বেনাপোলে পচনশীল পণ্য খালাস বন্ধে রাজস্ব বঞ্চিত ৫০ কোটি টাকা

, অর্থনীতি

সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, বেনাপোল (যশোর) | 2024-06-30 13:11:15

আমদানি করা মাছ, ফল ও সবজি জাতীয় পণ্যে যুক্ত করা অতিরিক্ত শুল্ক প্রত্যাহার না করায় বেনাপোল ও ভারতের পেট্রাপোল বন্দরে তিনদিন ধরে পণ্য নিয়ে শতাধিত ট্রাক দাঁড়িয়ে রয়েছে।

এই আটকে থাকা পণ্যে ব্যবসায়ীদের লোকসান হয়েছে, প্রায় ১০ কোটি টাকা। অন্যদিকে, পণ্য খালাস বন্ধ থাকায় সরকার রাজস্ব বঞ্চিত হয়েছে, ৫০ কোটি টাকার মতো।

এদিকে, প্রচণ্ড গরমে পচে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, আটকে থাকা মাছ, টমেটো, আদা, রসুন, কাঁচা মরিচ, আপেল, আনারসহ বিভিন্ন ধরনের পচনশীল পণ্য।

তবে খাদ্য পণ্য খালাস বন্ধ থাকলেও অনান্য পণ্যের আমদানি, রফতানি ও খালাস কার্যক্রম স্বাভাবিক রয়েছে।

পচনশীল খাদ্যদ্রব্য আমদানিতে শুল্ক পরিশোধের ক্ষেত্রে এনবিআরের (জাতীয় রাজস্ব বোর্ড) নতুন নীতিমালায় পণ্যবাহী ট্রাকের চাকা অনুপাতে আমদানি পণ্যের শুল্কায়ন নির্ধারণের প্রতিবাদে বৃহস্পতিবার (২৭ জুন) থেকে পণ্য খালাস বন্ধ রেখেছেন আমদানিকারকেরা।

এনবিআরের নতুন নির্দেশনায়, আমদানি কমে যাওয়া ও বাজার ঊর্ধ্বমুখী হওয়ার আশঙ্কা করছেন ব্যবসায়ীরা। ক্ষোভ জানিয়ে আইন বাতিলের দাবিতে ইতোমধ্যে বিক্ষোভ করেছেন তারা। তবে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ বলছে, এনিবিআরের আদেশ তারা পালন করছেন।

বন্দর সূত্রে জানা যায়, বেনাপোল বন্দর দিয়ে ভারত থেকে যেসব পণ্য আমদানি হয়, তার বড় একটি অংশ ফল, মাছ ও সবজি জাতীয় পণ্য।

সাধারণত, পণ্যের পরিমাপ ও সংখ্যার ওপর ভিত্তি করে আমদানি শুল্ককর আদায় করা হয়ে থাকে। কিন্তু এনবিআর ফল, সবজি ও মাছের ক্ষেত্রে কত চাকার ট্রাকের পণ্য আসছে, তার ওপর ভিত্তি করে পণ্যের শুল্ককর আদায় করে থাকে।

গত ২৩ জুন আবার নতুন করে ট্রাকের চাকা অনুপাতে পণ্যের ওজন বাড়িয়ে শুল্ককর নির্ধারণ করে চিঠি দেয় এনবিআর। এতে প্রতি ট্রাকে অতিরিক্ত ৩ থেকে ৪ লাখ টাকা গুনতে হচ্ছে। এতে লোকসানে পড়ে পণ্য খালাস বন্ধ রাখা হয়েছে। এছাড়া নতুন করে চাপিয়ে দেওয়া শুল্ককর প্রত্যাহারের দাবিতে কাস্টমস অফিসের সামনে বিক্ষোভ করেছেন পণ্য আমদানিকারকেরা। কোনো সমাধান না হওয়ায় পণ্য চালান আটকে গরমে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।

ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, এনিয়মে পণ্য আমদানি যেমন কমবে, তেমনি সরকারও রাজস্ব হারাবে।

এ বিষয়ে আমদানি, রফতানি সমিতির সহসভাপতি আমিনুল হক বার্তা২৪.কমকে বলেন, প্রতিদিন বেনাপোল বন্দর দিয়ে ভারত থেকে শতাধিক ট্রাক মাছ, ফল ও সবজি জাতীয় পণ্য আমদানি হয়। খালাস বন্ধ থাকায় ৩ দিনে সরকারের ৫০ কোটি টাকা রাজস্ব আয় কমেছে।

