দেশের শিক্ষা কার্যক্রমে আসছে বড় ধরনের পরিবর্তন। এরই অংশ হিসেবে মাধ্যমিকে উঠিয়ে দেয়া হচ্ছে বিজ্ঞান, মানবিক ও ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগ পদ্ধতি।
উচ্চমাধ্যমিক স্তরে গিয়ে শিক্ষার্থীরা বিভাগ নির্ধারণ করবে। শিক্ষার মানোন্নয়নে বিশিষ্ট শিক্ষাবিদদের নিয়ে গঠিত কমিটির সুপারিশের আলোকে ২০২৩ সাল থেকে এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে চাচ্ছে সরকার।
জানা গেছে, বিভাগ পদ্ধতি উঠিয়ে দেয়া ছাড়াও পাবলিক পরীক্ষার সংখ্যা কমিয়ে এনে শ্রেণিকক্ষে ধারাবাহিক মূল্যায়ন বাড়ানো হবে। এ লক্ষ্যে কারিকুলামে ব্যাপক পরিবর্তন আনতে কাজ করছে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)।
এ ব্যাপারে সারা দেশের শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও কারিকুলাম বিশেষজ্ঞদের মতামত নিয়েছে সরকার। এখন চলছে সমন্বয় ও নতুন কারিকুলাম প্রণয়নের কাজ। আর কারিকুলাম পরিবর্তনের পাশাপাশি বদলে যাবে পাঠ্যবইও। পরিবর্তিত বইয়ের অনেক কিছুই শিক্ষার্থীদের ক্লাসে বসেই হাতে কলমে করে দেখাতে হবে। এতে শিক্ষার্থীদের কাজের দক্ষতা বাড়বে। এছাড়া পাবলিক পরীক্ষার নম্বর কমিয়ে শ্রেণিকক্ষে স্কুলে বার্ষিক পরীক্ষা ও ধারাবাহিক মূল্যায়নের গুরুত্ব বাড়ানো হবে।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, দীর্ঘ দিন ধরেই শিক্ষা কারিকুলামে পরিবর্তন আনতে শিক্ষা সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে দফায় দফায় আলোচনা করেছে মন্ত্রণালয়। এ বিষয়ে মতামত নেয়া হয়েছে শিক্ষকদেরও। এক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞরা আধুনিক বিশ্বের পাঠ্য কর্মসূচির সঙ্গে সমন্বয় করে শিক্ষা কার্যক্রম ঢেলে সাজানোর পরামর্শ দেন। বিভিন্ন বৈঠকে এ বিষয়ে তারা বিভিন্ন দেশের উদাহরণও তুলে ধরেন। বিভিন্ন আলোচনায় শিক্ষাবিদদের প্রস্তাবনা একত্রিত করে তা নিয়ে দফায় দফায় বৈঠক করেন সংশ্লিষ্টরা। সেসব প্রস্তবনা থেকে বেশ কিছু প্রস্তাবনা নতুন শিক্ষা কারিকুলামে যুক্ত হবে। ২০২৩ সাল থেকে নবম শ্রেণির বিজ্ঞান, ব্যবসায় শিক্ষা ও মানবিক বিভাগ উঠিয়ে দেয়া হবে এবং শিক্ষার্থীরা নতুন কারিকুলাম ও বই পাবে।
জানা গেছে, মাধ্যমিক শিক্ষার মানোন্নয়নে শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে পরামর্শ দিতে ২০১৬ সালে বিশিষ্ট শিক্ষাবিদদের নিয়ে একটি কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির সদস্যদের নিয়ে সেই বছরের ২৫ ও ২৬ নভেম্বর কক্সবাজারে দুই দিনের আবাসিক কর্মশালা অনুষ্ঠিত হয়। এতে শিক্ষাবিদরা বেশ কিছু সুপারিশ করেন। সুপারিশ বাস্তবায়নে কয়েকটি সাব-কমিটিও গঠন করা হয়। শিক্ষাক্রম পর্যালোচনা সাব-কমিটি ২০১৭ সালের ৩০ নভেম্বর আট দফা প্রস্তাব করেছিল। প্রস্তাবে ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণির শিক্ষাক্রম বিষয়বস্তুর গুরুত্ব অনুসারে তিন গুচ্ছে ভাগ করার জন্য সরকারকে পরামর্শ দেওয়া হয়। 'ক' গুচ্ছে বাংলা, ইংরেজি ও গণিত। 'খ' গুচ্ছে বিজ্ঞান, সমাজ পাঠ (ইতিহাস, পৌরনীতি ও ভূগোল)। 'ক' ও 'খ' গুচ্ছ বাধ্যতামূলক। আর 'গ' গুচ্ছে থাকবে তথ্যপ্রযুক্তি, চারু-কারুকলা, শরীরচর্চা ও খেলাখুলা, ধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা, কৃষি ও গার্হস্থ্য, নৃ-গোষ্ঠীর ভাষা ও সংস্কৃতি। এ ছাড়া 'ঘ' গুচ্ছে প্রকৌশল প্রযুক্তি (বিদ্যুৎ, যন্ত্র, কাঠ, ধাতু ইত্যাদির ব্যবহারিক জ্ঞান ও প্রয়োগ) যুক্ত করার মত দেন শিক্ষাবিদরা।
