হলফনামায় প্রকাশিত আইনপ্রণেতার অবয়ব

, নির্বাচন

কবির য়াহমদ, অ্যাসিস্ট্যান্ট এডিটর বার্তা২৪.কম | 2023-12-10 14:13:46

২০০৮ সালের নির্বাচন থেকে প্রার্থীদের হলফনামা দিতে হয়। এই হলফনামায় দিতে হয় আট ধরনের সুনির্দিষ্ট তথ্য। এটা এতখানি গুরুত্বপূর্ণ যে, তথ্যের গরমিলে প্রার্থীর প্রার্থিতা বাতিলও হতে পারে। বিষয়টি সংশ্লিষ্ট রিটার্নিং কর্মকর্তার ওপর নির্ভর করে, তবে এত অল্প সময়ে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা তথ্যসহ বিবিধ যাচাইবাছাইয়ের কাজটি যেভাবে করে থাকেন তাতে প্রশ্ন থেকে যায়। এখন পর্যন্ত তথ্যের সত্যতা যাচাইয়ের বিষয়টিকে দায়সারা গোছের বলেই মনে হয়। শুরু থেকেই প্রার্থীদের হলফনামা তুমুল আলোচিত বিষয় হলেও আলোচনার বিষয় ধরে কোন তদন্ত হয়েছে বলে প্রমাণ মেলেনি।

দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন সন্নিকটে। ইতোমধ্যে নির্বাচন সংশ্লিষ্ট দাপ্তরিক অনেক কাজ সম্পন্ন হয়েছে। প্রার্থীদের মনোনয়ন জমা নেওয়া শেষে যাচাইবাছাই হয়েছে। যাচাইবাছাই ও প্রার্থিতা বাতিল শেষে এখন চলছে আপিলের পর্যায়। এই আপিলের মাধ্যমে কেউ কেউ ফিরবেন নির্বাচনে, কেউ বা আপিলেও ব্যর্থ হয়ে যেতে পারেন হাইকোর্টে; এগুলো নির্বাচনী প্রক্রিয়া। ইসি সূত্রে জানা গেছে, আগামী ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠেয় নির্বাচনে ৩০০ সংসদীয় আসনে ২ হাজার ৭১৬টি মনোনয়নপত্র জমা পড়েছিল। যাচাইবাছাইয়ে বাতিল হয়েছে ৭৩১টি মনোনয়নপত্র। বাতিল হওয়া প্রার্থীদের অনেকেই আপিল করেছেন নিজেদের জন্যে, আবার অনেকেই প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর বিরুদ্ধে আপিল করেছেন।

মনোনয়নপত্রের সঙ্গে হলফনামা ও সেখানে দেওয়া তথ্য নিয়ে এখন সকল আলোচনা। এ হলফনামায় যে আট ধরনের তথ্য দিতে হয় সেগুলো হচ্ছে শিক্ষাগত যোগ্যতা; বর্তমানে ফৌজদারি মামলার আসামি কি-না; অতীতে ফৌজদারি মামলার আসামি ছিলেন কি-না এবং রায় হলে তার তথ্য; পেশার বিবরণী; প্রার্থীর নিজের ও তার ওপর নির্ভরশীলদের আয়ের উৎস/উৎসসমূহ; প্রার্থীর ও তার ওপর নির্ভরশীলদের এবং তার স্ত্রী বা স্বামীর সম্পদ ও দায়ের বিবরণী (যেখানে অস্থাবর, স্থাবর সম্পদ দায় এসব তথ্য); এর আগে সংসদ সদস্য ছিলেন কি-না (হইলে ভোটারদের দেওয়া প্রতিশ্রুতি ও এর কী পরিমাণ অর্জন সম্ভব হয়েছিল তার বিবরণ); এবং ঋণ সংক্রান্ত তথ্যাবলী।

হলফনামা সম্পর্কিত বিধান আগে ছিল না, নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন থেকে এটা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। ২০০৫ সালের ২৪ মে এক রিট আবেদনের নিষ্পত্তি করে হাইকোর্ট প্রার্থীদের ইসিতে আট ধরনের তথ্য সরবরাহের নির্দেশ দেন। এর পরের বছরের ১৯ ডিসেম্বর হাইকোর্টের রায় স্থগিত করেন আপিল বিভাগের অবকাশকালীন চেম্বার বিচারপতি। ২০০৭ সালের ১১ ডিসেম্বর আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ অবকাশকালীন চেম্বার বিচারপতির স্থগিতাদেশ খারিজ করে দিলে হাইকোর্টের রায় বহাল থাকে। এরপর নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) সংশোধন করে মনোনয়নপত্রের সঙ্গে প্রার্থীদের আট তথ্যসহ হলফনামা জমা দেওয়া বাধ্যতামূলক করা হয়।

