মনোনয়ন বঞ্চিতদের জাপা ছাড়ার হিড়িক

বিবিধ, নির্বাচন

সেরাজুল ইসলাম সিরাজ, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | 2023-08-22 19:17:50

দলের মনোনয়ন না পেয়ে অনেকেই জাতীয় পার্টির সঙ্গে সম্পর্ক চুকিয়ে ফেলছেন, আবার অনেকে রয়েছেন পাইপ লাইনে। আবার কেউ কেউ রাজনীতি থেকেই অবসরে যাওয়ারও ঘোষণা দিয়েছেন।

এরই মধ্যে জাপার তিনজন মনোনয়ন প্রত্যাশী জাপাকে গুডবাই জানিয়েছেন। তাদেরই একজন গাইবান্ধা জেলা জাপার সভাপতি ও দলের নীতি নির্ধারণী পরিষদের সদস্য আব্দুর রশীদ সরকার। তিনি জাপার টিকেটে গাইবান্ধা থেকে দু’বার এমপি নির্বাচিত হন। তাকে মনোনয়ন না দিয়ে মহাজোটকে আসনটি ছেড়ে দেওয়ার খবরে জাপা ছেড়ে বিএনপির মনোনয়ন নিয়েছেন।

ফেনী-১ আসনের মনোনয়ন প্রত্যাশী এরশাদের প্রচার ও প্রকাশনা বিষয়ক উপদেষ্টা রিন্টু আনোয়ার মনোনয়ন পাচ্ছেন জানতে পেরে অভিমানে জাপার সঙ্গে সম্পর্কু চুকিয়ে ফেলেছেন। আবার লালমনিরহাট জেলার মনোনয়ন প্রত্যাশী জাপার যুগ্ম-সমাজ কল্যাণ বিষয়ক সম্পাদক রোকউদ্দিন বাবুল জাপা ছেড়ে বিএনপিতে ঠিকানা গড়েছেন। আরও অনেকে রয়েছেন দল ছাড়ার পাইপ লাইনে।

সামরিক শাসকের হাত ধরে প্রতিষ্ঠা পাওয়া জাতীয় পার্টি শুরু থেকেই এরশাদকে কেন্দ্র করে আবর্তিত। দু’একবার যারাই এরশাদের সিদ্ধান্ত চ্যালেঞ্জ করতে গেছেন তাদেরকেই দল থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে। আবার অনেক নেতা একাধিক দফায় শোকজ ও সাময়িক বহিস্কারের শিকার হয়েছেন। শো’কজের ক্ষেত্রে এরশাদ ছাড় দেননি আপন ভাই জিএম কাদের ও স্ত্রী রওশন এরশাদকেও।

জাতীয় পার্টি নামে এখন ৪টি দল বিরাজমান। যারা দু’টি জোটে সমানভাবে ভাগ হয়ে রয়েছে। জাপা প্রথম ভাঙনের শিকার হয় ১৯৯০ সালে। ক্ষমতাচ্যুতির পর এরশাদ জেলে পৃথক জাপা গঠন করেন প্রয়াত কাজী জাফর আহমেদ।

এরপর ১৯৯৯ সালে মিজানুর রহমান চৌধুরী-আনোয়ার হোসেন মঞ্জু নেতৃত্বে গঠন করা হয় পৃথক জাতীয় পার্টি (মিম)। এই ভাঙনটি ছিলো সবচেয়ে বড় ভাঙন। ওই সময়ে লাঙ্গল প্রতীক নিয়েও টানাহেচড়া চলে। বিষয়টি কোর্ট পর্যন্ত গড়ায়।

এরপর কয়েক বছরের মাথায় বিএনপির সঙ্গে ৪ দলীয় জোট করেন হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। ২০০১ সালের নির্বাচনের পুর্বে হঠাৎ ইউটার্ন নিলে তৎকালীন মহাসচিব প্রয়াত নাজিউর রহমান মঞ্জু ও কাজী ফিরোজ রশীদের নেতৃত্বে আরেকবার ভাঙনের মুখে পড়ে জাপা। এবার সৃষ্টি হয় জাতীয় পার্টি (নাফি)। যেই দলটি এখনও জাতীয় পার্টি জেপি নামে বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটে রয়ে গেছে।

সর্বশেষ ভাঙনের শিকার হয় সাবেক প্রধানমন্ত্রী প্রয়াত কাজী জাফর আহমেদের হাত ধরে। এবারও বেশকিছু প্রেসিডিয়াম সদস্যসহ বের হয়ে গিয়ে নতুন জাতীয় পার্টি (জাফর) সৃষ্টি করেন। এই অংশটিও বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোটে সক্রিয়।

