোদ্যোক্তারা বাজারে রপ্তানি করতে পারবেন কি না তা দেখার বিষয়। এটা নতুনদের জন্য চ্যালেঞ্জ।

বিজ্ঞাপন

শিল্পোদ্যোক্তানা বলছেন, যে মাত্রায় শিল্পে এবার গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাব করা হয়েছে তার ফলে মূল্যস্ফীতির যে চাপ তা আরও বাড়বে। শিল্প খাতে কোনো উদ্যোক্তা নতুন করে গ্যাস সংযোগ নিয়ে কারখানা স্থাপনের কথা চিন্তা করবেন না। এ অবস্থায় শিল্প টিকিয়ে রাখার প্রশ্নই আসে না। নতুন উদ্যোক্তারা কোনোভাবে প্রতিযোগিতার বাজারে টিকে থাকতে পারবেন না। এতে অবশ্যই শিল্পে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।

গ্যাসের দাম বৃদ্ধি করার প্রস্তাব নীতিনির্ধারকদের বাংলাদেশে আগামীতে উৎপাদন খাতকে টিকিয়ে না রাখার দৃষ্টিভঙ্গি বলেই বিবেচিত হবে, মনে করেন উদ্যোক্তারা।

তারা জানান, যদি নতুন করে আবার গ্যাসের দাম বৃদ্ধি করা হয় তাহলে গ্যাসনির্ভর কারখানাগুলো বন্ধ করে দিতে হবে। ব্যাংক ঋণ এখন সাড়ে ১৪ থেকে ১৬ শতাংশ হয়েছে। গ্যাসের দাম আবার বাড়ালে শিল্প খাত ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে চলে যাবে। শিল্প খাতের লাখ লাখ শ্রমিক বেকার হয়ে পড়বেন।

বর্তমানে শিল্পকারখানার গ্রাহকদের প্রতি ঘনমিটার গ্যাস কিনতে ৩০ টাকা এবং ক্যাপটিভ পাওয়ারে (শিল্পে ব্যবহৃত নিজস্ব বিদ্যুৎ) ৩০ টাকা ৭৫ পয়সা দিতে হয়। সম্প্রতি বিইআরসিতে বাংলাদেশ তেল, গ্যাস, খনিজ সম্পদ করপোরেশন (পেট্রোবাংলা)-এর পাঠানো প্রস্তাবে প্রতি ঘনমিটার গ্যাসের দাম ৭৫ টাকা ৭২ পয়সা করার প্রস্তাব করা হয়েছে। এর মধ্যে নতুন সংযোগের ক্ষেত্রে পুরো গ্যাস বিল হবে নতুন দামে। তবে প্রস্তাবে পুরনো শিল্পোদ্যোক্তারা কিছুটা ছাড় পাবেন।

বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিকেএমইএ) সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম একটি জাতীয় দৈনিককে বলেন, নতুন যে পলিসি সরকার করতে যাচ্ছে এতটুকু বলতে পারি যে, আমাদের খাতে কোনো উদ্যোক্তা নতুন করে গ্যাস সংযোগ নিয়ে কারখানা স্থাপনের কথা চিন্তা করবে না। আমাদের এখন যে ৩০/৩১ টাকা গ্যাস বিল দিতে হয় এটিই আমাদের দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। এক্ষেত্রে এই দাম ৭০/৭৫ টাকা হলে শিল্প টিকিয়ে রাখার প্রশ্নই আসে না। এতে অবশ্যই শিল্পে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।

অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন এ বিষয়ে গণমাধ্যমকে বলেছেন, গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাব বাস্তবায়ন করা হলে উৎপাদন খরচের ওপর অবশ্যই ধাক্কা আসবে। এর ফলে মূল্যস্ফীতির যে চাপ তা আরও বাড়বে। এটি অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। তিনি বলেন, ‘পেট্রোবাংলার বিরুদ্ধে গ্যাসের লিকেজ থেকে শুরু করে অনেক অভিযোগ আছে। অবৈধভাবে গ্যাস সংযোগও দেওয়া হয়। এর বিল তো সরকার পাচ্ছে না।’

এসব জায়গায় প্রতিষ্ঠানগুলির জবাবদিহিতা নিশ্চিত না করে মূল্যবৃদ্ধি সমর্থনযোগ্য নয় বলেও মনে করেন তিনি।

জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ম. তামিম বলেন, গ্যাসের দাম বাড়ানো নিশ্চিতভাবে গ্যাসভিত্তিক নতুন শিল্পোদ্যোক্তাদের অন্তরায় হবে। নতুন উদ্যোক্তারা কোনোভাবে প্রতিযোগিতার বাজারে টিকে থাকতে পারবে না।

এর আগে ২০২৩ সালের ১৮ জানুয়ারি নির্বাহী আদেশে শিল্পে গ্যাসের দাম বাড়িয়ে তিন গুণ করা হয়। প্রতি ইউনিট গ্যাসের দাম বৃহৎ শিল্পে ১১ টাকা ৯৮ পয়সা এবং ক্ষুদ্র শিল্পে ১০ টাকা ৭৮ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৩০ টাকা করা হয়। ক্যাপটিভে প্রতি ইউনিটে ১৬ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৩০ টাকা করা হয়েছিল। এরপর ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে ক্যাপটিভে প্রতি ইউনিটের দাম ৩০ টাকা ৭৫ পয়সা নির্ধারণ করা হয়।

তবে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান গ্যাসের দাম বৃদ্ধি যৌক্তিকতা তুলে ধরে সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘৭৫ টাকা করে গ্যাস কিনে ৩০ টাকায় দেওয়া সম্ভব নয়। আমাদের এরই মধ্যে ২০ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দিতে হচ্ছে। এটি আর বাড়াতে চাই না।’