আদালতের আদেশের পর আরপিও সংশোধন শেষে হলফনামায় আট ধরনের তথ্যের বিষয়টি বাধ্যতামূলক হলেও গত তিনটি নির্বাচন এবং এবারের নির্বাচনেও প্রার্থীরা সঠিক ও স্বচ্ছভাবে এই তথ্য দিচ্ছেন বলে প্রমাণ হয়নি। বরং এনিয়ে বিতর্ক বেড়েছে। কেবল জাতীয় সংসদ নির্বাচনই নয়, অন্য নির্বাচনগুলোতেও হলফনামায় প্রার্থীদের দেওয়া তথ্য নিয়ে বিতর্ক হয়েছে, বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়েছে। শিক্ষাগত যোগ্যতা থেকে শুরু করে আয়-ব্যয় এবং প্রার্থী ও নির্ভরশীলদের সম্পদ নিয়ে হাস্যকর রকমের তথ্যের উপস্থাপন আমরা দেখেছি, এখনো দেখছি। জনভাবনায় এগুলো গুরুত্বপূর্ণ স্থান নিলেও নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে সেরূপ পদক্ষেপ দেখাও যায়নি। উপরন্তু নানা সময়ে নির্বাচন কমিশন সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, হলফনামায় তথ্যের সত্যতা নিশ্চিত করতে তাদের কিছু করার নেই।

উদাহরণ তো অনেক দেওয়া যায়; একটু পেছন ফিরে তাকালে দেখা যায়, গত বছরের শেষের দিকে মাদারীপুর-৩ আসনের সংসদ সদস্য আবদুস সোবাহান গোলাপের হলফনামায় তথ্য গোপন নিয়ে ব্যাপক আলোচনার প্রেক্ষিতে জানুয়ারিতে নির্বাচন কমিশনার মো. আলমগীর বলেছিলেন, ‘হলফনামা আমাদের একটা জমা দেবে। কিন্তু সেই হলফনামার সত্য-অসত্য তথ্যের ভিত্তিতে আমাদের কোনও কিছু করার আইনগত ভিত্তি নাই।’ দুর্নীতির যদি কিছু থাকে তবে সেটা দুর্নীতি দমন কমিশন দেখবে, এনবিআর দেখবে, ইসির এখানে কোন শাস্তির ব্যবস্থা নাই বলে মন্তব্য করেছিলেন তিনি। নির্বাচন কমিশনারের এই বক্তব্যে এটা পরিস্কার যে, ইসি চাইলেও এখানে খুব বেশি কিছু করতে পারে না, অথবা করতে আগ্রহী নয়। প্রসঙ্গক্রমে আরেকটা উদাহরণ দেওয়া যায়; এ বছরের মাঝামাঝিতে সিলেট সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরীর বিরুদ্ধে হলফনামায় শিক্ষাগত যোগ্যতা বিষয়ক অসত্য তথ্য দেওয়ার অভিযোগ এনেছিলেন জাতীয় পার্টির প্রার্থী নজরুল ইসলাম বাবুল। বাবুলের ওই অভিযোগ আমলে নেননি সংশ্লিষ্ট রিটার্নিং কর্মকর্তা। এরপর এই অভিযোগ হাইকোর্ট পর্যন্ত গেলেও আনোয়ারুজ্জামানের প্রার্থিতায় কোন প্রভাব পড়েনি। এমন নজির আছে অনেক। এসব বলছে, হলফনামা শব্দের ওজন যতখানি, ঠিক ততখানি কার্যকর নয় আদতে!

সত্যি কি কার্যকর নয় হলফনামা? কিছু উদাহরণ টানলে আবার বলতেই হয়—ভুল তথ্যের প্রমাণে প্রার্থিতা বাতিল  হয়ে যেতে পারে প্রার্থীর! এবার মামলা ও ঋণের তথ্য গোপন করায় প্রার্থিতা বাতিল হয়েছে কিশোরগঞ্জ-২ আসনে মনোনয়নপত্র জমা দেওয়া প্রার্থী মেজর (অব.) আখতারুজ্জামানের। একই আসনের আরও দুইজনের প্রার্থিতা বাতিল হয়েছে মামলার তথ্য গোপনে। কেবল তারাই নন, আরও আছেন অনেকেই, সংগত কারণে অনেকের নাম উল্লেখের প্রয়োজন মনে করছি না। আবার এমন অনেকের মনোনয়নপত্রও যাচাইবাছাইয়ে টিকে গেছে যারা তথ্য গোপন সত্ত্বেও রিটার্নিং কর্মকর্তারা বিষয়টি এড়িয়ে গেছেন। আওয়ামী লীগের মনোনয়নে এবারের নির্বাচনের প্রার্থী বিএনপির সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার শাহজাহান ওমর, নোয়াখালীর একরামুল করিম চৌধুরী, চট্টগ্রামের মহিউদ্দিন বাচ্চুসহ আরও অনেকেই হলফনামায় তথ্য গোপন করেও টিকে গেছেন বলে অভিযোগ ওঠেছে।