শিক্ষাবিদরা 'গ' গুচ্ছের বিষয়গুলোর জন্য কোনো পাবলিক পরীক্ষা না নিয়ে বিদ্যালয়েই ধারাবাহিক মূল্যায়ন করার পরামর্শ দেন। আর শিক্ষার্থীর ভবিষ্যতের কর্ম ও পেশা নির্বাচনের প্রস্তুতি হিসেবে নবম ও দশম শ্রেণিতে আগের শ্রেণির গুচ্ছের সঙ্গে 'ঘ' গুচ্ছ যুক্ত করার কথা বলেন। এ গুচ্ছে রয়েছে পদার্থ, রসায়ন, জৈববিজ্ঞান, উচ্চতর গণিত, হিসাব, বিপণন, ব্যবস্থাপনা ও অর্থনীতি। 'ঘ' গুচ্ছ থেকে যে কোনো দু’টি বিষয় শিক্ষার্থীরা পছন্দ করে নিতে পারবে। শিক্ষার্থীরা ইচ্ছা করলে 'ঘ' গুচ্ছ থেকে ঐচ্ছিকভাবে আরও একটি বিষয় নিতে পারবে। তবে কোনো বাধ্যবাধকতা নেই।
এনসিটিবি সূত্রে জানা গেছে, কারিকুলামে বড় পরিবর্তনের মধ্যে নবম শ্রেণি থেকে বিভাগ তুলে দিয়ে গুচ্ছ পদ্ধতি চালু করা হবে। ফলে এ স্তরে বিজ্ঞান, মানবিক বা বাণিজ্য নামে কোনো বিষয় থাকবে না। সবাইকে সব বিষয় পড়তে হবে বা বিষয় পছন্দের সুযোগ থাকবে। এতে একজন শিক্ষার্থী মাধ্যমিক স্তরে সব বিষয়ে জ্ঞান লাভ করবে। ২০২৩ সাল থেকেই নতুন কারিকুলাম ও বই পাবে শিক্ষার্থীরা। বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে শিক্ষার্থীদের উৎপাদনমুখী ও বৈশ্বিক নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে এ উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। ২০১৬ সাল থেকেই কারিকুলাম পরিবর্তনের কাজ শুরু হলেও নতুন মন্ত্রী-উপমন্ত্রীর নির্দেশনা নতুন কারিকুলামে সম্পৃক্ত করার সুযোগ রয়েছে।
এ বিষয়ে এনসিটিবির সদস্য (প্রাথমিক শিক্ষাক্রম) অধ্যাপক ড. এ কে এম রিয়াজুল হাসান বার্ত২৪.কমকে বলেন, প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের কারিকুলাম একসঙ্গেই পরিমার্জন করা হচ্ছে। এতে শিক্ষার্থীদের কোনো সমস্যা হবে না। আগে পৃথকভাবে কারিকুলাম পরিবর্তনের কারণে সমন্বয় থাকত না। এবার পাঠ্যবইয়ের অনেক কিছুই শিক্ষার্থীকে ক্লাস রুমে করতে হবে। ফলে তারা দক্ষতা নিয়েই বড় হবে।
জানা গেছে, নতুন কারিকুলামে পাবলিক পরীক্ষার সংখ্যা ও নম্বর কমিয়ে আনা হবে। এর পরিবর্তে শ্রেণিকক্ষে ধারাবাহিক মূল্যায়ন বাড়ানো হবে। শ্রেণিকক্ষে সব বিষয়ে ধারাবাহিক মূল্যায়নে ২০ নম্বর রাখা হবে। এতে পাবলিক পরীক্ষার নম্বর কমে যাবে। বর্তমানে গার্হস্থ্য অর্থনীতি/কৃষি শিক্ষা পরীক্ষা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধারাবাহিকভাবে মূল্যায়ন করা হচ্ছে। এ অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে নতুন কারিকুলামে যুক্ত হবে সব বিষয়। বিশেষজ্ঞদের সুপারিশ অনুযায়ী ২০১৮ সাল থেকে চতুর্থ বিষয়ের পরীক্ষা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধারাবাহিকভাবে মূল্যায়ন করা হচ্ছে। এ মূল্যায়নের নম্বর সংশ্লিষ্ট শিক্ষা বোর্ডে পাঠানো হচ্ছে প্রতিষ্ঠান থেকে। মূল মার্কশিটে এসব বিষয়ে প্রাপ্ত নম্বর উল্লেখ থাকছে। তবে পরীক্ষার ফলাফলে কোনো প্রভাব পড়ছে না।