উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার ফলাফলের পর সরকারি ও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তিতে সময় অপচয় হচ্ছে শিক্ষার্থীদের। ভর্তি পরীক্ষা শেষে ক্লাস শুরু করতেই ৬ মাস থেকে এক বছর ও কোনো কোনো ক্ষেত্রে দেড় বছর পর্যন্ত সময় লাগছে। এতে করে শিক্ষাজটে পড়ছেন শিক্ষার্থীরা। উচ্চশিক্ষার পরবর্তী চাকরি ও অন্যান্য পেশায় ঢুকতেও তাই সময়ক্ষেপণ হচ্ছে।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এইচএসসি সমমান ও আলিম শিক্ষার্থীদের চূড়ান্ত পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয় জুলাই থেকে আগস্ট মাসে। এরপর দুই থেকে চার মাস পেরিয়ে যায় ফলাফল পেতে। ফলাফল পাওয়ার দুই থেকে ছয় মাসের মধ্যে অনুষ্ঠিত হয় মেডিকেল, ইঞ্জিনিয়ারিং ভর্তি পরীক্ষা। পাবলিক ও সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি ও ক্লাস শুরু হতে চলে যায় ৬ মাস থেকে ১ বছর। এর মধ্যে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষের ক্লাস শুরু হতে সবচেয়ে বেশি সময় লাগে।
পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০২৩ সালে এইচএসসি, আলিম ও সমমান পরীক্ষা শুরু হয় ১৭ আগস্ট থেকে। ফলাফল প্রকাশিত হয় ২৬ নভেম্বর। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষা শুরু হতে পারে আগামী বছরের ফেব্রুয়ারিতে। অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এখনো ভর্তি পরীক্ষার বিষয়ে সিদ্ধান্ত জানায়নি।
২০২২ সালে এইচএসসি পরীক্ষা শুরু হয় ৬ নভেম্বর থেকে। ফলাফল প্রকাশ হয় ৮ ফেব্রুয়ারি। এরপর ৬ মে থেকে ২৯ এপ্রিল পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা, ১০ জুন বুয়েট ও গুচ্ছ বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয় ২০ মে থেকে ৩ জুন পর্যন্ত। এই সেশনে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয় ১৮ জুন থেকে ২২ জুন পর্যন্ত, তবে ক্লাস শুরু হয়েছে ৩০ নভেম্বর। এইচএসসি পরীক্ষা দেয়ার এক বছর পর পরবর্তী ক্লাসের যাত্রা শুরু হলো।
২০২১ সালে নির্দিষ্ট সময়ের ৮ মাস পর ২ ডিসেম্বর থেকে এইচএসসি পরীক্ষা শুরু হয়। ফলাফল প্রকাশ হয় পরের বছরের ১৩ ফেব্রুয়ারি। এরপর ১০ জুন থেকে বুয়েট, ২১ মে থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও ৩-১৭ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত গুচ্ছভূক্ত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বিভিন্ন অনুষদের পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। এর আগে ২০২০ সালে কোভিড-১৯ পরিস্থিতির জন্য মূল্যায়ন পদ্ধতিতে এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ করা হয় ২০২১ সালের ৩০ জানুয়ারি। এরপর ১০ জুন বুয়েট, ২১ মে ঢাবি ও ১৯ জুন থেকে গুচ্ছভূক্ত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়।
২০১৯ সালে ১ এপ্রিল থেকে পরীক্ষা শুরু হয়, ১৭ জুলাই প্রকাশিত হয় ফলাফল। এরপর ১৩ সেপ্টেম্বর থেকে ৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ও ৫ অক্টোবর বুয়েটের ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়।
অন্যদিকে দেশের প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের চিত্র ভিন্ন। চূড়ান্ত পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশের পরপরই ভর্তি প্রক্রিয়া শুরু হয়। সেমিস্টার পদ্ধতিতে ভর্তি প্রক্রিয়ার ফলে প্রতি ৪ মাস বা ৬ মাস পরপর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ থাকে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস শুরু হতে হতেই প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে ২ থেকে ৩ সেমিস্টার শেষ হয়ে যায়। এতে করে সেশনজট বাঁধছে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে, পিছিয়ে পড়ছে শিক্ষার্থীরা।
২০২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিচ্ছু ও চট্টগ্রাম ইসলামিয়া ডিগ্রি কলেজের শিক্ষার্থী আতাহারুল ইসলাম বার্তা২৪.কম’কে বলেন, আমি চট্টগ্রাম বোর্ডে আমাদের পরীক্ষা শুরু হয় অন্যান্য বোর্ডের দশদিন পর। বোর্ডের বাংলা এবং ইংরেজি খাতা অব্যমুল্যায়ন হয়েছে যা ফলাফলে স্পষ্ট। আমরা সবাই নেমে পড়েছি বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তিযুদ্ধে। ফেব্রুয়ারির শেষ সপ্তাহে হবে ঢাবির পরীক্ষা। গুচ্ছ ও অন্যান্য পরীক্ষা শেষ হতেই চলে যাবে আমাদের বছরের অর্ধেকটা সময়। রেজাল্ট, ভর্তি প্রক্রিয়া শেষ হয়ে ক্লাস শুরু হতে লাগবে ২০২৫ সালের জানুয়ারি। কিন্তু প্রাইভেট ভর্তি হওয়া আমাদের বন্ধুরা ক্লাস শুরু হবে আগামী ২/৩ মাসের মধ্যেই। তারা আমাদের থেকে প্রায় একবছর এগিয়ে যাবে। পরবর্তীতে চাকরি যুদ্ধের তারা আমাদের থেকে একবছর এগিয়ে থাকছে। এত বড় বৈষম্য কেন?
