কুরবানি ঈদের আগে আগে দেশের বাজারে বেড়ে যায় পেঁয়াজের চাহিদা। আমদানি কম হচ্ছে এমন অজুহাতে চলতি মাসে পেঁয়াজের দাম বাড়িয়ে দেন ব্যবসায়ীরা। এতে হিমশিম খেতে হয় মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্তদের। তবে সমস্যা কাটিয়ে এবার ঈদকে সামনে রেখে ভারত থেকে পেঁয়াজ আমদানির জন্য পর্যাপ্ত এলসি খুলেছেন আমদানিকারকরা। আর বন্দরগুলোতেও প্রবেশের অপেক্ষায় রয়েছে পেঁয়াজ বোঝাই ট্রাক। এসব ট্রাক দেশে প্রবেশ করতে পারলে পেঁয়াজের বাজার সম্পূর্ণ স্থিতিশীল থাকবে বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।
জানা গেছে, দেশে পেঁয়াজের বার্ষিক চাহিদা প্রায় ২৪ লাখ মেট্রিক টন। বাংলাদেশ ট্যারিফ কমিশনের প্রতিবেদন অনুসারে, এক মাস আগে পেঁয়াজের আন্তর্জাতিক বাজারদর ছিল ২১২ দশমিক ১০ ডলার, বর্তমানে তা ২৩১ দশমিক ৪২ ডলার। আর বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুসারে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে গত ৩১ মে পর্যন্ত ১০ লাখ ৬৮ হাজার মেট্রিক টন পেঁয়াজের এলসি খোলা হয়েছে এবং ১০ লাখ ৩০ হাজার মেট্রিক টন এলসি নিষ্পত্তি হয়েছে। অন্যদিকে আগের বিগত অর্থবছরে একই সময়ে এলসি খোলা ও নিষ্পত্তির পরিমাণ ছিল যথাক্রমে ৮ লাখ ১১ হাজার মেট্রিক টন ও ৭ লাখ ৭৬ হাজার মেট্রিক টন।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, বাংলাদেশে এই মৌসুমে পেঁয়াজের চাষ না থাকায় গত বছরের সংরক্ষিত দেশি পেঁয়াজের পাশাপাশি বছরজুড়েই আমদানির পেঁয়াজ দিয়ে ভোক্তাদের চাহিদা মেটানো হয়। ভারতের মহারাষ্ট্র রাজ্যের নাসিকে পেঁয়াজের দাম সামান্য বাড়লেও তার প্রভাব যতটা পড়ার কথা বাজারে তারচেয়েও বেশি দামে পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছিল। তবে সরকারের নির্দেশনা এবং ব্যবসায়ীরা বেশি বেশি এলসি খোলায় পেঁয়াজের পাইকারি দাম সহনীয় পর্যায়ে আসতে শুরু করেছে। প্রতিদিন স্থলবন্দরগুলোতে গড়ে ৬০ থেকে ৭০ ট্রাক পেঁয়াজ ঢুকতে পারছে আর ওপারে অপেক্ষায় থাকছে শত শত ট্রাক। যার প্রভাব পড়ে পেঁয়াজের দামে।
বুধবার (২৪ জুলাই) দুপুরে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সম্মেলন কক্ষে পবিত্র ঈদুল আজহার প্রাক্কালে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি যেমন- পেঁয়াজ, রসুন, আদা, মসলা ইত্যাদির মূল্য স্থিতিশীল রাখা এবং গবাদি পশু পরিবহন সংক্রান্ত বিষয়ে অংশীজনদের নিয়ে সভা করেন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি। সভায় বাজার নিয়ন্ত্রণে তিনি ব্যবসায়ী প্রতিনিধিদের সহযোগিতা চান।
সভা সূত্রে জানা গেছে, সভায় পেঁয়াজের দাম নিয়ে আলোচনা বেশি গুরুত্ব পেয়েছে। যেভাবেই হোক ঈদে পেঁয়াজের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দিয়েছেন মন্ত্রী। এর জবাবে ব্যবসায়ীরা জানান, বাংলাদেশের পেঁয়াজের বাজার নির্ভর করে ভারত থেকে আমদানির ওপর। বর্তমানে বর্ডার দিয়ে মাত্র ৫০ থেকে ৭০ ট্রাক পেঁয়াজ প্রবেশ করানো হয়। এ সংখ্যা আরো অনেক বাড়াতে হবে। তাহলে পেঁয়াজের বাজারে দাম স্থিতিশীল থাকবে। সামনে কুরবানির ঈদ হওয়ায় সোনা মসজিদ ও ভোমরা সীমান্ত দিয়ে প্রতিদিন ১৫০টি গাড়ি ঢোকার ব্যবস্থা করলে সমস্যা সমাধান হয়ে যাবে। এটা না হলে বাজার অনিয়ন্ত্রিত থেকে যাবে। স্থলবন্দরগুলো আরো বেশি সময় খোলা রাখার অনুরোধ জানান ব্যবসায়ীরা।
জবাবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মো. মফিজুল ইসলাম বলেন, আগের তুলনায় এখন বেশি সংখ্যক পেঁয়াজের ট্রাক প্রবেশ করছে। উত্তরে অনেক ব্যবসায়ীরা বলেন, নির্দেশনা অনুযায়ী বন্দর বাড়তি সময় খোলা রাখা হচ্ছে না।
এরপর বাণিজ্য সচিব বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট উপ-সচিব জিন্নাত রেহানার উদ্দেশে বলেন, ‘আমি যে কাস্টমস আরও এক ঘণ্টা বেশি খোলা রাখার জন্য চিঠি দিতে বলেছিলাম। সেটা কি দিয়েছেন?’ তখন উপসচিব উত্তর দিতে পারেননি।
