৮০টি পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির (পবিস) মধ্যে বর্তমানে মুনাফায় রয়েছে ১৮টি। ওঅ্যান্ডএম (অপরেশন অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট) ব্যয় কমানোসহ কিছু সংস্কারের মাধ্যমে অবশিষ্ট সমিতিগুলোও মুনাফায় আসতে পারে।
ডিসেম্বর ২০১৯ পর্যন্ত মুনাফায় থাকা ১৮ সমিতির নিট মার্জিনের পরিমাণ ছিল ১ হাজার ৪৪০ কোটি ৪৩ লাখ টাকা। একই সময়ে ৬২ লোকসানি সমিতির নিট ক্ষতির পরিমাণ ছিল ৮১৭ কোটি ২২ লাখ টাকা। ক্রস সাবসিডির মাধ্যমে সমিতির কার্যক্রমকে গতিশীল রাখা হয়েছে।
বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (বিআরইবি) টাস্কফোর্সের এক বিশ্লেষণে এমন তথ্য উঠে এসেছে। বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে পরিচালিত প্রকল্পের পরামর্শক আরভি শাহীর পরামর্শে এ টাস্কফোর্স গঠন করা হয়। এর প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে লাভজনক সমিতির সংখ্যা বৃদ্ধির কৌশল চূড়ান্ত করা। টাস্কফোর্স মনে করছে, একটু আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করা গেলে জুনের মধ্যে আরও ১৩টি সমিতিকে লাভজনক করা সম্ভব। ২০২১ সালের জুনের মধ্যে আরও ২৩টি সমিতি মুনাফায় আসতে পারে।
ঘাটতি কাটিয়ে মুনাফা আনতে হলে প্রথমেই ওঅ্যান্ডএম ব্যয় হ্রাস, সিস্টেম লস কমানো এবং অপ্রয়োজনীয় জনবল সরিয়ে ফেলার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। সমিতিগুলোতে ৪টি পদের বিপরীতে ৫ হাজার অতিরিক্ত জনবল রয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি উদ্বৃত্ত জনবল রয়েছে মিটার রিডার কাম ম্যাসেঞ্জার পদে। এ পদে ১০ হাজার ৫শ’ লোকবল রয়েছে। কিন্তু টাস্কফোর্স মনে করছে, এখানে ৫ হাজার লোকবল হলেই যথেষ্ট। এ পদে লোকবল কমিয়ে বছরে ৭৮ কোটি টাকা বেতন সাশ্রয় করা সম্ভব। দ্বিতীয় পর্যায়ে রয়েছে ক্যাশিয়ার ও সহকারী ক্যাশিয়ার পদে। এ পদে লোকবলের প্রয়োজন ৫৬৪ জন। এ পদে বর্তমানে লোকবল রয়েছে ৮১৮ জন। বাড়তি লোকবল কমিয়ে বছরে ১৩ কোটি ৪৪ লাখ টাকা সাশ্রয় করা সম্ভব।
ওয়ারিং পরিদর্শক পদে লোকবল প্রয়োজন ৬৪৪ জন, এ পদে বর্তমানে লোকবল রয়েছে ৭৫৬ জন। সহকারী হিসাবরক্ষক পদে বাড়তি লোকবল রয়েছে ২৫৮ জন। অন্যদিকে সিস্টেম লস ৫০ শতাংশ কমিয়ে বছরে ১শ’ কোটি টাকা সাশ্রয় করা সম্ভব।
সামগ্রিক ওঅ্যান্ডএম ব্যয় কমলেও আরও কমানোর সুযোগ ও প্রয়োজনীয়তা দেখছে টাস্কফোর্স। ২০১৮-১৯ অর্থ বছরে ওঅ্যান্ডএম ব্যয় হয়েছে ২ হাজার ৯৭২ কোটি টাকা। যা ইউনিট প্রতি দাঁড়ায় ৯৬ পয়সা। আর চলতি অর্থ বছরের প্রথম ৬ মাসে ৭২ পয়সায় এসে ঠেকেছে। মোট ওঅ্যান্ডএম ব্যয় দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ২৬৫ কোটি টাকা।
