২০২৪ সালে লোডশেডিং মুক্ত বিদ্যুৎ

বিদ্যুৎ-জ্বালানী, অর্থনীতি

সেরাজুল ইসলাম সিরাজ, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তাটোয়েন্টিফোর.কম, ঢাকা | 2023-09-01 23:42:01

বিদ্যুতের উৎপাদনে কোনো ঘাটতি নেই। তবে বিতরণ ও সঞ্চালন লাইনে সংকটের কারণে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ করা যাচ্ছে না। বিতরণ ও সঞ্চালন উন্নয়নে নেওয়া প্রকল্পের কাজ পাঁচ বছরের মধ্যে শেষ হলে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত হবে।


বার্তাটোয়েন্টিফোর.কমের সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে এমন আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন বিদ্যুৎ বিভাগের সিনিয়র সচিব ড. আহমদ কায়কাউস। ইউনিভার্সিটি অব টেক্সাস থেকে পাবলিক পলিসি ও পলিটিক্যাল ইকোনমিতে ডক্টরেট ডিগ্রিধারী কায়কাউস অতিরিক্ত সচিব পদে বিদ্যুৎ বিভাগে যোগ দেন। ২০১৬ সালের ডিসেম্বর মাসে সচিব হিসেবে দায়িত্ব পান। তার হাত ধরেই বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উৎপাদনের রেকর্ডের পর রেকর্ড গড়ে চলেছে।


এক সময় বিদ্যুৎ না থাকার কারণে সমালোচনা হতো, এখন বেশি উৎপাদন ক্ষমতা নিয়েও কেউ কেউ সমালোচনা করছেন। আরও অনেক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কাজ চলছে। নতুন করে বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ চুক্তি নিয়েও প্রশ্ন তুলছেন কেউ কেউ। এসব সমালোচনার বিষয়ে খোলামেলা মতামত দিয়েছেন বিদ্যুৎ বিভাগের এ সফল সচিব।

বীর চট্টলার এ সন্তান বলেন, সক্ষমতা অর্জনের জন্য যেখানে সাধুবাদ পাবার কথা, উল্টো সমালোচনা করা হচ্ছে। আমি এ সমালোচনার কোনো কারণ খুঁজে পাই না। যা করা হচ্ছে যৌক্তিক এবং আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুসরণ করেই করা হচ্ছে। আপনি যদি দেখেন বসুন্ধরা শপিং মল, সেখানে প্রথম দিনেই কি সবগুলো দোকান চালু হয়েছিল? আবার যদি বলি, যমুনা ফিউচার পার্ক। অনেকদিন হলো এখনও সব দোকান ভাড়া হয়নি। তাহলে কি আপনি বলবেন মালিক বোকামি করেছে? না মালিক বোকামি করেনি, এটাই নিয়ম। অবকাঠামো তৈরি হবে, তারপর ব্যবসায়ীরা আসবে। আমরাও সেই সুযোগটাই তৈরি করেছি। ব্যবসায়ীরা এখন নিশ্চিন্তে বিনিয়োগে এগিয়ে আসবে। আগে তো অভিযোগ শুনেছি, ব্যবসায়ীরা বিনিয়োগ করে বসে আছে, কিন্তু বিদ্যুৎ-গ্যাসের অভাবে চালু করতে পারছে না। সময়মতো চালু করতে না পারলে তারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ব্যবসায়ীরা ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে বিনিয়োগ করেন, যেদিন ঋণ নেন, সেদিন থেকেই তার সুদ শুরু হয়। বিদ্যুতের জন্য যদি বসে থাকতে হয়, তাহলে লোকসান বাড়ে। ব্যবসায়ীরা হতাশ হয়।

বার্তাটোয়েন্টিফোর.কমের একান্ত সাক্ষাৎকারে বিদ্যুৎ বিভাগের সিনিয়র সচিব ড. আহমদ কায়কাউস

সমালোচকদের উদ্দেশে তিনি বলেন, তাদের একটি পরিসংখ্যান জানাতে চাই। জার্মানি চাহিদার তুলনায় ১৩০ শতাংশ অতিরিক্ত উৎপাদন ক্ষমতা অর্জন করেছে। আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারত ৭১ শতাংশ, মালয়েশিয়া ৫৩ শতাংশ বেশি উৎপাদন ক্ষমতা অর্জন করেছে। সেখানে বাংলাদেশ ৪৫ শতাংশ বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা অর্জন করেছে। আপনাকে আমি উন্নত, উন্নয়নশীল এবং নিম্ন আয়ের দেশের উদাহরণ দিলাম। তাহলে কি বলবেন তারা ভুল করেছে, নাকি অপচয় করছে? এটাই নিয়ম। সর্বোচ্চ পিকে চাহিদার হিসেবকে ভিত্তি ধরে পরিমাপ করা হয়। কারণ হচ্ছে, নিয়মিত সার্ভিসিং করতে হয় এসব বিদ্যুৎ কেন্দ্রে। আপনি তো সরবরাহ বন্ধ রেখে সার্ভিসিং করাতে পারবেন না। আবার কোনোটিতে যদি ত্রুটি দেখা দেয়? এসব কারণে স্ট্যান্ডবাই রাখতে হয়।