ভাঙা-গড়ার খেলায় পার্টি অনেকটাই নেতৃত্বশূন্য বলা যেতে পারে। ঝানু রাজনীতিবিদ বলতে যা বুঝায় এমন নেতার সংখ্যা সংখ্যা হাতেগোনা। যে কারণে মাঝে-মধ্যেই বিভিন্ন দল থেকে হায়ার করে জেলা কিংবা বিভাগের দায়িত্ব দেওয়া হচ্ছে। যেমন হঠাৎ করেই যোগদান করা এক নেতাকে খুলনা মহানগরের আহ্বায়ক করা হয়।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, এখন জাপার মাঠ পর্যয়ে অনেক জনপ্রিয়তা রয়েছে। কিন্তু সেই সমর্থনকে কাজে লাগানোর মতো নেতার সংকট প্রকট। আবার যারাও রয়েছেন তারাও ঝুঁকি নিতে চান না। এমনকি এরশাদ অগ্রিম প্রার্থী করার ঘোষণা দিলেও তারা বিশ্বাস করতে পারছেন না।

৩ বছর আগে থেকেই এবার নির্বাচনী মাঠে নেমেছেন হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। বিভিন্ন সভা-সমাবেশে গেলেই সেই এলাকার প্রার্থীকে পরিচয় করে দিয়ে এসেছেন। এমনকি অনেককে কয়েক বছর আগে থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে চিঠি দিয়ে দলের প্রার্থী বলে ঘোষণা দিয়েছেন। কিন্তু তাদেরকে মনোনয়ন দেওয়া হয়নি।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৫ আসনে গিয়ে বলে এসেছিলেন কাজী মামুনুর রশীদ থাকলো। জোট বা নৌকা কিছু বুঝি না। সে লাঙ্গলের প্রার্থী থাকলো। আপনারা তাকে ভোট দিয়েন। এমন অনেক ঘটনা রয়েছে, যারা মনোনয়ন পাননি।

ঢাকা দক্ষিণ জাতীয় পার্টির সাধারণ সম্পাদক ও কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম-মহাসচিব জহিরুল আলম রুবেল ঢাকার স্থায়ী বাসিন্দা। ঢাকা থেকেই নির্বাচন করার প্রস্তুতি নিয়েছিলেন। কিন্তু কয়েক বছর আগে তাকে মানিকগঞ্জ-২ আসন থেকে মনোনয়ন দেওয়ার ঘোষণা দিয়ে সেখানে গিয়ে মাঠ গোছানোর জন্য বলা হয়।

জহিরুল আলম রুবেল মঙ্গলবার (২৬ নভেম্বর) বার্তা২৪.কমকে বলেন, একদিকে সময় নষ্ট। আবার ৪৪ লাখ টাকা খরচ করেছি দলকে সংগঠিত করার জন্য। এখন কি হলো, আমাকে যদি নাই দেওয়া হবে। তাহলে কেনো সেখানে পাঠানো হলো। কি পেলাম আমরা দল করে।

কয়েক দফায় ভাঙন, বহিস্কার ও নেতাদের দল ছাড়ার কারণে ক্ষয়িষ্ণু হয়ে পড়েছে দলটি। ভোটের সমীকরণেও দিন দিন পিছিয়ে পড়ছে। আসনের সংখ্যায় কিছুটা হেরফের হলেও ভোটের সূচক বেশ নিম্নগামী। ১৯৯১ সালে নির্বাচনে কাস্টিং ভোটের ১১.৯২ শতাংশ পেয়েছিলো জাতীয় পার্টি।

এরপর ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে ১০.৬৭ শতাংশ, আর ২০০১ সালের ইসলামী জাতীয় ঐক্যফ্রণ্টের ব্যানারে নির্বাচনে অংশ নিয়ে ভোট পায় ৭.২৫ শতাংশ। সর্বশেষ ২০০৮ সালের নির্বাচনে পেয়েছে মাত্র ৭.০৪ শতাংশ। ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোটবদ্ধভাবে নির্বাচন অংশ নেয়। কিন্তু যে আসনেই জোট ছাড়া নির্বাচন করেছে সেখানেই ধরাশায়ী দলটির প্রার্থীরা।

যে কারণে এবার এককভাবে নির্বাচনের চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলেছে। আওয়ামী লীগের সঙ্গেই মহাজোটগতভাবে নির্বাচন করতে চায়। সেভাবেই এগুচ্ছে জাতীয় পার্টি বলে বিভিন্ন সভা-সমাবেশে বলেছেন পার্টির মহাসচিব এবিএম রুহুল আমিন হাওলাদার।

এ সম্পর্কিত আরও খবর