মফিজুল ইসলাম চিঠি দেখতে চাইলে উপসচিব বলেন, ‘সাতক্ষীরার ডিসিকে দিতে বলা হয়েছে।’ এরপর সচিব বলেন, ‘আমি তো আপনাকে দিতে বলেছি। দিয়েছেন কিনা?’ উত্তরে উপসচিব বলেন, ‘দেওয়া হয়নি।’ এর পরিপ্রেক্ষিতে সচিব বলেন, ‘দেন নাই কেন? মিটিং থেকে আপনি উঠে যান। গিয়ে চিঠি দিয়ে আসেন।’
এরপর মিটিং চলাকালেই বাণিজ্য সচিব সাতক্ষীরার ডিসির সঙ্গে মোবাইল ফোনে কথা বলেন। ডিসিকে সচিব বলেন, ‘তোমাকে অনুরোধ করেছিলাম যে, পেঁয়াজের ট্রাক যেন বেশি করে ঢুকতে পারে সে জন্য কী করতে পারলা?’ ডিসি বলেন, ‘ইতোমধ্যে এক ঘণ্টা বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এর চেয়ে বেশি ট্রাক আসতে দিতে হলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে একটি চিঠি দিতে হবে।’ বৈঠক চলা অবস্থায় সচিব বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেওয়ার নির্দেশ দেন।
এদিকে প্রয়োজনের ক্ষেত্রে স্থলবন্দর ২৪ ঘণ্টা খোলা রাখা যায় বলে জানিয়েছেন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা। তারা বলছেন, ‘এ সংক্রান্ত আইন আছে। অত্যাবশ্যকীয় সার্ভিস আইনের মাধ্যমে প্রয়োজনে ২৪ ঘণ্টা বন্দর খোলা থাকবে।’
বৈঠকে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেন, ‘ঈদের সময় যেন সাধারণ মানুষ কষ্ট না পায়। তারা যেন সহনীয় মূল্যে নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য কিনতে পারে— এ ব্যাপারে আপনারা (ব্যবসায়ীরা) সহযোগিতা করবেন। কোথাও প্রয়োজন হলে সরকার ভর্তুকি দেবে। পেঁয়াজ ও রসুনসহ যেসব পণ্যের মূল্য বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে টিসিবি সেসব পণ্য ট্রাক সেলে বিক্রি করবে।’
ঈদে নিত্য প্রয়োজনীয় কোন পণ্যের দাম না বাড়াতে ব্যাবসায়ীদের অনুরোধ জানান টিপু মুনশি।
বৈঠক শেষে ঢাকা মহানগর কৃষিপণ্য আমদানিকারক সমিতির সাধারণ সম্পাদক খন্দকার বাবুল বার্তাটোয়েন্টিফোর.কমকে বলেন, ভারতের সীমান্তে প্রতিদিন তিন থেকে চারশ' গাড়ি পেঁয়াজ দাঁড়িয়ে থাকে। সেগুলো সেখান থেকেই কন্ট্রোল করা হয়। পেঁয়াজের দাম ঢাকার আমাদিকারকদের হাতে নেই। এটি নিয়ন্ত্রণ করে ভারতের দিকের ব্যবসায়ী ও বর্ডারের যারা নিয়ন্ত্রক আছেন তারা। আগে ৫০ ট্রাক পেঁয়াজ ঢুকত, এখন সেই জায়গায় ৭০ গাড়ি ঢুকছে। কিন্তু এখন দেড়শ' থেকে ২০০ গাড়ি ঢুকতে পারলে পেঁয়াজের দাম একদম কমে যাবে। তখন পেঁয়াজ থাকবে ২০ থেকে ২২ টাকা।
বন্দরে অতিরিক্ত ট্রাক ঢোকাতে বাড়তি সময় স্থলবন্দর খোলা রাখার বিষয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সদস্য (শুল্ক নীতি) সৈয়দ গোলাম কিবরিয়া বার্তাটোয়েন্টিফোর.কমকে বলেন, আরো বেশি সংখ্যক ট্রাক যাতে ঢুকতে পারে সে জন্য আরো বেশি সময় বন্দর খোলা রাখার জন্য চেষ্টা করছি। বেনাপোল, ভোমরা, সোনা মসজিদসহ বন্দরগুলোতে শুল্ক বিভাগের অফিসগুলো যেন বেশি সময় কাজ করে সে জন্য চিঠি দেব। যাতে করে আমাদানি ও মজুদ বাড়ানো যায়।
বাজারে পেঁয়াজসহ নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম সহনীয় পর্যায়ে রাখতে প্রয়োজনে ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশকে (টিসিবি) ট্রাকে করে ন্যায্যমূল্যে পণ্য বিক্রি করার নির্দেশ দিয়েছেন বাণিজ্যমন্ত্রী। একই সঙ্গে টিসিবিকে বাজার মনিটরিং ব্যবস্থা জোরদারের নির্দেশনাও দেওয়া হয়।
এ বিষয়ে টিসিবি'র চেয়ারম্যান ব্রি. জেনারেল হাসান জাহাঙ্গীর বার্তাটোয়েন্টিফোর.কমকে বলেন, আজকে বৈঠকে এ বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। এখনও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি। মন্ত্রণালয় থেকে নির্দেশনা পেলে আমরা ব্যবস্থা নেব। বাজারে ন্যায্যমূল্যে পণ্য বিক্রিতে আমাদের সক্ষমতা আছে।