হলফনামায় প্রার্থীরা যে সকল তথ্য দেন বাস্তবতার সঙ্গে মেলে না অনেকটাই। ৩১২ কোটি টাকার সম্পদের মালিক সালমান ফজলুর রহমান তার নির্বাচনী হলফনামায় উল্লেখ করেন তার নিজস্ব কোন গাড়ি এবং অ্যাপার্টমেন্ট নেই। এমন অনেক আছেন যাদের পরিচিতি আছে ধনিক সমাজের অংশ হিসেবে, কিন্তু নির্বাচনের হলফনামায় তার টিকিটিও মেলে না। অনেকেই আছেন সম্পদের অর্থমূল্য যেভাবে নির্ধারণ করেন সেটাও অস্বাভাবিক। যেমন চট্টগ্রামের সংসদ সদস্য আবু রেজা মুহাম্মদ নেজামুদ্দিন নদভীর কাছে আছে ৯০ ভরি স্বর্ণ। নদভী তার কাছে থাকা স্বর্ণের ভরিপ্রতি দাম ধরেছেন পৌনে ৩ হাজার টাকা। হবিগঞ্জে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন না পেয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়া অ্যাডভোকেট আবদুল মজিদ খান এমপি তার স্ত্রীর থাকা স্বর্ণের ভরিপ্রতি দাম ধরেছেন মাত্র ৪ হাজার টাকা। অনেক প্রার্থীই তাদের প্লট-ফ্ল্যাটের যে দাম ধরেছেন সেটাও বাস্তবতার সঙ্গে মেলে না। বাজারমূল্য নাকি উৎসমূল্য; উল্লেখের ক্ষেত্রে যদি উৎসমূল্যই চূড়ান্ত হয়, তবুও প্রশ্ন থাকে—কোন কালে ছিল এমন!

দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে অনেক প্রার্থী আগেও নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন। হলফনামায় যে তথ্য দিতে বাধ্য প্রার্থী তন্মধ্যে অন্যতম হলো—আগে জাতীয় সংসদের সদস্য ছিলেন কি-না সে সম্পর্কিত তথ্য। আগে সংসদ সদস্য হয়ে থাকলে ভোটারদেরকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি কতটা অর্জন সম্ভব হয়েছিল, সে তথ্যাদি যুক্ত করতে হয়। অর্থাৎ জবাবদিহির বিষয়টি হলফনামায় সন্নিবেশিত করা হয়েছে। এখানে আগের দেওয়া অর্থনৈতিক তথ্যের সঙ্গে বর্তমানের তথ্যের মিল-অমিলের বিষয়টিও কি আমলে নেওয়া যায় না? প্রার্থীরা মন্ত্রী-এমপি হয়ে কতখানি সম্পদের মালিক হলেন, তাদের নির্ভরশীলদের সম্পদ কতখানি বেড়েছে এর তুলনামূলক বিশ্লেষণ শেষে সিদ্ধান্ত নেওয়া গেলে জবাবদিহির বিষয়টি পূর্ণাঙ্গ রূপ পেত। ‘অলাভজনক’ পদে থেকে এত রাতারাতি অনেকেই কীভাবে এত বিত্ত-বৈভবের মালিক হলেন—এই প্রশ্ন ওঠেছে; এবং এমন প্রশ্নই স্বাভাবিক!

ভোটারদের কাছে গুরুত্বহীন হিসেবে থাকলেও এই হলফনামাই আদতে প্রার্থীদের অবয়ব।  ধরে নিলাম, নির্বাচন কমিশন বিবিধ সীমাবদ্ধতার কারণে হলফনামায় দেওয়া তথ্যগুলো নিয়ে খুব বেশি ঘাঁটাঘাঁটি করে না, কিন্তু তাই বলে কি বিভ্রান্তিকর তথ্য উপস্থাপনে নীতি-নৈতিকতা বিসর্জন দিতে হবে? প্রার্থী যারা তাদের মধ্য থেকেই নির্ধারিত-নির্বাচিত হবে আগামী দিনের দেশের আইনপ্রণেতা, আর এ আইনপ্রণেতারা যদি আইনি কিংবা প্রাতিষ্ঠানিক সীমাবদ্ধতার সুযোগে অসত্য, বিভ্রান্তিকর তথ্য উপস্থাপন কিংবা তথ্য গোপন করেন তবে স্বভাব নাগরিক-প্রশ্ন কাদের হাতে যাচ্ছে দেশ? 

সবাই এমন করছেন না ঠিক, তবে অধিকাংশই এর বাইরে নয়। এখানে অধিকাংশের জায়গায় একজন থাকলেও এটাও দুর্ভাগ্যের!

এ সম্পর্কিত আরও খবর