গ্রাহকের আস্থা ও বিশ্বাসে সব সূচকে শীর্ষে ইসলামী ব্যাংক
অধিকাংশ সূচকে দেশের সরকারি-বেসরকারি সব ব্যাংককে ছাড়িয়ে গিয়েছিল ইসলামী ব্যাংক পিএলসি। কেবল আমানতের দিক থেকে পিছিয়ে ছিল। এবার আমানত পাওয়ার ক্ষেত্রে দেশের এক সময়ের সবচেয়ে বড় আর্থিক প্রতিষ্ঠান সোনালী ব্যাংককে ছাড়িয়ে গেল ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ। গত ডিসেম্বরে ইসলামী ব্যাংকের কাছে আমানতের শীর্ষস্থান হারায় সোনালী ব্যাংক। গত ৬ মাসে শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকটির নতুন আমানত বেড়েছে ৬ হাজার ৩৫০ কোটি টাকা। সদ্যসমাপ্ত জুন মাস শেষে ব্যাংকটি এক লাখ ৫৯ হাজার ৭৯২ কোটি টাকা আমানত পেয়েছে, যা দেশের ব্যাংকিং খাতের মোট আমানতের সাড়ে ৯ শতাংশ।
এছাড়া আমানতের পাশাপাশি ঋণ বিতরণের (বিনিয়োগ) দিক থেকে ইসলামী ব্যাংক এখন দেশের সবচেয়ে বড় আর্থিক প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে দিয়ে বাংলাদেশের ব্যাংকিং সেক্টরে সব সূচকে শীর্ষে অবস্থান করছে এখন ইসলামী ব্যাংক।
অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংকিং বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইসলামী ব্যাংকের সব সূচকে শীর্ষে পৌঁছানোর কারণ ব্যাংকটির প্রতি সাধারণ গ্রাহকদের আস্থা ও বিশ্বাস। ইসলামী ব্যাংকের এ ধরনের আস্থা ও ভাবমূর্তি অর্জন করা বিরাট ব্যাপার বলে মানছেন তারা।
ইসলামী ব্যাংকের কার্যক্রম শুরু হয় ১৯৮৩ সালের ৩০ মার্চ। এটি ছিল দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার প্রথম সুদমুক্ত ব্যাংক। শুরুর দিকে এ ব্যাংকের পথচলা ছিল চ্যালেঞ্জিং। প্রচলিত ব্যাংক ব্যবস্থার বিপরীতমুখী কার্যক্রম নিয়ে জনগণের আস্থা অর্জন করা সহজ ছিল না। কিন্তু প্রতিষ্ঠার প্রথম দশকেই ইসলামী ব্যাংক গ্রাহকদের হৃদয়ে জায়গা করে নেয়। এর পরের দশকগুলোয় এ ব্যাংকের কার্যক্রম ক্রমাগত প্রসারিত হয়েছে।
রেমিটেন্সে শীর্ষে
দীর্ঘ ১৬ বছর ধরে রেমিটেন্স আয়ে শীর্ষস্থানে রয়েছে ইসলামী ব্যাংক। গত ছয় মাসে (জানুয়ারি-জুন) ইসলামী ব্যাংকের মাধ্যমে দেশে রেমিটেন্স এসেছে প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা।
এদিকে আমদানি-রপ্তানি, এসএমই, সিএসএমই, শিল্পায়ন, উদ্যোক্তা উন্নয়ন, নারীর ক্ষমতায়নসহ প্রতিটি সূচকে ইসলামী ব্যাংকের অবস্থান এখন সবার শীর্ষে।
উদ্যোক্তা সৃষ্টি
ইসলামী ব্যাংক প্রতিষ্ঠার সময়ে দেশের রপ্তানি খাত ছিল সীমিত। পাট, চামড়াসহ অল্প কিছু পণ্য তখন বিদেশের বাজারে রপ্তানি হতো। তৈরি পোশাক খাতের পরিসরও তখন একেবারে ছোট। সেই সময় দেশের উৎপাদনমুখী শিল্পপ্রতিষ্ঠানও ছিল হাতেগোনা। এ অবস্থায় ইসলামী ব্যাংক উদ্যোক্তা তৈরি, কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও শিল্পায়নে জোর দিয়ে কার্যক্রম শুরু করে। ইসলামী ব্যাংকের হাত ধরে গড়ে ওঠে একঝাঁক প্রতিশ্রুতিশীল শিল্প উদ্যোক্তা, যারা দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে অনবদ্য অবদান রেখে চলেছেন।