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্মুক্ত লাইব্রেরিতে চাকুরি পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছেন রাশেদুল ইসলাম। তিনি বার্তা২৪.কম’কে বলেন, এইচএসসি পরীক্ষা দেয়ার পর বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষা ও প্রথম বর্ষের ক্লাস শুরু হতে হতেই আমাদের এক-দেড় বছর শেষ হয়ে গেছে। তার উপর আছে সেশনজট। মাঝখানে করোনার জন্য ফাইনাল পরীক্ষা ও রেজাল্ট হতে আরও দেড় বছর সময় বেশি চলে গিয়েছে। সরকার তো চাকরি পরীক্ষার বয়স বাড়ায়নি, আমরা ৩ বছর পিছিয়ে গেছি। অন্যদিকে আমাদের বন্ধুরা যারা ন্যাশনাল ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছে তারা অনেক আগেই চাকরিতে ঢুকেছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ও শিক্ষাবিদ মজিবুর রহমান বার্তা২৪ ডট কম’কে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ভর্তির প্রস্তুতি শুরু করে ফলাফল প্রকাশের পর। ফলাফল কবে প্রকাশ হবে, সেটা আমরা জানি। তাই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ভর্তির প্রস্তুতিও অনেক আগে থেকে রাখতে হবে। ফলাফল প্রকাশের সাথে সাথে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে ১৫ দিনের মধ্যে আবেদন, তার ১৫ দিন পর পরীক্ষা; এরকম একটা নিয়ম করা যায়। শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা প্রস্তুতির জন্য ৪-৫ মাস সময় দিতে হবে, এমন বাধ্যবাধকতা নেই। পরীক্ষার সিলেবাস সবার জন্যই সমান।
তিনি আরও বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বছরে দুইবার ভর্তি পরীক্ষার আয়োজন করতে পারে। অনেক শিক্ষার্থী অসুস্থতাজনিত কারণে পরীক্ষা নাও দিতে পারে, তার জন্যও সুযোগ রাখতে হবে। কোনো বিশ্ববিদ্যালয় যদি ‘সেকেন্ড টাইমার’ না নিতে চায়, সে উপায়ও আছে। বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তিতে শিক্ষার্থীদের এই জট নিরসন করা মূল বিষয়। তবে এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ব্যাপারে সুস্পষ্ট নির্দেশনা দিতে হবে।
বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সচিব ড. ফেরদৌস জামান বার্তা২৪ ডট কম’কে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি প্রক্রিয়ায় শিক্ষাজট নিরসন করতে হলে একটি পরিকল্পিত অ্যাকাডেমিক ক্যালেন্ডার করতে হবে। কবে ভর্তি আবেদন, কবে থেকে পরীক্ষা-ভর্তি ও ক্লাস শুরু করবে তার সিডিউল থাকবে। আমরা সব বিবিদ্যালয়কে একক ভর্তি পরীক্ষায় নিয়ে আসার চেষ্টা করছি, তার অন্যতম একটি কারণ এই শিক্ষাজট নিরসন। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আলাদা ভর্তি পরীক্ষা নিলে কখনো এই জট নিরসন সম্ভব নয়।