‘কৃষকের ঈদ‘ কবিতায় নজরুল প্রশ্ন করেছিলেন, ‘জীবনে যাদের হররোজ রোজা ক্ষুধায় আসে না নিদ/ মুমুর্ষ সেই কৃষকের ঘরে এসেছে কি আজ ঈদ?‘ বেঁচে থাকলে তিনি হয়ত তাঁর প্রশ্নটিকে আরো বড় ও প্র্রসারিত করতেন। বললেন এমন অনেক নিপীড়িত, অসহায় মানুষের কথা, যাদের বেদনার্থ জীবনে এসে উপস্থিত হয়েছে আনন্দের ঈদ।
যে পিতা কিশোর গ্যাং কর্তৃক আক্রান্ত হয়ে জীবন দিয়েছে, তার পরিবারের ঈদ কোনো আনন্দ নিয়ে আসবে না। যে শিশু একটি লাল জুতা কিংবা সামান্য একটি জামার বায়না ধরে ছিল অপেক্ষমাণ, সে যখন মৃত্যুর স্পর্শ পায়, পরিস্থিতি তখন আনন্দের বিপরীতে বেদনার সমুদ্রে রূপান্তরিত হয়। আনন্দের ঈদের আবাহনে এমনই অসংখ্য বেদনার বৃত্তান্ত স্পর্শ করেছে বিশ্ববাসীতে ২০২৪ সাল।
২০২৪ সাল মোতাবেক হিজরি ১৪৪৫ সালের ঈদ-উল-ফিতর বিশ্বময় এসেছে আনন্দ ও বেদনার যুগল কাব্য হয়ে। বাংলাদেশের একদল নাবিক জলদস্যু কবলিত হয়ে বন্দি জীবনে ঈদের অনুভূতি পাচ্ছে। নাড়ির টানে বাড়ি পথে ঈদের আনন্দ করতে যাওয়া বহু মানুষ সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়ে নিমেষেই বিষাদের আখ্যানে পরিণত হয়েছেন। বিশ্বের দেশে দেশে, বাংলাদেশেও লক্ষ লক্ষ মানুষ ঈদ উদযাপন করছে বন্দিশিবির-তুল্য উদ্বাস্তু শিবিরে। মধ্যপ্রাচ্য ও পশ্চিম এশিয়ায় হাজার হাজার নারী, শিশু, বৃদ্ধ রক্ত ও জীবন ছুঁয়ে ঈদ পালন করছেন সংঘাত-আকীর্ণ পরিস্থিতিতে জীবন ও মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। সবচেয়ে মারাত্মক পরিস্থিতি ও মানবিক বিপর্যয়ের মুখোমুখি হয়েছেন ইসরাইলের গণহত্যায় শিকার ফিলিস্তিনের গাজাবাসীরা।
সারা মুসলিম জাহান যখন পবিত্র ঈদের্ আনন্দে মাতোয়ারা, তখন গাজাবাসী অসহায়ের মতো তাকিয়ে আছে বিশ্বমানবতার দিকে। তাদের চারপাশে শুধু ধ্বংসস্তূপ আর মৃত্যুর মহামিছিল। বসবাসের উপযোগী কোনো স্থাপনা চোখে পড়ে না। পেটে খাবার নেই তাদের। অসুখে নেই ওষুধ। আছে বোমাতঙ্ক আর আক্রমণের নিত্য ভীতি। চোখেমুখে হতাশা। মিশরের রাজধানী কায়রোতে যে যুদ্ধবিরতি নিয়ে আলোচনার কথা শোনা যাচ্ছে তা নিয়ে পরস্পরবিরোধী রিপোর্ট পাওয়া যাচ্ছে। মিশরীয় মিডিয়া থেকে বলা হচ্ছে আলোচনায় উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে। কিন্তু হামাস কর্মকর্তারা বলছেন, তাদের দাবি অব্যাহতভাবে প্রত্যাখ্যান করছে ইসরাইল। ইসরাইল আবির্ভূত হয়েছে ধ্বংস ও মৃত্যুর প্রতীকে।