পোশাক খাতের ভিত্তি তৈরি
বিশেষ করে দেশের তৈরি পোশাক খাতের ভিত্তি তৈরি হয়েছে ইসলামী ব্যাংকের বিনিয়োগের মাধ্যমে। দেশের তৈরি পোশাক খাতের বিকাশে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছে ব্যাক-টু-ব্যাক ঋণপত্র বা এলসি। ইসলামী ব্যাংকের তথ্য মতে, গত জুন শেষে ইসলামী ব্যাংক মোট বিনিয়োগ করেছে ১ লাখ ৫৭ হাজার ৭৯৮ কোটি টাকা, যা দেশের ব্যাংকিং খাতের প্রায় ১০ শতাংশ। বর্তমানে ১ হাজারের বেশি টেক্সটাইল এবং আরএমজি ইউনিটসহ ৬ হাজারের বেশি শিল্পপ্রতিষ্ঠান ইসলামী ব্যাংকের অর্থায়নে পরিচালিত হচ্ছে।
শিল্প অর্থায়নে প্রায় ৪৫ শতাংশ এবং এসএমই বিনিয়োগের প্রায় ১১ শতাংশ ইসলামী ব্যাংকের। এ ছাড়া দেশের সিএমএসএমই খাতে বিনিয়োগের প্রায় ২৬ শতাংশ ইসলামী ব্যাংকের। ২০২৩ সালে ইসলামী ব্যাংকের আমদানি ছিল ৫৭ হাজার ২৯৭ কোটি টাকা। গত জুন শেষে ছাড়িয়েছে ৩২ হাজার ২৯২ কোটি টাকা, যা দেশের ব্যাংকিং খাতের ৯ শতাংশ। ২০২৩ সালে ব্যাংকের রপ্তানি ছিল ৩৩ হাজার ৬৯৪ কোটি টাকা। গত জুন শেষে ছাড়িয়েছে ১৫ হাজার ৬১৯ কোটি টাকা।
করোনাকালের শুরুতে ইসলামী ব্যাংকের আমানতে বড় উল্লম্ফন ঘটে। দেশের ব্যাংকিং খাতে সবচেয়ে বেশি আমানত সংগ্রহ করেছে ইসলামী ব্যাংক। সদ্যসমাপ্ত জুন মাস শেষে ইসলামী ব্যাংকের আমানত ১ লাখ ৫৯ হাজার ৭৯২ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। যা দেশের ব্যাংকিং খাতের মোট আমানতের সাড়ে ৯ শতাংশ। গত ৬ মাসেই নতুন আমানত বেড়েছে ৬ হাজার ৩৫০ কোটি টাকা। এজেন্ট ব্যাংকিং আউটলেটের মাধ্যমের সর্বমোট ১৬ হাজার কোটি টাকা আমানত এসেছে ইসলামী ব্যাংকের।
ইসলামী ব্যাংকের প্রতি সাধারণ গ্রাহকদের অন্যরকম আস্থা ও বিশ্বাস রয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ।
তিনি বলেন, নিজের অভিজ্ঞতা থেকে তিনি বলেন, কোনো এলাকায় অন্য ব্যাংকের একটি নতুন শাখা খুললে যে পরিমাণ আমানত জমা হয়, ইসলামী ব্যাংকে তার চেয়ে ১০ গুণ বেশি জমা হয়। বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্য প্রবাসীরা ইসলামী ব্যাংকের হিসাব খুলে এবং ব্যাংকটির মাধ্যমে রেমিটেন্স পাঠিয়ে অনেক বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। একটি ব্যাংকের জন্য এ ধরনের আস্থা ও ভাবমূর্তি অর্জন করা বিরাট ব্যাপার।
ইসলামী ব্যাংকের তথ্য মতে, দেশব্যাপী সর্বমোট ৩৯৫টি শাখা, ২৫০টি উপশাখা, ২৭৮৩টি এজেন্ট ব্যাংকিং আউটলেট এবং ৩ হাজার এটিএম ও সিআরএম বুথ স্থাপন করা হয়েছে। পল্লী উন্নয়ন প্রকল্পের মাধ্যমে ৬৪ জেলার ৩৩ হাজার গ্রামের প্রায় ১৭ লাখ সদস্যকে আথিক সেবা দেওয়া হচ্ছে। উল্লেখ্য, এই প্রকল্পের ৯২ শতাংশই নারী। প্রান্তিক পর্যায়ের ৬ লাখ কৃষক ইসলামী ব্যাংকের সঙ্গে ব্যাংকিং করছে। ২০২৩ সালে ইসলামী ব্যাংকের মাধ্যমে বৈদেশিক রেমিটেন্স আহরণের পরিমাণ ছিল ৪৯ হাজার ৮৬৩ কোটি টাকা। সদ্যসমাপ্ত জুন শেষে এই আহরণ ছাড়িয়েছে ৩.৯৬ বিলিয়ন ডলার।
বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা। যা দেশের মোট ব্যাংকিং খাতের ২৬ শতাংশ। ইসলামী ব্যাংকের মাধ্যমে দেশের রেমিটেন্স সুবিধাভোগীর সংখ্যা প্রায় ৮৫ লাখ। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ইসলামী ব্যাংক ৬ বিলিয়ন ডলারের বেশি বৈদেশিক রেমিটেন্স আহরণ করেছে। বৈধ পথে রেমিটে›স আহরণে বিশ্বের ২৯টি দেশের ১৪৯টি ব্যাংক ও এক্সচেঞ্জ হাউসের সঙ্গে চুক্তি রয়েছে। রেমিটেন্স আহরণে সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগের ফলে ইসলামী ব্যাংকের মাধ্যমে রেমিটেন্স আসার পরিমাণ বেড়েছে বলে মনে করেন কর্মকর্তারা।
তারা বলেন, ইসলামী ব্যাংক দীর্ঘ ১৬ বছর ধরে প্রবাসী আয়ে দেশের ব্যাংকিং খাতে শীর্ষস্থানে রয়েছে। প্রতিষ্ঠার শুরু থেকে নিজস্ব আমদানি ব্যয় পরিশোধের পর এ পর্যন্ত সরকারি রিজার্ভে ১৩ দশমিক ১ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি যোগ করে অর্থনীতিতে বিশেষ অবদান রেখেছে এই ব্যাংক। বর্তমানে ব্যাংকের মোট গ্রাহকসংখ্যা ২ কোটি ৩৫ লাখ। ইসলামী ব্যাংকের মাধ্যেম প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে দেশের ১ কোটিরও বেশি মানুষের কমসংস্থান হয়েছে।
জানতে চাইলে ইসলামী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) অ্যান্ড সিইও মুহাম্মদ মুনিরুল মওলা বলেন, আমানত, ঋণ বিতরণ (বিনিয়োগ), আমদানি-রপ্তানি, এসএমই, সিএসএমই, শিল্পায়ন, উদ্যোক্তা উন্নয়ন, নারীর ক্ষমতায়নসহ প্রতিটি সূচকে ইসলামী ব্যাংকের অবস্থান এখন সবার শীর্ষে। এটি সম্ভব হয়েছে গ্রাহক, ব্যাংকের কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ সকলের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায়। জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে শহর কিংবা গ্রামের সব মানুষই ইসলামী ব্যাংকের মাধ্যমে সেবা নিচ্ছে।
বর্তমানে আমাদের গ্রাহক সংখ্যা প্রায় ২ কোটি ৩৫ লাখ।িইর মাধ্যেম প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে দেশের ১ কোটিরও বেশি মানুষের কমসংস্থান হয়েছে। যারা প্রবাসে আছেন তারাও ইসলামী ব্যাংকের ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে সেবা নিচ্ছেন। তিনি বলেন, আমাদের ‘সেলফিন’ অ্যাপ ব্যবহারকারীদের জন্য নিয়ে এসেছে এক অ্যাপেই প্রযুক্তিভিত্তিক সকল ব্যাংকিং সমাধান। সেলফিন ব্যবহার করে বিভিন্ন ধরনের লেনদেন করা যায়। এর মাধ্যমে যে কোনো ব্যাংকের অ্যাকাউন্ট, কার্ড বা মোবাইল ওয়ালেট যেমন এমক্যাশ, বিকাশ এবং নগদ-এ তাৎক্ষণিক ফান্ড ট্রান্সফার করা যায়।