আমদানি রফতানি সমিতির সেক্রেটারি জিয়াউর রহমান বলেন, কাস্টমস শুল্ককর বৃদ্ধির আগে তাদের ১২ চাকার এক ট্রাক হিমায়িত মাছে ৬ লাখ ১২ হাজার টাকা শুল্ক পরিশোধ করতে হতো। এখন নতুন নিয়মে তাদের অতিরিক্ত দেড় লাখ টাকা গুনতে হবে। এছাড়া ফলের ট্রাকে বেশি গুনতে হবে ৩ থেকে ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত, যা বাণিজ্যে বড় ধরনের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবে।

বন্দরে মাছ নিয়ে আটকে থাকা ট্রাকচালক মহিদুর রহমান জানান, কাস্টমস ছাড়পত্র না দেওয়ায় ৩ দিন আটকে থেকে ট্রাকের পণ্য নষ্ট হচ্ছে। একই কথা জানিয়েছেন, সবজি বহনকারী ভারতীয় ট্রাকচালক উত্তমও।

আমদানি, রফতানিকারক উজ্বল বিশ্বাস বলেন, এনবিআর নির্দেশনায় বলেছে, কোনো পণ্যবাহী ট্রাকে পণ্যের ওজন কমবেশি হলে তা শতভাগ ওজন করে খালাস দেওয়া যাবে। তবে কাস্টমস এনবিআরের ৪ নম্বর নির্দেশনা মানছে না। ফলে, পণ্য খালাস নেওয়া কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে।

তিনদিন ধরে বেনাপোল বন্দরে আটকা রয়েছে পচনশীল পণ্যবাহী ট্রাক, ছবি- বার্তা২৪.কম

আমদানিকারক আবুল হোসেন বলেন, এনবিআরের নতুন নিয়মে পণ্যের শুল্কায়ন হলে যেমন আমদানি কমে যাবে, তেমনি ফল, মাছ ও সবজির বাজার চড়া হবে। ৩ দিন পণ্য খালাস বন্ধ থাকায় কেবল ব্যবসায়ীরাই ক্ষতির মুখে পড়েননি, এতে আমদানি কমায় সরকারও রাজস্ব হারাচ্ছে।

ভারতের পেট্রাপোল বন্দরের আমদানি, রফতানিকারক রেজাউল বিশ্বাস বলেন, বাংলাদেশ কাস্টমস পচনশীল খাদ্যদ্রব্য আমদানিতে নতুন করে শুল্ক বৃদ্ধি করায় তার প্রভাব পড়েছে ভারতীয় ব্যবসায়ীদের মধ্যেও।

গত ৩ দিনে কোনো সমাধান না আসায় পণ্যবাহী অনেক ট্রাক খালাসের অপেক্ষায় পেট্রাপোল বন্দরে দাঁড়িয়ে আছে। এতে দুই দেশের ব্যবসায়ীদের আটকে থাকা ট্রাকের ভাড়াসহ অন্যান্য খরচ বাবদ প্রায় ১০ কোটি টাকা ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে।

বেনাপোল কাস্টমস হাউসের রাজস্ব কর্মকর্তা জাহিদ হাসান বলেন, নতুন নিয়মে পণ্য খালাস নিতে বাধা নেই। তবে কিছু কিছু আমদানিকারক শুল্ক বৃদ্ধির কারণে পণ্য খালাস নিচ্ছেন না। তাদের দাবির বিষয়ে কাস্টমসের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ বিষয়টি দেখছেন বলে জানান তিনি।

এনবিআরের নির্দেশনা পত্রে বলা হয়েছে, ৬ চাকার ট্রাকে কমলা, মাল্টা ও কেনুর জন্য বাধ্যতামূলক ১৮ টনের শুল্ককর দিতে হবে। ১০ চাকার ট্রাকের থাকা পণ্যের ২০ টনের শুল্ককর দিতে হবে। ১২ চাকার ট্রাকে থাকা পণ্যের জন্য ২২ টনের ডিউটি দিতে হবে। ১৪ চাকার ক্ষেত্রে ২৫ টনে ডিউটি এবং ১৬ বা তার বেশি চাকার গাড়িতে থাকা পণ্যের ২৬ টনের শুল্ককর দিতে হবে।