পাওয়ার সিস্টেম মাস্টার প্ল্যান অনুযায়ী এগিয়ে যাচ্ছি। ২০২৭ সাল পর্যন্ত ১শ’ মিটার গতিতে বাংলাদেশ এগিয়ে চলবে। নতুন নতুন শিল্প স্থাপন হবে। এরপর উৎপাদন ও চাহিদার মধ্যে ফারাক কমে আসবে। ২০৪০ সালে ৬০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুতের প্রয়োজন পড়বে। যা হচ্ছে সবই মাস্টার প্ল্যান অনুযায়ী, যোগ করেন তিনি।


তাহলে কি মাস্টার প্ল্যানের ফোরকাস্ট অনুযায়ী বিদ্যুতের চাহিদা তৈরি হয়নি? এমন প্রশ্নে জবাবে ড. কায়কাউস বলেন, গত বছর বিদ্যুতের চাহিদা ১০ শতাংশ বৃদ্ধির প্রেডিকশন ছিল, কিন্তু উৎপাদন বেড়েছে ১২ শতাংশ। প্রায় ২২ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা রয়েছে। সেখানে সর্বোচ্চ উৎপাদনের রেকর্ড রয়েছে প্রায় ১৩ হাজারের মতো।


তাহলে বিদ্যুৎ কেন্দ্র বসিয়ে রেখে লোডশেডিং করা হচ্ছে কেন? জবাবে বলেন, আমরা অনেকদিন ধরেই বলে আসছি, আমাদের বিদ্যুতের সমস্যা নেই। কিন্তু বিতরণ ও সঞ্চালনে কিছু সমস্যা রয়েছে। বিতরণ ও সঞ্চালন আপগ্রেডেশনের জন্য একটি প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। এতে ব্যয় হবে ৩.৬ বিলিয়ন ডলার। এ প্রকল্পটি শেষ হতে সময় লাগবে পাঁচ বছরের মতো। এরপর সারাদেশে নিরবচ্ছিন্ন ও মানসম্মত বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত হবে।


তাহলে বিতরণ প্ল্যানে কি কোনো ভুল ছিল, যার কারণে এ সংকট হচ্ছে? এমন প্রশ্নের জবাবে বলেন, দেখেন ১৯৭৭ সালে পল্লী বিদ্যুৎ গঠন করা হয়। লক্ষ্য ছিল পল্লী এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ করবে। এখন কি গাজীপুর, সাভার, আশুলিয়াকে পল্লী বলবেন? এমন কিছু সমস্যা হয়েছে। গ্রামে বিদ্যুৎ যাওয়ার পর মিল কারখানা স্থাপন হচ্ছে। যে কারণে বিতরণ লাইনগুলো লোড নিতে পারছে না। লাইন নির্মাণ করতে গিয়ে জমি নিয়েও সংকট হচ্ছে। অনেকে জমি ছাড়তে চায় না।

শতভাগ বিদ্যুতায়ন প্রসঙ্গে সিনিয়র সচিব বলেন, আগামী জুন মাসের মধ্যে শতভাগ বিদ্যুতায়ন নিশ্চিত করার জন্য দ্রুত কাজ চলছে। চলতি মাসেই আরও বেশকিছু জেলায় শতভাগ বিদ্যুতায়ন কার্যক্রম উদ্বোধন করা হবে। বিদ্যুৎ হচ্ছে দেশের উন্নয়নের অন্যতম চালিকা শক্তি। নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করতে সরকার প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।

দেশে ১শ’ ইকোনমিক জোন স্থাপনের কাজ দ্রুত এগিয়ে চলছে। বেজা (বাংলাদেশ ইকোনমিক জোন কর্তৃপক্ষ) এসব জোনে নিজস্ব বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। শতভাগ বিদ্যুতায়ন হলে সর্বোচ্চ এক থেকে দেড় হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুতের চাহিদা বাড়বে। তাহলে নির্মাণাধীন বিদ্যুৎ কেন্দ্রের বিদ্যুৎ কোথায় ব্যবহৃত হবে?

জবাবে ড. কায়কাউস বলেন, বিদ্যুৎ কেন্দ্র করতে হলো তো আমাদের অনুমোদন লাগবে। আমার সঙ্গে বেজার নির্বাহী চেয়ারম্যানের অনেকবার কথা হয়েছে। আমরা তাদের আশ্বস্ত করেছি, নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহের বিষয়ে। আমরা তাদের যদি বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করি, তাহলে তো তাদের উৎপাদনে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। আমাদের চট্টগ্রাম অঞ্চলের বিদ্যুৎ কেন্দ্রের আর প্রয়োজন ছিল না। কিন্তু বিনিয়োগকারীদের উৎসাহ দেওয়ার জন্য মিরসরাই ইকোনমিক জোনকে টার্গেড করে নতুন বিদ্যুৎ কেন্দ্র করা হচ্ছে।

এ সম্পর্কিত আরও খবর