সরেজমিন রিপোর্ট জানাচ্ছে, দক্ষিণের খান ইউনুস থেকে ইসরাইলি সেনাদের প্রত্যাহার করে নেয়ার পর গাজাবাসী তাদের বিধ্বস্ত বাড়িঘরে ফেরা শুরু করেছেন। যেপথে তারা হাঁটছেন, চোখে যতদূর দেখতে পান- সবটাই ধুলোবালির স্তূপ। কে বলবে মাত্র ৬ মাস আগেও এসব স্থানে জনবসতি ছিল! মানুষের কলরবে মুখরিত হতো পথঘাট, হাটবাজার, স্কুল, মসজিদ! মানুষ রমজানের নামাজ পড়েছেন ধ্বংসপ্রাপ্ত মসজিদের সামনে। ঈদের দিনটি তাদেরকে আলিঙ্গন করেছে প্রেতপুরীর নিস্তব্ধ বিভীষিকা।
ইসরাইলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্ট বলেছেন, গাজা থেকে যেসব ইসরাইলি সেনাদের প্রত্যাহার করা হয়েছে, তাদেরকে ভবিষ্যত অপারেশনের জন্য প্রস্তুত রাখা হবে। বিশেষ করে দক্ষিণের রাফা শহরে এই অপারেশন চালানো হবে। ফলে গাজায়, রাফায় ইসরাইল যে তাদের নৃশংসতা বন্ধ করছে এমনটা ভাবার কোনো অবকাশ নেই। বরং এই সেনা প্রত্যাহার হতে পারে তাদের ভবিষ্যত হামলার আরেক প্রস্তুতি। কৌশল বদলে বদলে ইসরাইল গণহত্যার উন্মত্ততা থেকে মোটেও সরে আসছে না। রক্তের নেশা তাদেরকে পরিণত করেছে আধুনিক দানবে।
গত বছরের ৭ই অক্টোবর হামাসের রকেট হামলার পর ইসরাইল গাজায় যুদ্ধ শুরু করে। এ পর্যন্ত এই যুদ্ধে তারা কমপক্ষে ৩৫,০০০ জন ফিলিস্তিনিকে হত্যা করেছে। আহত হয়েছেন কমপক্ষে ৭৫,৮৮৬ জনকে, যাদের মধ্যে অধিকাংশই নারী, শিশু, অসুস্থ ও বৃদ্ধ। ধ্বংস করে দিয়েছে শহর, গ্রাম, জনপদ, স্কুল, হাসপাতাল, মসজিদসহ যাবতীয় নির্মাণ। এতো ধ্বংসের চালচ্চিত্র আর মৃত্যুর মিছিল আধুনিক পৃথিবী ও সভ্যতার ইতিহাস আগে কখনোই দেখেনি, ইরাইল কর্তৃক একতরফাভাবে যা চলছে গাজায়।
বর্ষের পরিক্রমায় ঈদ আসছে পৃথিবীতে ইসলামের আর্বিভারের সঙ্গে সঙ্গেই। প্রতিবছরের ঈদে একই রকম পরিস্থিতি ছিল না। কখনো যুদ্ধ, বন্যা, মারী, দুর্ভিক্ষ পরিবেশ-পরিস্থিতিকে ভারী করেছে। আনন্দের শরীরে বিছিয়ে দিয়েছে বিষাদের কালো চাদর। কিন্তু অতীতে কখনোই এমন নিঠুর পরিস্থিতি হয়েছিল, যা হয়েছে চলতি ২০২৪ সালে? ২০২৪ সালের ঈদকে বিশ্বের ইতিহাস কিভাবে মনে রাখবে, সেটা নির্ধারণ করবে ভবিষ্যতের ইতিহাস।
ইতিমধ্যেই খবর প্রকাশিত হয়েছে যে, বিশ্বের নানা দেশে ঈদের সূচনা হয়েছে গাজায় নিহত ও আক্রান্ত মানুষের জন্য প্রার্থনার মাধ্যমে। কোথাও আনন্দ-উল্লাস হ্রাস করা হয়েছে বিপন্ন মানবতার প্রতি সহমর্মিতা জানিয়ে। গেল বড়দিনেও (২০২৩) এমন পরিস্থিতি হয়েছিল। ২৫ ডিসেম্বর গাজায় রক্তের বন্যা বইয়ে দিয়েছিল ইসরাইল। বড়দিনের আনন্দও পরিণত হয়েছিল শোকে। ঈদের সময়ও সেই বেদনা আরো প্রলম্বিত হয়েছে। বেড়েছে মৃত্যু ও ধ্বংসের পরিসংখ্যান। আনন্দে উদ্বেলিত ঈদের সময় আমরা যেন সেই বেদনাকে ভুলে না যাই। উল্লাস ও উদযাপনের স্রোতে যেন মানবিকতাকে ভাসিয়ে না দিই। মানবিক আর্তিতে যেন আমরা আনন্দকে বিলিয়ে দিতে পারি বিপন্নদের মাঝেও। তাদের প্রতি জানাতে পারি সহানুভূতি ও প্রার্থনা।