এছাড়া, ৬ চাকার ট্রাকে থাকা আঙুরের জন্য ১৯ টনের শুল্ককর দিতে হবে। ১০ চাকার ট্রাকের থাকা পণ্যের ২০ টনের শুল্ককর দিতে হবে। ১২ চাকার ট্রাকে থাকা পণ্যের জন্য ২২ টনের ডিউটি। ১৪ চাকার ক্ষেত্রে ২৪ টনের ডিউটি এবং ১৬ বা তার বেশি চাকার গাড়িতে থাকা পণ্যের ২৬ টনের শুল্ককর দিতে হবে।

৬ চাকার ট্রাকে থাকা আনারের জন্য ২৩ টনের শুল্ককর দিতে হবে। ১০ চাকার ট্রাকের থাকা পণ্যের ২৬ টনের শুল্ককর দিতে হবে। ১২ চাকার ট্রাকে থাকা পণ্যের জন্য ২৭ টনের ডিউটি দিতে হবে। ১৪ চাকার ক্ষেত্রে ২৮ টনের ডিউটি এবং ১৬ বা তার বেশি চাকার গাড়িতে থাকা পণ্যের ২৯ টনের শুল্ককর দিতে হবে।

৬ চাকার ট্রাকে থাকা আপেলের জন্য ২১ টনের শুল্ককর, ১০ চাকার ট্রাকের ২২ টনের শুল্ককর, ১২ চাকার ট্রাকে থাকা পণ্যের জন্য ২৩ টনের ডিউটি দিতে হবে। ১৪ চাকার ক্ষেত্রে ২৫ টনের ডিউটি এবং ১৬ বা তার বেশি চাকার গাড়িতে থাকা পণ্যের ২৬ টনের শুল্ককর দিতে হবে।

এছাড়া ৬ চাকার ট্রাকে থাকা হিমায়িত মাছের জন্য ৬ টনের শুল্ককর দিতে হবে। ১০ চাকার ট্রাকের ১০ টনের শুল্ককর, ১২ চাকার ট্রাকের ১৩ টনের শুল্ককর, ১৪ চাকার ক্ষেত্রে ১৮ টনের ডিউটি এবং ১৬ বা তার বেশি চাকার গাড়িতে থাকা পণ্যের ২০ টনের শুল্ককর দিতে হবে।

বরফ ছাড়া মাছের ৬ চাকার ট্রাকের ১৫ টনের শুল্ককর দিতে হবে। ১০ চাকার ট্রাকের ১৮ টনের শুল্ককর, ১২ চাকার ট্রাকের ২০ টনের শুল্ককর, ১৪ চাকার ক্ষেত্রে ২১ টনের এবং ১৬ বা তার বেশি চাকার গাড়িতে থাকা পণ্যের ২২ টনের শুল্ককর দিতে হবে।

শুঁটকি মাছের ক্ষেত্রে ৬ চাকার ট্রাকের জন্য ১৬ টনের শুল্ককর দিতে হবে। ১০ চাকার ট্রাকের থাকা পণ্যের ১৮ টনের শুল্ককর দিতে হবে। ১২ চাকার ট্রাকে থাকা পণ্যের জন্য ২০ টনের ডিউটি দিতে হবে। ১৪ চাকার ক্ষেত্রে ২২ টনের ডিউটি এবং ১৬ বা তার বেশি চাকার গাড়িতে থাকা পণ্যের ২৪ টনের শুল্ককর দিতে হবে।

টমেটো ৬ চাকার ট্রাকের জন্য ১৮ টনের শুল্ককর দিতে হবে। ১০ চাকার ট্রাকের থাকা পণ্যের ২০ টনের শুল্ককর দিতে হবে। ১২ চাকার ট্রাকে থাকা পণ্যের জন্য ২৪ টনের ডিউটি দিতে হবে। ১৪ চাকার ক্ষেত্রে ২৮ টনের ডিউটি এবং ১৬ বা তার বেশি চাকার গাড়িতে থাকা পণ্যের ৩০ টনের শুল্ককর দিতে হবে।

পান ৬ চাকার ট্রাকের জন্য ৬ টনের শুল্ককর দিতে হবে। ১০ চাকার ট্রাকের থাকা পণ্যের ৯ টনের শুল্ককর দিতে হবে। ১২ চাকার ট্রাকে থাকা পণ্যের জন্য ১১ টনের ডিউটি দিতে হবে। ১৪ চাকার ক্ষেত্রে ১২ টনের ডিউটি এবং ১৬ বা তার বেশি চাকার গাড়িতে থাকা পণ্যের ১৩ টনের শুল্ককর দিতে হবে।

গড়ে সব গাড়িতে শুল্কের পরিমাণ আগের চেয়ে ২০ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে।

এ সম্পর্কিত আরও খবর