সমিতি ভিত্তিক সবচেয়ে বেশি ওঅ্যান্ডএম ব্যয় দেখা গেছে পটুয়াখালী পল্লী বিদ্যুৎ সমিতিতে। এ সমিতিতে ডিসেম্বর ২০১৮ সালে ওঅ্যান্ডএম ব্যয় ছিল ১.২৮ টাকা। ১ বছর পর ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে হয়েছে ১.২১ টাকা। পটুয়াখালী সমিতি বিদায়ী বছরে মোট লোকসান দিয়েছে ৯ কোটি ১৩ লাখ টাকা।
ওঅ্যান্ডএম ব্যয় বেশি প্রসঙ্গে পটুয়াখালী পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির জিএম মনোহর কুমার বিশ্বাস বার্তা২৪.কমকে বলেন, আমাদের এখানে জনসংখ্যার ঘনত্ব অনেক কম। অনেক এলাকায় প্রতি কিলোমিটারে ৭০ থেকে ৯০ জন গ্রাহক রয়েছেন। সেখানে আমাদের সমিতিতে রয়েছেন ৩০ থেকে ৩৫ জন। আর আমাদের নেটওয়ার্ক বিশাল এলাকা জুড়ে এ কারণে আমাদের ওঅ্যান্ডএম ব্যয় একটু বেশি। তবে আমরা এ ব্যয় কমিয়ে আনার টেষ্টা করছি।
ওঅ্যান্ডএম ব্যয় বেশি থাকা চাঁদপুর পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির জিএম কেফায়েত উল্লাহ বার্তা২৪.কমকে বলেন, আমাদের সমিতি আশির দশকে প্রতিষ্ঠা হয়েছে। খুঁটি ও তারগুলো পুরাতন হয়েছে সেগুলো পরিবর্তন করতে হচ্ছে। এ কারণে এ ব্যয় বেড়ে গেছে। তবে ব্যয় কমিয়ে আনার চেষ্টা চলছে। যার ফলও পেতে শুরু করেছি।
টাস্কফোর্স বলেছে, বিআরইবির নিজস্ব কেন্দ্রীয় ডেটা সার্ভারে সব সমিতিকে অন্তর্ভুক্ত করে কেন্দ্রীয় বিলিয় সিস্টেমের মাধ্যমে সহজেই বিলিং কার্যক্রম সম্পন্ন করা যায়। এতে পবিসের ক্যাশ শাখায় কাজের চাপ কমবে, নতুন করে জনবল নিয়োগ করার প্রয়োজন পড়বে না।
আরইবির সম্ভাবনা হিসেবে দেখানো হয়েছে বিশেষায়িত অর্থনৈতিক অঞ্চল, নতুন শিল্প ও বাণিজ্যিক সংযোগ এবং গ্রামের মানুষের বিদ্যুতের ব্যবহার বেড়ে যাওয়াকে। অন্যদিকে ঝুঁকি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে প্রতিকূল মূল্যবৃদ্ধি, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, অনলাইনে বিল আদায়ের ঝুঁকি ও দুর্ঘটনা জনিত ঝুঁকি। দুর্বলতা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে সদিচ্ছার অভাব, দুর্নীতি ও দালালদের উপস্থিতি, নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত না হওয়া এবং উচ্চ সিস্টেম লস।
আরইবির লোকজন মনে করেন, লোডশেডিং মুক্ত বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করা গেলে তাদের বিক্রির পরিমাণ বাড়বে। এর মাধ্যমে তাদের আয় বেড়ে যাবে। পাশাপাশি অনেক সমিতির এলাকায় শিল্পায়ন হচ্ছে। শিল্পে বেশি দরে বিদ্যুৎ বিক্রি করেও মুনাফা বাড়বে।
যেসব সমিতির এলাকায় শিল্প প্রতিষ্ঠান রয়েছে, মূলত সেসব পবিস মুনাফায় রয়েছে।
মুনাফায় থাকা পবিসগুলো হচ্ছে ঢাকা-১, ৩ ও ৪, নারায়ণগঞ্জ-১ ও ২, গাজীপুর-১ ও ২, ময়মনসিংহ-২, নরসিংদী-১ ও ২ মুন্সীগঞ্জ, হবিগঞ্জ, কক্সবাজার, মানিকগঞ্জ ও কুমিল্লা-১, ২ ও ৩। সবচেয়ে বেশি মুনাফা করেছে ঢাকা পবিস-১। বিদায়ী ডিসেম্বর পর্যন্ত ঢাকা জেলার এ সমিতি নিট মুনাফা করেছে ২৬৬ কোটি ৭২ লাখ টাকা।